রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতীয় কমিশন গঠনের তাগিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৮ | প্রকাশিত : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:১২

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতীয় কমিশন গঠন, আন্তর্জাতিক মিডিয়া ক্যাম্পেইন, বিশ্ববিদ্যালগুলোতে মিয়ানমার সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা, দেশটি সম্পর্কে গবেষণা, দুই দেশের মিলিটারি পর্যায়ে আলোচনা, কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারসহ বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন সাবেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা।

রবিবার ‘মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের কৌশল অন্বেষণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তারা এসব প্রস্তাব দেন।

সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (সিএসডিএস) এর উদ্যোগে রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া কনভেনশন হলে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর তিনটায় শুরু হওয়া আলোচনা শেষ হয় সন্ধ্যা ছয়টায়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে সারা বিশ্বের শক্তিগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা হবে। ভারত ও চীনের সঙ্গে মিয়ানমারে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। গত ১০ দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে এ বিষয়টি তুলে ধরতে পেরেছেন। আমরা পরিকল্পনামাফিক আগাচ্ছি। আমরা রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করছি। এর ফলে কত রোহিঙ্গা বাংরাদেশে আছে সে বিষয়টি ভালো করে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পারবো।’

গওহর রিজভী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু ভুল হয়েছে আমাদের। আমি খুব আত্মবিশ্বাসী আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারবো।’ তিনি বলেন, ‘কেউ রিফিউজি হিসেবে আসতে চায় না। ১৯৭১ সালে আমাদের অনেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের থাকতে দিয়েছি।’

মিয়ানমার সম্পর্কে ভালোভাবে জানার ব্যবস্থা নেই স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোতে এ সম্পর্কে তেমন ধারণা দেয়া হয় না। মিয়ানমারের সঙ্গে শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা না বলে দুই দেশের সিকিউরিটি ও ডেভেলপমেন্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। সমুদ্র যোগাযোগ বিষয়, মিয়ানমার-চট্টগ্রাম-ইয়াংগুন যোগাযোগব্যবস্থা, বেসরকারি পর্যায়ে দুই দেশের নাগরিকদের ভ্রমণ এ বিষয়ও আলোচনা করতে হবে।’

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ চাকমা একটি প্রেজেন্টশন উপস্থাপন করেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাঁচ জন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাদের সেখানে ৩৫০ বছরের ইতিহাস আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল আর বার্মারা জাপানিদের সমর্থন করেছিল। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। এরপর থেকেই তারা বিভিন্ন অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সেলিম আক্তার তার প্রেজেন্টেশনে তুলে ধরেন ভূরাজনৈতিক বিষয়ে মিয়ানমারে গুরুত্ব। তিনি বলেন, ‘চায়না এখানে বড় বিনিয়োগ করছে। তার সহজেই চাইবে না মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যেতে।’ তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে মিডিয়া ক্যাম্পেইন করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান। তিনি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের জন্য থ্রেট হিসেবে অবহিত করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর সৈয়দ রোজেনা রশিদ তার প্রেজেন্টেশনে বলেন, ১৯৭৮ এ নাগমা অপারেশনে দুই লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে, যার বেশিরভাগই ফেরত পাঠানো হয়। মিয়ানমারের সেনা হামলায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯২-তে দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে, এরও বেশির ভাগই ফেরত পাঠানো হয়। এরপর মিয়রনমার সেনা হামলাসহ বিভিন্ন নির্যাতনে ১৯৯৬ তে ১০ হাজার, ১৯৯৭-তে সাত হাজার, ১৯৯৮ থেকে ২০১১-তে তিন লাখ, ২০১২-তে এক লাখ ২০ হাজার এবং এবার ২০০৭ সালে চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

প্রফেসর সৈয়দ রোজেনা রশিদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যাটা আমাদের খুব পুরোনো। অনেক সময় তারা বিভিন্ন আপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। অনেকে সিমান্তে চোরাচালানে সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অশ্রয় নেয়ার ফলে অর্থনৈতিকভাবে সমস্যা দেখা দেয়া, ঘরবাড়ি বানাতে পাহাড় ও বন উজার করার ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয় বলে জানান রোজেনা রশিদ। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ রোহিঙ্গাদের আবার রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের ভোটার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। রোহিঙ্গারা লোকাল সংস্কৃতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি রোহিঙ্গা জনগো্ষ্ঠীর জন্য নিয়ে জাতীয় পলিসি তৈরির পক্ষে মত দেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাফায়েত আহম্মেদ বলেন, ‘মিয়ানমারের চারদিকে ছয়টি দেশ চায়না, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ। তারা ভৌগলিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। চায়না ও রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো, তারা তাদের সাপোর্ট দেয়। আমাদের রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করতে হবে।’

শাফায়েত আহম্মেদ বলেন, ‘অং সাং সু চি সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ ছাড়া সব প্রতিবেশী দেশেই ভিজিট করেছে। কেন বাংলাদেশে আসছেন না সেটা আমাদের ভাবতে হবে। তাকে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গত দুই বছরে কোনো উচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনা হয়নি, কিন্তু তারা আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের ফরেন পলিসি তাদের সঙ্গে কেমন এর থেকেই বোঝা যায়।’

শাফায়েত আরও বলেন, ‘মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের জনগণের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। তাদের দেশ সম্পর্কে আমাদের খারাপ ধারণাই বেশি। মিয়ানমার সম্পর্কে তেমন বই পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালগুলোতে এ বিষয় পড়ানো হয় না বললেই চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি খুঁজে পুরোনো তিনটি বই পাওয়া গেছে মিয়ানমার সম্পর্কে। এ থেকেই বোঝা যায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কী হবে। কোনো ইনস্টিটিউট নেই তাদের সম্পর্কে জানানোর। একজন পিএইচডি গবেষকও নেই মিয়ানমার সম্পর্কে যিনি ভালো ধারণা রাখেন। কিন্তু এটা আমাদের খুবই প্রয়োজন।’

সভাপতির বক্তব্যে সিএসডিএসর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আমসাআ আমিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের জাতীয় কমিশন করতে হবে, সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠন করতে হবে। দুই দেশের মিলিটারি টু মিলিটারি আলোচনা করতে হবে।’

রিটায়ার্ড আমর্ড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েসনের (রাওয়া) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল পিএমসি (অব.) মোহম্মদ ফেরদৌস মিয়া সূচনা বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয় তুলে ধরেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনসহ অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

(ঢাকাটাইমস/২৪সেপ্টেম্বর/জেআর/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :