বিজ্ঞান পাল্টে দিচ্ছেন ভারতীয় মন্ত্রী-আমলারা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৫৯ | প্রকাশিত : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২১:৫১

বিমান কে আবিষ্কার করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সকলেই হয়তো বলবেন যে বিমানের আবিষ্কারক রাইট ভ্রাতৃদ্বয়।

কিন্তু ভারতের এক মন্ত্রী বলেছেন, এ ইতিহাস ভুল। ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সত্যপাল সিং দাবি করেছেন, বিমানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু পুরাণ রামায়ণে।

‘আর যদি বর্তমান যুগের কথা ধরা হয়, তাহলে বিমানের আবিষ্কারক হলেন শিবাকর বাবুজি তালপাঢ়ে!’

দিন কয়েক আগে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের একটি পুরষ্কার বিতরণী সভায় এক ভাষণে এ কথা বলেন সিং।

তিনি বলছেন, রাইট ভাইয়েদের আট বছর আগেই বিমান আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন শিওয়াকর বাবুজি তালপাঢ়ে।

খোঁজ পড়ে গেছে কে এই তালপাঢ়ে, যিনি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে সম্পূর্ণ 'অজানা'ই রয়ে গেছেন! খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও। কিন্তু মন্ত্রী সিংয়ের ওই মন্তব্য নিয়ে হাসি-মসকরা শুরু হয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যমে।

তবে সত্যপাল সিংয়ের মতেরও বিরোধিতাও আছে ভারতেই। তবে ‘বিমান আবিষ্কার’ বা ‘বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের অবদান’ নিয়ে এরকম দাবি কোন মন্ত্রীর মুখে এই প্রথম নয়।

২০১৫ সালে একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে এক বক্তা জানিয়েছিলেন, বিমানের আবিষ্কার হলেন ভরদ্বাজ নামের এক ঋষি। প্রায় ৭ হাজার বছর আগে তিনি এই ধরাধামে বসবাস করতেন। অর্থাৎ ৭ হাজার বছর আগেই বিমান আবিষ্কৃত হয়েছিল ভারতের মাটিতে!

এখানেই শেষ নয়। বিমানেই থেমে নেই ব্যাপারটা। ভিন গ্রহেও নাকি বিমান পাঠতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা।

অবসরপ্রাপ্ত পাইলট এবং একটি বিমানচালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান ক্যাপ্টেন আনন্দ বোডাস বলেছিলেন, কয়েক হাজার বছর আগে অন্য গ্রহেও বিমান পাঠিয়েছিলেন ভারতীয়রা, সঙ্গে এখনকার থেকে অনেক উন্নত রাডার ব্যবস্থাও ছিল।

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়

এতো গেল বিমানের প্রসঙ্গ। ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঐতিহ্য যে কত মহান আর সুপ্রাচীন, তা বোঝতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতেও 'কসমেটিক সার্জারি'র প্রচলন ছিল। উদাহরণ হিসাবে মোদি তুলে ধরেছিলেন হিন্দুদের দেবতা গণেশের কথা।

‘আমরা ভগবান গণেশের পুজো করি। সেই সময়ে নিশ্চই এমন একজন প্লাস্টিক সার্জেন ছিলেন যিনি একটি হাতি মাথা একজন মানুষের শরীরে লাগিয়েছিলেন। তখন থেকেই প্লাস্টিক সার্জারির প্রচল হয়’- মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি।

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান শিব একটি হস্তিশাবকের মাথা একটি শিশুর দেহে জুড়ে দিয়ে ভগবান গণেশকে সৃষ্টি করেছিলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন গণেশ হলেন প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঘটনা থেকে আবারও প্রকৌশলে ফেরত যাওয়া যাক।

গত মাসে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী একটি অবকাঠামো প্রকৌশল গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে হিন্দুদের ভগবান রামের প্রকৌশল বিদ্যার উদাহরণ দিয়েছিলেন।

হিন্দু পুরাণ রামায়ণে উল্লেখিত আছে, নিজের অপহৃত স্ত্রী সীতাকে শ্রীলঙ্কার দৈত্যরাজ রাবণের হাত থেকে যখন উদ্ধার করে আনতে গিয়েছিলেন, তখন লংকায় পৌঁছানোর জন্য তিনি সমুদ্রের ওপরে একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন।

পক প্রণালী নামে পরিচিত ভারত মহাসাগরের যে সরু ও অগভীর অংশটি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত আর শ্রীলঙ্কার মধ্যে আছে, তারই ওপরে ওই সেতু তৈরি হয়েছিল বলে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী এখনও বিশ্বাস করেন।

আসলে পক প্রণালীর ওই অংশে কিছু পাথরের অবশেষ এখনও দেখা যায়। সেটিকেই সবাই রামের তৈরি সেতুর ভগ্নাবশেষ বলে মনে করে থাকেন।

‘চিন্তা করে দেখুন সেই কোন যুগে ভারত আর শ্রীলঙ্কার মধ্যে সেতু বানিয়েছিলেন ভগবান রামচন্দ্র! তার কাছে কী উন্নত মানের প্রকৌশলীরা ছিলেন সেযুগে। এখনও সেই সেতুর ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়’- বলেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।

প্রকৌশল আর চিকিৎসা বিজ্ঞান হলো, কিন্তু গরু কি না এসে পারে এই বিজ্ঞানমনস্কতার মধ্যে?

বি জে পি শাসিত রাজস্থানের শিক্ষা মন্ত্রী এবছরই জানুয়ারী মাসে বলেছিলেন, ‘গরুর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব কতটা তা বুঝতে হবে। পৃথিবীতে গরুই একমাত্র প্রাণী, যারা অক্সিজেন প্রশ্বাস নেয়, আবার নিঃশ্বাস ছাড়ার সময়েও অক্সিজেনই ফিরিয়ে দেয় প্রকৃতিতে।’

বিজ্ঞানীরা যদিও তখনই আপত্তি তুলেছিলেন বাসুদেব দেবনানী নামে ওই মন্ত্রীর বক্তব্যে। তাদের কথায়, গরু অক্সিজেন নিঃশ্বাস নেয় আবার অক্সিজেনই প্রশ্বাস হিসাবে ছাড়ে, এই কথার কোনও ভিত্তিই নেই।

নেতা-মন্ত্রীরা নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দিচ্ছেন, তো বিচারপতিরাই বা বাদ যান কেন আর প্রজনন বিজ্ঞানই বা পিছিয়ে থাকবে কেন!

তাই কয়েক মাস আগে রাজস্থান হাইকোর্টের এক বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন ময়ূরের প্রজনন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে।

ময়ূরকে কেন জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষণা করা হবে না, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওই বিচারপতি মহেশ শর্মা সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা করেছিলেন যে ময়ূর হচ্ছে একমাত্র ব্রহ্মচারী প্রাণী!

একটি ময়ূরী গর্ভবতী হয় কীভাবে তাহলে?

বিচারপতির যুক্তি, ময়ূর যখন তার চোখের জল ফেলে, ময়ূরী সেই অশ্রু পান করেই নাকি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সেজন্যই ময়ূরের ব্রহ্মচর্য কখনও ক্ষুন্ন হয় না, সে আজীবন কৌমার্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এরকম এক ব্রহ্মচারী পাখিরই জাতীয় পাখির মর্যাদা পাওয়া উচিত ভারতে।

বর্তমানে ভারতের জাতীয় প্রাণী বাঘ। তার বদলে গরুকে জাতীয় পশুর মর্যাদা দেয়ার পক্ষেও সওয়াল করেছিলেন ওই বিচারপতি।

এই সবই তিনি অবশ্য আদালতের বাইরে, নিজের কর্মজীবনের শেষ দিনে, সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন।

সামাজিক মাধ্যমে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল ময়ূরীর গর্ভবতী হওয়ার ওই 'নতুন' পদ্ধতির কথা জেনে।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন ময়ূরের চোখের জল খেয়ে ফেলে ময়ূরী গর্ভবতী হয়ে পড়ার এই কল্পকাহিনী অনেক পুরনো। বহুদিন ধরেই এটা চলে আসছে। অন্য সব প্রাণীর মতোই শারীরিক মিলনের মাধ্যমেই যে 'ব্রহ্মচারী' ময়ূর কোনও ময়ূরীকে গর্ভবতী করে, সেটাই বিজ্ঞান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ভারতের ঐতিহ্য যে কত মহান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পশু বিজ্ঞান - সব কিছুতেই প্রাচীন ভারত যে বাকি পৃথিবীর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল, সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন নানাভাবে।

এর ফলে বিজ্ঞানের বা ইতিহাসে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা এখনই বলা কঠিন, কারণ ওই সব মতামত বৈজ্ঞানিক মহলে মোটেই মান্যতা পাচ্ছে না, তবে সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে হাসির খোরাক হয়ে থাকছে।

সূত্র: বিবিসি

(ঢাকাটাইমস/২৪সেপ্টেম্বর/এসআই)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

কলকাতা হাইকোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ মমতার

ভারী বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার, পালালো শতাধিক বন্দি 

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে ১৩ রাজ্যের ৮৮ আসনে ভোটগ্রহণ শুক্রবার

ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে চায় আর্জেন্টিনা, কিন্তু কেন?

স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, দায়িত্বপালন থেকে বিরত থাকবেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী 

ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: সিরিয়া কি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হবে?

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিবে জ্যামাইকা

পাকিস্তানের পর এবার শ্রীলঙ্কা সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট

বিরল সফরে ইরানে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিদল

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :