অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪৩

আলম রায়হান
| আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:১০ | প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:০১

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘চা’-এর উদ্বেগজনক দাওয়াতের খবর পাওয়ার দুই-তিন দিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলাম। পিআরও ছিলেন মাহফুজুর রহমান। তাকে বললাম, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু তিনি আমাকে মোটেই পাত্তা দিলেন না। তার নামের সঙ্গে একটি অদ্ভূত শব্দ আছে, ‘মলংগি’। এ শব্দের চেয়েও অধিকতর অদ্ভূত আচরণ করেছিলেন মাহফুজুর রহমান মলংগি। যা সাধারণত পিআরওরা করেন না।

বরং পিআরওরা মুখে আন্তরিকতা আর বিনয়ের সাইনবোর্ড লটকে রাখেন, মনে যাই থাক না কেন। পেশার শুরু থেকে এমনটাই দেখে আসছি। তবে সাংবাদিকতায় লেখাপড়া করে যারা বিভিন্ন করপোরেশনের পিআরও হিসেবে যোগ দিতেন তাদের কারো মধ্যে একধরনের উন্নাসিকতা দেখেছি; তবে কখনো তা সীমা ছাড়িয়েছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিআরও মাহফুজ সকল সীমা ছাড়িয়ে গেলেন, সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ দেখলাম তার; একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।

পিআরও মাহফুজুর রহমান মলংগি বললেন, মন্ত্রী তো ব্যস্ত! মনে মনে বললাম, ‘আরে ছাগ শিশু; মন্ত্রী তো ব্যস্তই থাকবে। একেতো মন্ত্রী, তার উপর আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী; সে তো আর ভেরেন্ডা ভাজে না, ব্যস্ত তো সেই থাকবে!’ রাগ চেপে রেখে নাটকীয় বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ভাই আপনি একটু কষ্ট করে বলেন, সুগন্ধার আলম রায়হান দেখা করতে চায়। কিন্তু আমার অতি বিনয়ও জনাব মলংগির মন গলাতে পারলো না। হা বা না- কিছুই বললেন না মান্যবর পিআরও। বরং তিন মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে পেপার কাটিং-এর ফাইলে অধিকতর মনোনিবেশ করলেন, যেনো কাল তার মেট্রিক পরীক্ষা। আর সামনে আমি বসে থাকা এক ‘মফিজ’। হয়তো সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিক বলে সে আমাকে পাত্তা দিচ্ছিল না; বা সে আমাকে সাংবাদিকই মনে করেনি। অথবা সকলের সঙ্গেই এ রকম আচরণ করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর আমার দিকে তাকালেন। তার চেহারায় বিরক্তি স্পষ্ট, যেন তিনি ছাড়পোকায় ভরা চেয়ারে বসে আছেন! চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ইন্টারকমে আমার কথা মন্ত্রীকে জানালেন। এটি করেছিলেন তার সামনে থেকে আমাকে ভাগাবার কৌশল হিসেবে। কিন্তু ঘটলো উল্টো। রিসিভার হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে গেলেন মাহফুজুর রহমান মলংগি; বললেন, ‘চলেন আলম ভাই; স্যার যেতে বলেছেন।’ সে চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মতো ছুটছিল মন্ত্রীর রুমের দিকে। আমি যাচ্ছিলাম গজেন্দ্র চালে, ইচ্ছে করেই। আমার বেশ মজা লাগছিল, সরকারি কর্মকর্তার আচরণে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন; সে এক নির্মল বিনোদনের আইটেম; গত ঈদে একক এক আলোচিত সঙ্গতানুষ্ঠানের মতো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক নানান জটিল ফাইলের পাশাপাশি পত্রিকার কাটিংও মনোযোগ দিয়ে দেখতেন। এজন্য পিআরও মাহফুজকে ১৮টি ফাইল ম্যান্টেন করতে হতো। ফলে তার উপর চাপ বেড়ে গিয়েছিল। এজন্যই হয়তো তিনি পিআরও’র ইনবিল্ড বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। অথবা ইচ্ছে করেই ভাব ধরেছিলেন; কাকের ময়ুউর পুচ্ছ পরার মতো। মাসকয়েক আগে মাহফুজুর রহমান উপ-প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে গেছেন।

সেদিন প্রথমবাবের মতো মুখোমুখি হলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকের। খুবই ধীরস্থির স্বভাবের সাদামাটা আন্তরিক মানুষ। অনেকক্ষণ কথা হলো প্রথম দিন। এদিকে সে বিষয়ে একটি জবাব দেবার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম পরীক্ষার আগের রাতে প্রস্তুতির মতো। কিন্তু তা কোন কাজে এলো না। কারণ তিনি সুগন্ধায় প্রকাশিত খবরের ধার দিয়েও গেলেন না। এদিকে প্রথম দর্শনেই তাকে খুবই পছন্দ হয়েছিল আমার; প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার মতো। এরপর প্রায়ই যেতাম তার কাছে। অনেক গল্প হতো। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার জীবনযুদ্ধের অনেক গল্প। এক পর্যায়ে জানলাম, আমি যা লিখেছি তা খণ্ডিত সত্য। আর খণ্ডিত সত্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা খবর হয়েছে সত্যের চূড়ান্ত অপলাপ। এজন্যই বলা হয়, আংশিক সত্য কখনো কখনো সম্পূর্ণ মিথ্যার চেয়ে ভয়ানক হতে পারে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকের সঙ্গে আমার সম্পর্কের মাঝ থেকে মন্ত্রী ও সাংবাদিকের আনুষ্ঠানিকতার দেয়াল দ্রুত উঠে গেল। তার সঙ্গে অনেক গল্প হতো সচিবালয়ে। সবমিলিয়ে মেজর রফিকের কর্মপদ্ধতি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এ সময় দেখেছি একজন মন্ত্রী কতটা নিমগ্ন হয়ে ফাইল দেখতে পারেন; ঠিক গোজামিলের জায়গায়ই তার চোখ আটকে যেত। আবার ফাইল দেখার ফাঁকেই তিনি নানান বিষয়ে কথা বলতেন; নানান ধরনের ভিজিটরদের সময় দিতেন। তদবির শুনতেন, আবার তদবির প্রত্যাখ্যান করার কঠিন কাজও করতে পারতেন অতি সহজে। একবার খুবই বিরক্তিকর একটি তদবির করতে দেখেছি কর্নেল শওকত আলীকে। তিনি খুলনার এক ব্যবসায়ীর জন্য পিস্তলের লাইন্সের জন্য তদবিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশি রিপোর্ট ছিল খুবই নেগেটিভ। তবুও কর্নেল শওকত বারবার অনুরোধ করছিলেন এ লাইসেন্স দেবার জন্য। চাকরিতে সাবেক সিনিয়রকে কিছুতেই বুঝাতে পারছিলেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ অবস্থায় মেজর রফিক বললেন, ঠিক আছে আবেদনে আপনি সুপারিশ করে দেন! বলাবাহুল্য, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার গর্বিত আসামি কর্নেল শওকত আলী নিজের ঘাড়ে দায়িত্ব নেননি। ২০০৮-এর সংসদের তিনি ডেপুটি স্পিকারর হয়েছিলেন। এতে তিনি সন্তষ্ট ছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার হওয়ায় কর্নেল শওকত আলী বেশ মনোকষ্টে পড়েন।

হজে গিয়ে ভিড়ের চাপে পড়ে যাওয়া একজনকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক। এজন্য চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা সিএমএইচ-এ অনেক বার যেতে হয়েছে। এ সময় বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে গিয়েছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল, তার স্মৃতি থেকে নানান ঘটনার বিষয়ে জানা। মাঝেমধ্যে তিনি ডিএমপির থানা পরিদর্শন করতেন। থানায় যেতেন নীরবে; অনেক সময় চলে আসার পর জানাজানি হতো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন। এ সময় একাধিকবার আমাকে নিয়ে গেছেন। একবার যশোর-খুলনা সফরের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। তার কথা শুনে এপিএস মাহবুবের তো ‘খিস খাবার’ অবস্থা। সে গাইগুই করে বললো, তা হলে আলম ভাই যশোরে গিয়ে থাকুক; সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। মন্ত্রী বললেন, ‘না, ঢাকা থেকে আমাদের সঙ্গে যাবে; আমাদের সঙ্গে আসবে।’ এতে এপিএস মাহবুব খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ বেতারের স্টাফ হয়েও মাহবুব একাধিক মন্ত্রীর এপিএস হিসেবে কাজ করেছেন। তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ- তিন সরকারের আমলেই মন্ত্রীর এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সুবিধা করতে পারেননি। উল্টো সে সময় মিরপুরের বাড়ি নিয়ে তাকে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তার কাছে এরশাদের মন্ত্রী কোরবান আলীর এক মজার গল্প শুনেছিলাম।

আওয়ামী লীগের ত্যাগী প্রবীণ নেতা কোরবান আলী জীবনের গোধূলীলগ্নে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের ফাঁদে ধরা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। নিজ এলাকা মুন্সীগঞ্জের এক যুবকের উপর নব্য এ মন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে ধাওয়া করতে করতে রুম ছেড়ে লবিতে বেরিয়ে পড়েছিলেন; লবিতেও ধাওয়া করেছেন। মন্ত্রীর অদ্ভূত এ আচরণে সবাই অবাক। পরে জানা গেল, ধাওয়া খাওয়া ব্যক্তিটি পাটমন্ত্রী কোরবান আলীকে একটি কাজের বিনিময়ে এক লাখ টাকা দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল। উল্লিখিত যুবকটিকে কোরবান আলী আগে থেকে চিনতেন। তাকে ধাওয়া করতে করতে কোরবান আলী বলছিলেন, ‘তুই এক লাখ টাকা কোথায় পাবি, ফকিরের বাচ্চা!’ বেচারা কোরবান আলী, এরশাদের মন্ত্রী হয়েও দালালির সঙ্গে তার তখনও ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়নি। অবশ্য শেষতক তার এ অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল কি না তা জানা যায়নি। তবে তিনি বেশি সময় পাননি। এরশাদের ক্যাবিনেট থেকে বাদ পড়ার আগেই জাগতিক জীবনের খাতা থেকে তার নাম কাটা যায়: চলে যান না ফেরার দেশে।

নির্ধারিত দিনে বিমানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকের সঙ্গে যশোর গেলাম। পরে সড়ক পথে খুলনায়। ঢাকা ফিরেছিলাম সড়ক পথে। সম্ভবত ছিল তিন দিনের ট্যুর। নৌ-পথ ছাড়া অন্য কোনো যাত্রা আমি মোটেই উপভোগ করি না; আরও পরিষ্কার করে বলা চলে, বিরক্তি লাগে! এ কারণে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যেতে চাইনি। কিন্তু পরে বুঝেছি, সেদিন না গেলে হয়তো একজন মন্ত্রীর সাফল্যের চাবিকাঠি সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত। এদিকে খুলনায় সেদিন সাংবাদিক মহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও আমি ছিলাম বেশি আলোচ্য। আমাকে নিয়ে বেশ কানাঘুষা হয়েছে। বিভাগীয় শহরের সাংবাদিক মহলের বিস্ময়ের প্রশ্ন ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী কারণে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিককে একমাত্র সফরসঙ্গী করেছেন! এ বিষয়টি পরে সাংবাদিক শাহীন রহমানের কাছে শুনেছি। খুলনার সন্তান শাহীনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল সুগন্ধায়, তখন সে খুলনার সাংবাদিক; এখন সে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এবং একটি অনলাইন পোর্টালের মালিক।

ছবি: মেজর রফিক

লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক; ইমেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :