জাতিসংঘের নিন্দা ও রোহিঙ্গা সংকট

হাসান জাবির
 | প্রকাশিত : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:১৭

রোহিঙ্গা সংকটের জেরে সম্প্রতি জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এধরনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই চলমান সংকট মোকাবেলায় গুরুতবপুর্ন পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ট্রি তার নিজের নাগরিকদের প্রতি বিদ্বেষমুলক তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের এই ভুমিকা খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ। যা রোহিঙ্গা জনগোষ্টির প্রতি বিশ্ববাসির সহমর্মিতা ও সংহতির বহিপ্রকাশ। জাতি সংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই পদক্ষেপের সামগ্রিক গুরুত্ব কতটুকু তা বিশ্লেষন করার আগে বিশ্ব সংকটে নিরাপত্তা পরিষদ তথা জাতিসংঘের ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়ে একটু আলোকপাত করা দরকার। স্নায়ুযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী ইতিহাসের পর্যালোচনা একটি বিষয় খুব দৃরভাবে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে যে সুনিদৃষ্ট সংকটে এই আন্তর্জাতিক সংস্থা বরাবরই বিভক্ত মতামত দিয়ে এসেছেন। মুলত বিশ্ব ব্যবস্থায় বিরাজমান রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জেরে এবং বিশ্ব সংস্থার কার্যকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারনে ইতিহাসের বহু সংকটে এই সংস্থা ঐক্যবদ্ধ ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে ব্যার্থ হয়েছেন। পক্ষান্তরে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় সবার্থে বহু একপেশে ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিন্দিত হয়েছেন অনেক পরাশক্তি। এতদসতবেও কিছু সংকট ছিল বা আছে যেখানে প্রায় প্রতিটি পরাশক্তির সবার্থের লক্ষ অভিন্ন সেখানে জাতিসংঘ নিষ্পত্তিমুলক ও নেতৃস্থানিয় ভুমিকা নিয়ে এই সংস্থার কার্যকারিতা গ্রহনযোগ্যতা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এই নিন্দা প্রস্থাব কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট্রি করবে?

রোহিঙ্গাদের নৃতাত্তিক ইতিহাস নিয়ে নানাধরনের মতভেদ আছে। তাদের আবাস,জাতিগত অবস্থান, সামাজিক জীবন ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে আছে বিস্তর অনিশ্চয়তা। আবার ভু-রাজনৈতিক সমিকরণের নানামুখি জটিলতার কারনে আধুনিক রোহিঙ্গা সংকটের আবেদন বহুমুখি । কেউ ধর্মিয় বাতাবরনে,কেউ মানবিকতা বিবেচনায়,কেউ জিওপলিটিক্যাল ইতিহাসের সুক্ষতা দিয়ে এই সংকট বিশ্লেষন করেন। যেভাবেই বিশ্লেষন করা হোক না কেনো মুল ক্ষতিটা হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্টিরই। নিজদেশে পরবাসি, যাযাবর অমানবিক জীবন কাটছে তাদের। যদিও মূল সমস্যা রোহিঙ্গাদের মৌলিক নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা,তাদের মানবিক জীবন নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনাই। আজো এই জাতিগোষ্ট্রির নাগরিক জীবন, তাদের মৌলিক মানবিক অধিকারের দাবী উপেক্ষিত। পরাশক্তিগুলোর সবার্থদ্বন্দ্ব সহ নানাবিধ কারনে মিয়ানমারের শাসক গোষ্টির এই নিপিরন চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়নাই। কিন্তু বর্তমান ভিন্ন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করতে এই নিন্দা প্রস্থাব গুরুতবপুর্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট্রি করবে।

আধুনিক নেপিডোর সার্বভৌম এলাকা রাখাইন তথা ততসংলগ্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রতি নাগরিক দায়িত্ব পালনের রাষ্ট্রিয় অংগিকার পুরনে বরাবরই ব্যার্থ হয়েছে মিয়ানমার। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গা সংকটে নেপিডো নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে সমস্যার আঞ্চলিক সম্প্রসারন করতে নানাধরনের ছলচাতুরি তথা ইতিহাসের ভুল ব্যক্ষা উপস্থাপন করেছেন। এই নিন্দা প্রস্থাবের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষন করার আগে একটি বিষয় আমি সবাইকে জানাতে চাই যে কিছুটা একঘরে, নিভৃতচারী রাষ্ট্র মিয়ানমার বিষয়ে চীন ছারা বাকী পরাশক্তিগুলোর সবার্থের লক্ষ প্রায় অভিন্ন। সম্প্রতি রুশ সংবাদমাধ্যম স্পুৎনিকের এক বিশ্লেষন এই অঞ্চলের ভু-রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরে রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শক্তিগুলোর সবার্থগত দবন্দের যে খতিয়ান তুলে ধরেছেন তা এখানে প্রনিধানযোগ্য।

মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতি গোষ্টির মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে সবিকার না করে তাদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করেছে দেশটি। নিজের নাগরিকদের প্রতি নেপিডোর এই নেতিবাচক মনোভাব জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক রেজ্যুলেশনের সুস্পষ্ট লংঘন। বিশ্ব শান্তি

থিতিশীলতা,মানবাধিকারের প্রতি বিশ্ববাসীর যে চুরান্ত দায়িত্ব সেই সহানুভুতি ভাতৃত্ববোধের জায়গা থেকে আজকে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের রাষ্ট্রিয় নির্মমতার বিরুদ্ধে জাতি সংঘ প্রস্থাব ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় সুচনার ইংগিত। নিরস্ত্র, নিরিহ রোহিঙ্গা জনগোষ্টিকে রক্ষা করার প্রত্যয়ে জাতি সংঘের ভুমিকা খুবই প্রাসংগিক। এক্ষেত্রে বিশ্ববাসিকে সাথে মিয়ানমারকে চাপ তৈরি করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সর্বশেষ সেনা অভিযানের নির্মম নির্যাতনে অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক জীবনে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্ট্রি করেছে। অন্যদিকে এই ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের মানবিক দৃষ্ট্রিকোন থেকে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রশংসিত হচ্ছেন। জাতি সংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশের এই অবস্থানের ভুয়সী প্রসংসা করেছেন। একই সংগে এই সংকটে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর আন্তরিক সহযোগিতা পাচ্ছেন বাংলাদেশ। অন্যদিকে মিয়ানমারের সংগে দবিপক্ষিয় সুম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে ঢাকার। সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে। এই ধরনের সংকটজনক পরিস্থিতি উত্তরনে জাতি সংঘের সর্বশেষ ভুনিকা খুবই গুরুতবপুর্ন। যা সংকট প্রশমন করে পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

হাসান জাবির: বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :