বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা

অ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহা
 | প্রকাশিত : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:২১

দুর্গাপুজো বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এ পুজো শুধু বাঙালি হিন্দুদের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয়। সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে সর্বজনীন এ দুর্গোৎসবকে ঘিরে সকলের মধ্যে গড়ে উঠে এক সৌহার্দ্য-প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধন।

সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ অশুভ শক্তি পরাভূত করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে চলেছে। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা এ শুভ শক্তিরই প্রতীক। দেবীদুর্গা সকলে দেব-দেবীর সমম্বিতা পরমা শক্তি। অসুন দলনে যিনি চণ্ডী, শরণাগতদের কাছে তিনিই সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-স্বরূপিনী; মঙ্গলদায়িনী জগম্ময়ী মা।

সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল স্তরে এ শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চিরন্তন এ সংগ্রামই মাতৃবন্দনার মূলমন্ত্র। আসুরিক শক্তির দ্বারা নির্যাতিত মানুষ তাই মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। মন্দিরে মন্দিরে দুর্গা মূর্তি স্থাপন করে মাতৃবন্দনায় রত হয়।

দুর্গাপুজো বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, সত্যযুগে রাজা সুরথ রাজ্যচ্যূত হয়ে বনে আশ্রয় নেন। নিকট আত্মীয় ও আমত্যবর্গের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রাজা সামাধি বৈশ্যও বাড়ি ছেড়ে বনে চলে আসতে বাধ্য হন। মহাসংকটে নিপতিত উভয়ই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে ঋষি মেধসমুনির শরণাপন্ন হন। সত্য দ্রষ্টা মুনিবরের পরামর্শে তাঁরা দুর্গতিনাশিনী দুর্গাদেবীর পুজো করেন। তবে এ পুজো বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে এ পুজোকে বাসন্তী পুজো বলে। বাসন্তী পুজোই কালের স্বাভাবিক পুজো। এ পুজোতে বোধন পুজোর প্রয়োজন হয় না।

ত্রেতাযুগে যুগবতার রামচন্দ্র রাবনকে বধ করার জন্য দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। শরৎকালে এ পুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে এ পুজোকে শারদীয় দুর্গোৎসব বলে।

শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, মাঘ মাস থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত এ ছ’মাসকে উত্তরায়ন করেন। এ সময় দেবতাদের একদিন। দেবতারা জেগে থাকেন। শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এ ছ’মাসকে দক্ষিণায়ন করে। এ সময় দেবতাদের এক রাত্রি। তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই দেবতাদের জাগ্রত করে রামচন্দ্র মহাষষ্ঠীতে ষষ্ঠাদিকল্প বা বোধনপুজো করেছিলেন। এ জন্য শারদীয় এ দুর্গোৎসবকে অকাল বোধন বলে। হেমন্ত ঋতুতেও মা দুর্গার আগমন ঘটেছিল। যা’ কাত্যায়নী দুর্গাপুজো নামে খ্যাত।

প্রাচীনকাল থেকেই সনাতন ধর্মের দু’টি ধারা প্রচলিত রয়েছে। একটি বৈদিক ও অপরটি তান্ত্রিক। বৈদিক ধারা ভিত্তি বেদান্ত দর্শন। যার মূলে রয়েছে ব্রহ্মবাদ। আর তন্ত্রশাস্ত্রের মূল ভিত্তি শক্তিবাদ। যার রূপায়ন ঘটেছে শ্রীচন্ডি গ্রন্থে। উভয়ের মধ্যে আপাতঃ দৃষ্টিতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উভয়ই এক ও অভিন্ন। ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড রক্ষা ও নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অপশাসনে অত্যাচারিত জীবের দুর্গতি হরণ করার জন্য দেবী দুর্গা আবির্ভূত হন। দেবতাদের সম্মিলিত তপস্যার জ্যোতি থেকে সৃষ্ট আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা নাম ধারণ করে মর্ত্যলোকে আগমন করেন।

তান্ত্রিক সাধকেরা দেবী দুর্গাকে মাতৃজাতির প্রতীক করুণাময়ী বলে তাঁকে নারী মূর্তিতে কল্পনা করেছেন। আসলে তিনি নারীও নন বা পুরুষও নন। বস্তুতঃ তিনি এক ও অভিন্ন। জীব ও জগতের কল্যাণের জন্য যে রূপ ধারণ করার প্রয়োজন মনে করেন, তিন সেই রূপই ধারণ করেন। মাতৃসাধক শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, তোমরা যাঁকে ‘ব্রহ্ম বলো আমি তাঁকে মা বা ব্রহ্মময়ী বলি। ব্রহ্মময়ী এক ও অভিন্ন’।

বিশ্ব বরেণ্য দার্শনিক ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজী বলেছেন, ‘ব্রহ্মময়ী মহাশক্তিকে আমরা জড় বলতে পারি না। তিনি স্বয়ম্ভু স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যময়ী’। তাঁকেই তো ধর্মচার্যগণ পরমেশ্বর বলে উপাসনা করেন। ঈশ্বর ও ঐশীশক্তির মধ্যে কোন তফাৎ নেই।

বিশ্ব প্রকৃতির অনাদি আদি আদ্যাশক্তি মহামায়া জগজ্জননী দেবী দুর্গা। তিনি কখনও ত্রিভুজা, কখনও অষ্টাভুজা, আবার কখনও দশভুজা হিসেবে আবির্ভূত হন। বস্তুতঃ তিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। তিনিই দেবী দুর্গা। দুর্গাপুজো মূলতঃ শক্তির আরাধনা। দুর্বলের কোন আত্মজ্ঞান হয় না। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য চাই শক্তির সাধনা। ব্রহ্মের পরিপূর্ণতা লাভ করে শক্তিতে। আর শক্তির পরিপূর্ণতার রূপায়ন ঘটে জগৎ সৃষ্টিতে।

বৈদিক মন্ত্রে তাই প্রতিধ্বনি শোনা যায় “সর্বংখলিদ্বয়ংব্রহ্ম” বিশ্বের সবকিছুই ব্রহ্মময়। ঈশ্বর এক, অদ্বিতীয় ও নিরাকার। তবে বিভিন্ন দেব-দেবীও ঈশ্বরেরই অংশ। ঈশ্বরই বিভিন্ন শক্তির ‘প্রকাশ মাত্র’। ভক্ত ঈশ্বরেই প্রতীক। মূর্তিতে তাঁর হৃদয়ের অর্ঘ্য দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে করুণা লাভের চেষ্টাই পুজো বা উপাসনা। পূজারীর আরাধ্য দেবতার মৃম্ময়ী মূর্তি তাঁর মানসলোকে চিম্ময়ী হয়ে ওঠে। তাই মূর্তি পুজো, পুতুল পুজো নয়। মাটির তৈরি মূর্তিকে হিন্দুরা পুজো করে বলাটা সঠিক নয়।

জগতে শক্তির বিভিন্নতা দৃশ্যমান হলেও শক্তি মূলত এক ও অভিন্ন। তন্ত্রশাস্ত্র শ্রী শ্রী চন্ডি গ্রন্থে বিভিন্ন রূপ ভেদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চন্ডি গ্রন্থের তিনটি খণ্ডে তেরটি অধ্যায় রয়েছে। দুর্গতিনাশিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সঙ্গে দোর্দণ্ড দানব অসুরদের সম্মুখযুদ্ধের বিবরণ এতে বিধৃত হয়েছে। চন্ডির প্রথম অংশে রয়েছে মধু-কৈটব বধ; মধ্য খন্ডে মহিষাসুর বধ এবং উত্তর খন্ডে শম্ভু-নিশুম্ভু সংহার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্মের প্রাচীন ঋষিগণ শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তবে উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে প্রার্থক্য আছে। আধুনিক বিজ্ঞান বিশ্বের সকল বস্তুতে শক্তির প্রকাশ অবলোকন করেন। আর প্রাচীন ঋষিগণ বিশ্বাস করতেন সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড একটি মহাশক্তি। এ শক্তিকে বৈজ্ঞানিকগণ মানব কল্যাণে ব্যবহার করেন। আর মুনি ঋষিরা জীব জগতের হিতার্থে শক্তির উপাসনা করেন। আমরা সাংসারিক জীব। আমাদের ভুললে চলবে না দুর্গা পুজো শুধু বাহ্যিক আড়ম্বর অনুষ্ঠানের পুজো নয়। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও শক্তি অর্জন করাটাই পূজোর প্রধান উদ্দেশ্য।

আজ দুর্গাপুজোর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে বহিরাঙ্গের উৎসব ও আয়োজন মুখ্য হয়ে উঠেছে। মানুষ আজ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে জড়বাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। ফলে মানুষ স্বল্প সময়ে জ্ঞানশূণ্য হয়ে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয়ে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছে। সবাই যেন প্রাচুর্য্যের পাহাড় গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ! তাই আজ সমাজজীবন থেকে এ দুর্গতি বিনাশ করার জন্য মা দুর্গার আশীর্বাদ অপরিহার্য। জীবমাত্রেই ঈশ্বরের প্রতীক। আমার অস্তিত্ব ঈশ্বরের অস্তিত্ব। ঈশ্বরের সত্ত্বাই আমার সত্ত্বা। এ দৃঢ় বিশ্বাস মনে রেখে যিনি ঈশ্বরের উপাসনা করেন। তিনিই প্রকৃত ভক্ত ও প্রকৃত সাধক।

তাই আসুন দুর্গোৎসবের এ শুভ দিনে আমাদের প্রার্থনা হোক আমরা সমাজ জীবন থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা ধুয়ে মুছে ফেলি। আশুরিক শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে বিপন্ন মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করি। মনুষ্যত্বের বেদী মূলে দেশ ও জাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যত্নবান হই। মানুষের অহংসত্তার গভীরে যে শ্বাশ্বত বিশ্বজনীন মানব সত্তা লুকিয়ে রয়েছে, তা’ দেবী দুর্গার আশীর্বাদে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রস্ফূটিত করে তুলি। জ্যোতির্ময়ী দুর্গতিনাশিনী জগজ্জননী মা দুর্গা আমাদের সহায় হউন।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ,ফরিদপুর জেলা শাখা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :