রোহিঙ্গা শরণার্থী

বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

সদর উদ্দীন লিমন
 | প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:৫১

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে এখন বিশ্ব মিডিয়া তোলপাড়। বিশ্বনেতারাও এ নিয়ে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন দিচ্ছেন, কেউ রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলছেন। আবার কেউ দুই পক্ষকেই সমর্থন দিচ্ছেন। আবার অনেকেই এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তবে বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

প্রথমে একটু জেনে নিই রোহিঙ্গা কারা। রোহিঙ্গা হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী একটি সংখ্যালঘু স¤প্রদায়। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। বর্তমানে রোহিঙ্গা স¤প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ১.১ মিলিয়ন। মিয়ানমারে বসবাস করলেও রোহিঙ্গারা সেদেশের স্বীকৃত কোনো জাতিগোষ্ঠী নয়। ১৯৮২ সালের পর থেকে তারা সেদেশের কোনো নাগরিকও নয়। অর্থাৎ তারা দেশহীন।

ঐতিহাসিকদের মতে, ১২ শতাব্দী থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে। আবার অনেকেই বলেন, আসলে কবে থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করছে তার নির্দিষ্ট সময় বলা কঠিন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য মতে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের ১০০ বছরেরও বেশি সময়কালের শাসনামলে (১৮২৪-১৯৪৮) অনেক শ্রমিক বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত থেকে মিয়ানমারে গিয়েছিল। তখনকার সময়ে এটি ছিল ইন্টারনাল মাইগ্রেশন (অভ্যন্তরীণ অভিবাসন)। কারণ সে সময় ভারতবর্ষের একটি প্রদেশ ছিল বর্তমান মিয়ানমার। স্বাধীনতার পর মিয়ানমার এই অভিবাসীদের ‘অবৈধ’ হিসেবে দেখে আসছে। এরই ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে দেশটি। যারই সূত্র ধরে, সময়ের ব্যবধানে একের পর এক রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। দেশটির দাবি, রোহিঙ্গারা ‘বাঙালি’। এরা তাদের দেশের অংশ নয়।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন আজ নতুন নয়। ১৯৭০ দশক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার ছেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এর হিসাব মতে, ‘গত বছরের অক্টোবর থেকে গত জুলাই পর্যন্ত ৮৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।’

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে এই রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও অনেকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন।

যেখানে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারত রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে সেখানে অপর প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানবিকতা তো এখনো পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যায়নি। একজন বিবেকবান মানুষ তো কারো বিপদ দেখে সাহায্য না করে পারে না। বিপদে কারো পাশে দাঁড়ানোটা দোষের কিছু নয়। তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হতে পারে।

যেমন: ১. নিরাপত্তা সমস্যা। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হতে পারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কারণ এখানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তাদের দিয়ে সুযোগ নিতে পারে।

২. তাছাড়া এখন রোহিঙ্গাদের বাঁচা-মরার লড়াই। আপাতত তাদের খাদ্য মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এখন তাদের মূল বিষয়। তাদের এই চাহিদা যখন পূরণ হবে তখন অন্যান্য চাহিদার অনুভব করবে। শিক্ষা, চাকরি তথা কর্মক্ষেত্র, ইন্টারনেট সুবিধা ইত্যাদি। তখন এগুলো হবে নতুন চ্যালেঞ্জ।

৩. যথাযথ হিসাব না থাকলেও ধরা হচ্ছে বর্তমানে সব মিলিয়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে। কিন্তু আর দশ বা বিশ বছর পরে তো এরা ছয় লাখ থাকবে না। এদের সংখ্যা বাড়বে। এদের বাসস্থানের প্রয়োজন হবে। এরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করবে।

৪. মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের অংশ নয়। তারা বাঙালি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু মিয়ানমার নেবে কি? যদি না নেয় তাহলে তারা কোথায় থাকবে। যদি বাংলাদেশেই থাকে তাহলে ১০০ বছর পর কি এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দাবি করবে?

৫. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভরণ-পোষণ আমাদের টানতে হবে। কিন্তু তারা কোনো কাজের সুযোগ পাবে না। অর্থাৎ বসে বসে খাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বে।

আমরা বর্তমানে এমন এক বিশ্বব্যবস্থায় বসবাস করছি যেখানে প্রত্যেকটি দেশ সার্বভৌম। অর্থাৎ আপনি চাইলে অন্য কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারেন না, হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। অর্থাৎ রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা। এর ওপর অন্য কারো কোনো কর্তৃত্ব নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গঠন করা হয়েছিল জাতিসংঘ। কিন্তু তারও হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। মিয়ানমারে এই রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে হলে এখন প্রয়োজন বড় দেশগুলো একত্রিত হয়ে মিয়ানমারের ওপর ক‚টনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। কিন্তু এই ভ‚মিকাটা নেবে কে? শক্তিশালী দুই প্রতিবেশী দেশই তো রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

সদর উদ্দীন লিমন: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :