অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪২

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৫৯

বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মেজর রফিকুল ইসলামকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক গৌরবের অধিকারী তিনি; ছিলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। সেনাবাহিনী ছাড়াও চাকরি করেছেন বিভিন্ন সরকারি সংস্থায়। সর্বত্রই তিনি সুনাম অর্জন করেছেন; রেখেছেন সর্বোচ্চ দক্ষতার প্রমাণ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর রফিকের একটি খুবই মানবিক ভূমিকার খবর আমার কাছে এসেছিল সত্যের সঙ্গে আংশিক মিথ্যা মিশিয়ে, তবে মিথ্যা মিশাল দেবার বিষয়টি তখন জানতাম না। এদিকে প্রাপ্ত তথ্য অকাট্যভাবে প্রমাণ করার মতো উপকরণ আমাদের হাতে ছিল না। এরপরও মুখরোচক বিষয়টি এড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না। এ অনিচ্ছার বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ সাংবাদিকতার পরিপন্থী। আবার বাস্তবতা হচ্ছে, একেবারে বিশুদ্ধ বিষয়ের ওপর নির্ভর করে কোনো কিছু তৈরি করা প্রায় ক্ষেত্রেই অসম্ভব। যেমন খাদ ছাড়া স্বর্ণের অলংকার হয় না; ময়দা বা এ জাতীয় কিছু না মিশিয়ে রসগোল্লা বানানো অসম্ভব। রসগোল্লার বিষয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত কিশোর বয়সে। রেজা ভাইর সঙ্গে মিলে খাঁটি ছানা দিয়ে রসগোল্লা বানাবার চেষ্টা করেছিলাম দুই খালাতো ভাই। কিন্তু খাটি ছানা দিয়ে রসগোল্লা বানানো যায়নি; খাদ না দেয়ার ছানাসহ সব উপকরণই ফেলে দিতে হয়েছে। পরে পরিণত বয়সে বিষয়টি নিয়ে পেশাদার ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জেনেছি, আমাদের ব্যর্থতা ছিল প্রকৃতির বাস্তবতা; আমাদের অদক্ষতা নয়।

কিশোর বয়সে খাদহীন রসগোল্লা বানাবার ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার আলোকে নয়; মেজর রফিকের বিষয়ে পাওয়া তথ্যটি এড়িয়ে যেতে চাইনি পত্রিকার অন্যরকম বাস্তবতার কারণে। তখন সুগন্ধার সার্কুলেশন ছিল সর্বোচ্চ অবস্থানে। ফলে এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিনিয়ত টেনশনে থাকতে হতো। আর, সর্বোচ্চ সার্কুলেশেনের পত্রিকার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত সর্বোচ্চ সতর্কতা অনিবার্য। যা আজকের বাস্তবতায় দৈনিক প্রথম আলো এবং দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর দিকে তাকালে অনুধাবন করা সহজ। আর কেবল পত্রিকা নয়; এ বিষয়টি সত্য যেকোনো পণ্যের বেলায়ও। ধরা যাক, সাবান প্রসঙ্গ। এক সময় কসকো সাবানের দাপট ছিল শহর থেকে অজপাড়া গাঁ পর্যন্ত; কিন্তু পরে রেস্তোরাঁর বেসিনে স্থান নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে এখন এ পণ্যটি প্রায় যাদুঘরে রাখার আইটেমে পরিণত হয়েছে। প্রায় একই রকম দাপট ছিল ৫৭০ সাবানেরও। কিন্তু বর্তমানে এখন একুরিয়ামের কাতলা মাছের মতো খাবি খাচ্ছে। এর বিপরীতে লাক্স সাবান ঘরে ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে স্থান করে নেবার পরও প্রতিনিয়ত থাকতে হচ্ছে প্রচারণায়। আর এ প্রচারণায় সেলিব্রেটি সুন্দরীদের মডেল হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি মেঘেঢাকা সুন্দরীদের অনুসন্ধান করার ‘দায়িত্বও’ নিয়েছে লাক্স তথা ইউনিলিভার। যদিও অনেকে বলেন, এ সুন্দরী অনুসন্ধানের অন্তরালে কারো না কারো অন্য রকম বাণিজ্যও চলে।

বাস্তবতার আলোকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্কে প্রাপ্ত মুখরোচক বিষয়টি ইগনোর করিনি। তবে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে ‘খোঁচা’ দেবার অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ সাবধান ছিলাম। ‘হালকার উপর ঝাপসা’ স্টাইলে গেদুচাচার চিঠিতে বিষয়টিকে এমনভাবে দিয়েছিলাম যাতে পাঠক আকৃষ্ট হবে; কিন্তু সংক্ষুব্ধ কেউ আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারবে না। আবার এও ধারণা করেছিলাম, সংক্ষুব্ধ হবার মতো কারো নজরেই পড়বে না। কিন্তু বিষয়টি নজরে পড়ল খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর; যার বিষয়ে খবরটি প্রকাশ হয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে, অন্য কেউ দেখে তাকে দেখিয়েছে। সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, পত্রিকায় কারো পক্ষে লিখলে তা তেমন প্রচারণা পায় না; কিন্তু বিপক্ষে কিছু লিখলে তা নিয়ে ছোটাছুটি করার লোকের অভাব হয় না।

গেদুচাচার চিঠির লেখায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক যখন সংক্ষুব্ধ হন তখন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (অর্থ) ছিলেন ভোলার সন্তান মোহাম্মদ সালাম। তার সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা অনেক বছরের। ঘটনাচক্রে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয় তখন তিনি ডিএমপির একটি জোনের ডিসি ছিলেন; সম্ভবত ডিসি নর্থ। বসতেন ৩৬ মিন্টু রোডে আজকের গোয়েন্দা অফিস ভবনের দোতলায়। সেসময় ডিএমপিতে মাত্র দুটি জোন ছিল। মিরপুরে ‘শিকদার বস্তি’ নামে একটি বস্তি পুড়িয়ে দেবার ঘটনা কাভার করতে গিয়ে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ঘটনাস্থল থেকে ফেরার পথে জাকারিয়া মিলন ও আমাকে তার সঙ্গে অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার কাছে মিলন ভাই গুরুত্ব পেয়েছিলেন ইত্তেফাকের রিপোর্টার হিসেবে; তারা পূর্ব পরিচিত ছিলেন। আর অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ সালাম আমাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মালিকানার পত্রিকার সাংবাদিক হবার কারণে হয়তো। তার অফিসে চা খেতে খেতে বললেন, বস্তিবাসীর জন্য আহাজারি করা সালাম সিকদারই বস্তিতে আগুন দিয়েছে; উদ্দেশ্য হচ্ছে বস্তি খালি করা। তার পেছনে অন্য চক্র আছে। এরপর তিনি সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে ফোন করলেন। পেশাদার কায়দায় শক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দুই দিনের মধ্যে প্রমাণসহ আসামি ধরবা; এ বিষয়ে আমাকে হস্তক্ষেপ করতে হলে তুমি কিন্তু থানায় থাকবা না!’

বস্তিতে অগ্নিসংযোগকারী আসামি ধরা পড়েছিল দুই দিনের মধ্যেই। অগ্রহণযোগ্য সামরিক সরকারের সময় বস্তিতে অগ্নিসংগোকারী আসামি ধরার জন্য ডিএমপির একজন ডিসির নির্দেশনাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সরকারের আমলে বস্তিতে যত অগ্নিকাণ্ড হয়েছে তার কতটার আসামি ধরা পড়েছে তা নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন আছে। যদিও এ সব ঘটনায় অপরাধীদের ধরার জন্য অনেক উপর থেকে আশ্বাস দেয়া হয় প্রতিবারই; কিন্তু বাস্তবে প্রতিফলন ঘটে না এসব আশ্বাসের।

মোহাম্মদ সালামের সাথে পরিচয়ের পর আমাদের সম্পর্ক দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়। এর মধ্যে তিনি দুই দুইবার ডিএমপির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এডিশনাল আইজিপি হয়েছেন; এর আগে সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। পুলিশ প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাবার দোড়গোড়ায়ও ছিলেন। কিন্তু তার আর আইজি হওয়া কপালে জোটেনি; একটি চক্রের কারসাজিতে তাকে অসময়ে বিদায় নিতে হয়েছে পুলিশ বাহিনী থেকে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে মোহাম্মদ সালামের রুমে আমি প্রায়ই যেতাম। সেখানে একদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকের এক বন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি জানালেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমার সঙ্গে চা খেতে চান। আবার সেই ‘চা!’ তত দিনে আমার ‘মুর্খ সাহস’-এর তীব্রতা অনেকটা স্থিমিত হয়েছে। ভাবলাম, চা-বিস্কুট ‘আইসক্রিম-ডিমে’ রূপান্তরিত হবার আগেই মিটমাট হয়ে যাওয়া ভালো। পরদিন সালাম ভাইর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। তিনিও দেখা করার পরামর্শ দিলেন। বললেন, কোনো জটিলতাই প্রলম্বিত করা ঠিক না; তাতে শামুকের কাটায়ও গ্যাংগ্রিন হবার আশঙ্কা থাকে। আমি শামুকের কাটা থেকে রক্ষা পেলেও মোহাম্মদ সালাম পাননি; তাকে অসময় পুলিশ বাহিনী থেকে বিদায় করা হয়।

এদিকে আওয়ামী সরকার বিদায় করেছে বলে মোহাম্মদ সালামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় বিএনপি সরকার। ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় খালেদা সরকার; এ ক্ষেত্রে নটবর হতে পারেন ভোলার সন্তান ক্ষমতা কেন্দ্রের গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। অথবা থাকতে পারে অন্য কোনো লবিং। যে লবিংয়েই হোক, নিয়োগ লাভের পর মোহাম্মদ সালাম নতুন দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ মাত্রায় মনোযোগী হয়েছিলেন। তার সময় প্রশাসন ক্যাডারের মুজিবুর রহমান হাওলাদার পরিচালক (অপারেশন) থাকায় মোহাম্মদ সালামের পক্ষে দায়িত্ব পালন সহজতর হয়েছিল। শুরুতেই তিনি অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি মাদকবিরোধী তৎপরতা জোরদার করেন। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ পুলিশি চাকরির অভিজ্ঞতা বেশ সহায়ক হয়েছে। পাশাপাশি তিনি পুলিশ বাহিনীর বেশ সহযোগিতা পেয়েছেন পুরনো সম্পর্কের কারণে। তার আমলে অধিদফত ও পুলিশের যৌথ মাদকবিরোধী তৎপরতা এতোটাই শক্তিশালী হয়েছিল যে, মাদক ব্যবসায়ীদের অবস্থা হয়েছিল জলের মাছ ডাঙ্গায় তোলার মতো। কিন্তু মহাপরিচালক হিসেবে তার চলার পথ মোটেই সহজ ছিল না। প্রথম তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হয়; পরে অপচেষ্টা হয়েছে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার। কিন্তু কোনো কিছুতেই বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় শেষতক তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়ী চক্র। এবং তারা সফল হয়! ইয়াবা চক্র ধরা পড়ার পর তাকে আর সময় না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মাদক ব্যসার উচ্চ মহল।

২০০২ সালের ২৯ ডিসেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো ইয়াবা চক্র ধরা পড়ে। চক্রের উদ্দ্যেশ্য ছিল, হেপি নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ৩১ ডিসেম্বর সকাল থেকে নেশার নতুন আইটেম ওপেনিং করা। কিন্তু এর আগেই হানা দেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রাজধানীর নিকেতনের একটি ফ্লাট থেকে পাচশ’ পিস ইয়াবা ও সাড়ে পাঁচ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার হয় এ চক্রটি, এদের একজনকে একদিন পর ধরা হয় বনশ্রী এলাকা থেকে। গ্রেপ্তারকৃত বাপ্পী-জুয়েল-তমাল-এমরান ধনবান ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাদের কানেকশন ছিলো উপর মহলের সাথে। ধারণা করা হয়, তমালের কানেকশন ছিল অনেক উপরে। সে থাকতো তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পাশের ফ্লাটে; বনানী ডিওএইচএস এলাকায়।

দেশে প্রথম ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় প্রথমে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ইনসপেক্টর এনামকে। কিন্তু তার ভূমিকা সন্দেহজনক বিবেচিত হওয়ায় তাকে পরিবর্তন করা হয়। কিছু দিন পর সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন সে আবাসন খাতে বড় ব্যবসায়ী; মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আরও দুই ইনসপেক্টর চাকরি ছেড়ে রহস্যজনকভাবে ‘সফল ব্যবসায়ী’ হয়েছেন।

ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় এনামকে বাদ দিয়ে আইও নিয়োগ করা হয় হেলাল উদ্দিন ভূইয়াকে। তাকে তমাল বলেছিল, ‘স্যার আমার স্ত্রীর নামে দুইশ কোটি টাকা এফডিয়ার করা আছে। আপনি আমাকে দেখেন, আমি আপনাকে দেখবো।’ ইঙ্গিত ছিল পরিষ্কার। এদিকে মহা-পরিচালক মোহাম্মদ সালাম আবেগের সঙ্গে বলেছিল, “হেলাল, তোমাকে বিশ্বাস করে মামলাটা দিয়েছি।” ইনসপেক্টর হেলাল মহা-পরিচালকের বিশ্বাস রক্ষা করেছিলেন পুরো মাত্রায়। কিন্তু নিজের চাকরি রক্ষা করতে পারেনি মহা-পরিচালক মোহাম্মদ সালাম।

বলা হয়, ইয়াবা চক্র ধরাই কালহয়েছিলো মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর মহা-পরিচালক মোহাম্মদ সালামের জন্য। আর, একই ঘটনার বিরূপ প্রভাব পড়েছে মুজিবুর রহমান হাওলাদারের উপরও। রেগুলার সার্ভিসের কর্মকর্তা হবার কারণে তাকে চাকরি থেকে বিদায় করা যায়নি; তবে অধিদপ্তর থেকে বিদায় করতে সফল হয় মাদক ব্যবসায়ী চক্র। এ ক্ষেত্রে একটি কৌশল অবলম্বন করা হয়। মজিবুর রহমান হাওলাদারকে অধিদপ্তর থেকে বিদায় করে দেয়া হয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং। যাতে তার মধ্যে কোনো রকম ক্ষোভের সঞ্চার না হয়। তবে এ পোস্টিং-এর কিছু দিন পর শুরু হয় আসল খেলা, তাকে হয়রানির পালা। ফলে জনাব হাওলাদারকে বেশ খেসারত দিতে হয়েছে। তিনি একাধিকবার সুপারসিটেড হয়েছেন; এ ধারায় অবসরে যাবার আগে সচিব হিসেবে তার মেয়াদ ছিল মাত্র কয়েক মাস। গত ৩ সেপ্টেম্বর ভূমিসচিব হিসেবে অবসরে গেছে ৮১ ব্যাচের মেধাবী, উচ্চমাত্রায় সৎ ও দক্ষ সরকারি এ কর্মকর্তা। এদিকে মামলায় চার্জসিট প্রদানকারী ইন্সপেক্টর হেলাল ভূইয়াকে রাখা হয়েছে বিভাগীয় প্রসেডিংস ও বদলিসহ নানান হয়রানির মধ্যে। সূত্রমতে, একজন প্রতিমন্ত্রী প্রটেকশন না দিলে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারাতেন হেলাল ভূইয়া।

ইয়াবা চক্রের উপরের দিকের পাইকারি বিক্রেতারা ধরা পড়ার পর মোহাম্মদ সালামকে সরিয়ে দেবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মাদক ডনরা। আর তাকে অপসারণ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সে সময়ে ডিডি (মেট্রো) ডাক্তার আমিনকে। ডাক্তার আমিন আবার কৌশলে ব্যবহার করেছেন ড. জাকিরুল ইসলামকে। সে ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। সেসময় খালিদ নামে এক সাংবাদিকের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মহসীন হলের দোতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। চাকরি জীবনে এরশাদের আমলে টঙ্গীতে সরকারি দলের নেতা হাসান উদ্দিন সরকারকে শারীরিকভাবে হেনস্থা করার জন্য বেশ আলোচিত হয়েছিলেন তিনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পরিচালক (অপারেশন) থাকাকালে গাড়িতে পুলিশের মতো হুটার লাগিয়ে হ্ইুসেল বাজিয়ে চলাসহ তার অনেক ড্রামেটিক কাহিনী থাকলেও আমলা হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগের কথা তেমন চাউর হয়নি। তবে তার বাসায় চুরির ঘটনাটি অনেক গভীর রহস্যের জন্ম দিয়েছিল। ছাত্রদলের সাবেক নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া সরকারের সময় প্রশাসনে ড. জাকিরুল ইসলাম বিশেষ প্রভাবশালী ছিলেন। ফলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (মেট্রো) প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ডা. আমিনের মাধ্যমে সহজসরল ও ডেসপারেট ড. জাকিরুল ইসলামের প্রভাবকে ব্যবহার করে মোহাম্মদ সালামকে বিদায় করতে সফল হয়েছিলো মাদক ডনরা। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফ্যাস্ক বার্তা পাঠানো হয় ২০০৩ সালের ১০ মার্চ; তিনি দায়িত্বে ছিলেন এক বছর ৯ দিন।

রহস্যজনক ক্ষমতা প্রয়োগ করে মহা-পরিচালকের পদ থেকে মোহাম্মদ সালামকে অপসারণের ঘটনা কেবল এক কর্মকর্তাকে বিদায় করার ঘটনা ছিল না, এটি ছিল ইয়াবা ব্যবসায়ী চক্রের জন্য স্পষ্ট ওয়াকওভারের গ্রিন সিগনাল। বিএনপি সরকারের সময় ২০০৩ সালে সেই সিগনালের রথে সওয়ার হয়ে ইয়াবার আগ্রাসন দ্রুত যেখানে পৌঁছেছে তা ভাবলে যেকোনো বিবেকবান মানুষ মাত্রই আঁৎকে উঠবেন। মাদকের আগ্রাসন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বারবার মাদককের আগ্রাসন প্রতিরোধে আদেশ-নির্দেশ-আহ্বান জানাতে হয়। যতবার প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলেন, প্রায় ততবারই বলেন মাদকের বিরুদ্ধে শক্তভাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জঙ্গিবাদের রাস অনেকটা টেনে ধরা সম্ভব হলেও মাদকের আগ্রাসন এখনও থেকেগেছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য। আর বিএনপির সময় ভালো পোস্টিং-এ থাকার ধুয়া তুলে সরকারের অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে ‘খামাখা কোতোয়াল’ (ওএসডি) করে রাখা হলেও ডা. আমিনের মতো কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং-এ থাকতে মোটেই অসুবিধা হয় না! বুঝতে হবে, মাদক ব্যবসায়ী চক্রের হাত অনেক লম্বা, তাদের থিঙ্কট্যাং অনেক মেধাবী।

ছবি: মেজর রফিক মোহাম্মদ সালাম

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, ই-মেইল: e-mail: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :