শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, আত্মঘাতী সাংবাদিকতা আর মুখস্ত ব্রিফিং

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৯

শেখ আদনান ফাহাদ

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে। পাকিস্তানের শক্ত সমর্থক ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদৃঢ় নেতৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সুচারু পরিচালনায়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত লড়াই এবং তৎকালীন ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রয়োজনীয় সামরিক এবং কূটনৈতিক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও পরাজিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রও স্বাধীন হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বঙ্গবন্ধুর বিদেশ সফরগুলো, সে সব সফরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, দেশের নানা জায়গায় জাতির পিতার ভাষণগুলো সবাইকে পড়ার অনুরোধ করছি। বঙ্গবন্ধু বিশ্বনেতাদের মধ্যে কাদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, বিশ্বের বড় বড় নেতাদের মধ্যে কারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, সেগুলো একটু হিসেবে নিলেও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, তাঁর বিদেশনীতি এগুলো নিয়ে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শুধু আমাদের জাতির পিতাই নন, সারা বিশ্বের মজলুমের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একাধিক ভাষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। পাশাপাশি ফিলিস্তিনের অত্যাচারিত মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেছেন।

কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে কী পরিমাণ ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন তা তিনি এক কথায় প্রকাশ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ফিদেলের সে কথা কেয়ামত পর্যন্ত আমাদের মাথা উঁচু করে চলতে অনুপ্রেরণা দিবে। তিনি বলেছিলেন-‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি’!

আলজেরিয়াতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে!’ স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র এবং জাতিগঠন প্রক্রিয়াকে বঙ্গবন্ধু অভিহিত করেছিলেন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে। সে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন-জাতীয়তাবাদ (বাঙালি), ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র-এই চারটিকে। সমাজতন্ত্র বুঝতে গেলে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ বুঝতে হবে। আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীন কিংবা কিউবার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বুঝে ফেললেও বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র বুঝতে পারা যাবে না। যে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে, যুদ্ধ করে সাহায্য করেছিলেন, সে ভারতের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

ওআইসি সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তানও গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন দেশ দিয়েই বসে থাকেননি জাতির পিতা, স্বাধীনভাবে নিজ রাষ্ট্র গোছাতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ এ চীন পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন দিলেও পাকিস্তান আমলে চীন সফরে গিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের জাতীয়তাবোধ দেখে, উন্নত সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন জাতির পিতা। জাতির পিতা সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গেছেন। দীর্ঘদেহী সোভিয়েত ইউনিয়নের লিডারদের সাথে স্বমহিমায় উজ্জ্বল থেকে পাশাপাশি হেঁটেছেন তুষারঢাকা পথের উপর দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর পাশে বিদেশি নেতাদের দেখলে মনে হয়, এমন নেতা আর কোনো দিন আমাদের কপালে জুটবে না। এমন দীর্ঘদেহী, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, এমন সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, এমন দরাজ কণ্ঠের নেতা আর কোনদিন লাখ লাখ মানুষের সামনে সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিয়ে বলবেন না, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। জাতির পিতার রক্ত যার শরীরে তিনি যে একদিন এই বাংলাদেশের প্রধান নেতা হয়ে উঠবেন, সেটি সঠিকভাবে অনুমান করেছিলেন আওয়ামী লীগের মুরুব্বিরা। জাতির পিতার হত্যার সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা এবং ছোট বোন শেখ রেহানা। প্রায় ৬ বছর দুই বোনকে দেশে আসতে দেয়নি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নির্দেশদাতা সামরিক সরকার জিয়াউর রহমান। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি, ১৯৮১ সালে যেদিন শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন, সেদিন নাকি অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল ঢাকায়। বৃষ্টির পানি মনে হয় শেখ হাসিনার চোখের পানি আড়াল করে দিচ্ছিল। সেদিনের সে বাবা-মা-ভাই হারানো মেয়ে আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রধান নেতা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বনেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছ থেকে যিনি উপাধি পেয়েছেন, ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে।

শেখ হাসিনা এমন এক সময় জাতিসংঘে গেলেন, যখন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। মিয়ানমারের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী অং সান সু চির প্রত্যক্ষ সমর্থনে বর্মী সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায় কসাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে মেরে বাকি যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আছে তাদের সবাইকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার কৌশল কাজে লাগিয়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গারা মুসলিম এবং বাঙালি। ফলে আমরা এদেরকে ফেলে দিতে পারব না, একথা মিয়ানমার সরকার জানে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের কিছু বহুজাগতিক কোম্পানিকে ব্যবসা এবং সেনাবাহিনীর কিছু সিনিয়র কর্মকর্তার পকেট ভারী করার সুযোগ দিতেই নতুন করে শুরু হয় এই জাতিগত নিধন। পত্রিকায় খবর এসেছে, লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এই ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছেন। পাকিস্তানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর অফিসারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তিনি। আইএসআই, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং ইসরায়েলের মোসাদ মিলে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামের ভুয়া একটি ‘বিদ্রোহী সংগঠন’ জন্ম দিয়েছে যার সাথে রোহিঙ্গাদের দূরতম যোগাযোগ নেই। রোহিঙ্গারা লাখে লাখে বাংলাদেশের সীমান্তে আসবে, সরকার ঢুকতে দিবে না, দেশে অরাজকতা হবে, সরকার চাপে পড়বে, মিয়ানমারের সাথে সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে ভারত-চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে হিমশিম খাবে, এই ছিল খালেদা জিয়ার পরিকল্পনা।

কিন্তু শেখ হাসিনা যে দেশের মানুষের মনের কথা জানেন, নিজে শরণার্থী ছিলেন বলে শরণার্থীদের কষ্ট বুঝেন, তিনি যে কী পরিমাণ সাহস আর দূরদর্শিতা অর্জন করেছেন, সেটি মনে হয় বুঝে উঠতে পারেননি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। তাই তো তিনি বললেন, ‘দরকার হলে নিজের খাবার ভাগ করে খাব, তবু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেব।’ জাতিসংঘে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তার দেখা হওয়ার বিষয়ে রয়টার্সকে বললেন, যে ব্যক্তি ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের কষ্ট বুঝে না,তার সাথে আমি কী সাহায্য আশা করতে পারি? ট্রাম্প বিষয়ে শেখ হাসিনার এই মূল্যায়ন কত গভীর তাৎপর্য বহন করে সেটি আমরা কতজন বুঝতে পেরেছি?

সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলাম, এদেশের বড় বড় সংবাদমাধ্যম যেভাবে স্টোরিটি কাভার করল তাতে মনে হল, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদে যথেষ্ট অদক্ষতা আছে কোনো কোনো হাউজের। একটি টেলিভিশন বাংলা করেছে- ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাহায্য করবে না।’ অন্যদিকে পররাষ্ট্র সচিব ব্রিফিং করলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র নাকি বাংলাদেশের পাশে আছে’। অদ্ভুত ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনের বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলছেন, ট্রাম্পের কাছে রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো সাহায্য আশা করেন না আর দেশের পররাষ্ট্র সচিব বলছেন’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র’। এই পার্থক্যের কারণ কী?

সংশ্লিষ্ট সকলকে বুঝতে হবে, কূটনীতির মুখস্ত ভাষায় ব্রিফিং করার সময় এখন না। রোহিঙ্গা সংকটে শেখ হাসিনার সরকার পরিষ্কার অবস্থান নিয়েছে। এখানে প্রচলিত ভাষায় মুখস্ত ব্রিফিংয়ে এ কাজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কোনো সাহায্য চাওয়াই আমাদের জন্য অপমানজনক। জাতির পিতার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান আমরা হয়ত ভুলে গেছি। শেখ হাসিনা সরকারের প্রধান হিসেবে কী বলছেন, কী বোঝাতে চাইছেন সেটি বুঝেই আমাদের সাংবাদিকতা করতে হবে। আপনি বিএনপি করেন, জামাত করেন, অসুবিধা নাই। কিন্তু জাতীয় সংকটের সময় রাষ্ট্রের প্রধান নেতাকে বুঝেই আপনার রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। ব্রিফিং দেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে দিতে হবে।

বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গায় শেখ হাসিনা নিজেকে কোথায় নিয়ে গেছেন এটা আমরা বুঝতে পারছি না। চাটুকর আর কট্টর বিরোধীদের পক্ষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিশালত্বকে বোঝা সম্ভব না। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী চাইছেন সেটি আমাদের সকলকে অনুধাবন করতে হবে সঠিকভাবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এমন নেতা আর কেউ নেই এদেশে। শেখ হাসিনা যেভাবে কথা বলেন, যে সাহস উনার আছে, যে অভিজ্ঞতা উনি সঞ্চয় করেছেন, যে প্রভাব উনার একটা কথায় আছে, সেটি এই বাংলাদেশে আমি অন্য কারো মধ্যে দেখি না। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কিছু লেখার আগে, বলার আগে তাই মনোযোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো মন ও মগজ দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক