কুকুর-বিড়ালের রবিনহুড!

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১২:১২

মানুষ শখ করে কুকুর-বিড়াল পালে একটা কি দুটো। তাই বলে ৪২টা? এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? আফজাল খানকে চিনলে হয়তো এরকমটা মনে হবে না আপনার। রাস্তাঘাটের কুকুর বেড়ালের কষ্ট দেখলে তার মন পোড়ে। এদিক ওদিক থেকে কষ্টে থাকা কুকুর বিড়াল উদ্ধার করতে করতে তার ঘর এখন কুকুর বেড়ালের রাজত্ব। সব মিলিয়ে ৪২টি কুকুর এবং বিড়াল আছে আফজাল খানের। নিজেই নিজের নাম দিয়েছেন কুকুর বেড়ালের রবিনহুড।

তরুণ এই টিভি অভিনেতার ঘরে আশ্রয় পাওয়া এসব পোষ্যদের বেশিরভাগই রাস্তায় দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে থাকা কিংবা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা। নিজের আয়ের বড় একটা অংশ ব্যায় করেন তার চার পেয়ে সঙ্গী সাথীদের খাবার, চিকিৎসা ইত্যাদির পেছনে। অথচ একটুও গায়ে লাগে না, তার কারণ রাস্তার কুকুর বিড়ালের প্রতি তার রয়েছে বিস্তর মায়া, আছে অগাধ ভালোবাসা। আফজাল খান জানালেন ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইচ্ছে ছিল রাস্তার অসহায় প্রাণীদের জন্য কিছু করবার। তখন করা হয়নি, এখন বড় হয়ে নিজের অজান্তেই অবলা এ জীবদের বন্ধু হয়ে উঠেছেন তিনি। 'রবিন হুড দ্যা এনিমেলস রেসকিউয়ার' নামে একটা ফোসবুক পেজ আছে তার। সেখানেই তার নানান কাজের খবর পাওয়া যায়।

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার তিলপাপাড়ায় বসবাস আফজালের। বাবা পেশায় ব্যবসায়ী। ছোটবেলা বাড়িতে বানর পালতেন, বিড়াল পুষতেন। যদিও পরিবারের সবাই খুবই একটা ভালো চোখে দেখতো না তার পশুপ্রেমকে। অবশ্য বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন বলে পরিবারের লোকজন খুব একটা ঘাটাতো না তাকে।

২০১৫ সালে আফজাল বাড়িতে শুরু করেন রাস্তায় আহত পশু পাখিদের দেখভাল। গাড়িতে আহত অথবা মানুষের দ্বারা নির্যাতিত কুকুর বিড়াল তিনি নিজেই উদ্ধার করে বাড়ি আনেন। সেগুলোকে চিকিৎসা, সেবা-যত্ন করে লালন পালন করে নিজের ঘরেই রাখেন তিনি।

আফজাল বলেন, ‘অনেক আগে থেকে কুকুর-বিড়াল পোষার শখ ছিল। কিন্তু কখনো ভাবিনি সেগুলোকে বাড়িতে এতো বড় পরিসরে লালন-পালন করতে পারব। ২০১৫ সালে আমি আহত প্রাণীদের কিভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হয় সেটার মোটামুটি ধারণা পাই। এরপর থেকে পুরো দমে কাজ শুরু করি।’

তার বাড়িতে এখন বিভিন্ন ভাবে আহত হওয়া ৯টি কুকুর ও ৩৩টি বিড়াল আছে। যেগুলো তার ঘরেই থাকে। এই সব কটি প্রাণী কোনো না কোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে।

আফজালের এই পশুপ্রেমের জলজ্যান্ত সাক্ষী তারই বোন তাইয়েবা নাসরীন রাকা। ভাইয়ের দেখাদেখি অবশ্য তিনিও বাড়ির কুকুর- বিড়ালগুলোকে আপন করে নিয়েছেন। আফজালের অবর্তমানে সেই কুকুর বিড়াল গুলোকে খাবার খাওয়ানো, ঔষধ খাওয়ানোসহ বিভিন্ন দেখভালের কাজ করেন রাকা। ঢাকাটাইমসকে বললেন, ‘ভাইয়ের দেখাদেখি কুকুর-বিড়ালদের দেখাশোনা করি। ভাইয়া অনেক সময় ওদের জন্য রাস্তার লোকজনের সাথে মারপিটও করে। এমনকি চলার পথে কোনো কুকুর কিংবা বিড়াল আহত অবস্থায় পড়ে আছে দেখলে ওদেরকে নিজের দায়িত্বে হাসপাতালে নিয়ে যায় ভাইয়া। প্রায়োজন মাফিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতেই সেগুলোকে আশ্রয় দিই আমরা।’

আফজালের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, পাঁচতলা বাড়ির দুটো রুম ও বারান্দায় তারা পালা কুকুর বেড়লাদের বসবাস। রুমে ঢুকতেই দেখা গেল কয়েকটি বিড়াল আফজালের বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন। কয়েকটা বিড়াল ঘরের এখানে-ওখানে খেলায় মগ্ন। বিছানা, আলমারির ছাদ সবটাই ওদের দখলে। এমনকি খাটের নিচেও পাওয়া গেলো কয়েকজনকে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রাণীর মেরুদণ্ড ভাঙা, কারো কারো চোখ অন্ধ। এক মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে আরেক মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে। এর মধ্যে একটি বিড়াল আছে যেটাকে সাত তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। নিচে পড়ে বিড়ালটার মেরুদন্ড ভেঙে যায়। নিজে থেকে আর চলতে পারেনা সে। জানাগেলো এই বেড়ালের খাওয়া, ঘুম, গোসল, মল-মূত্র ত্যাগ করনো, সবকিছুই আফজাল নিজের হাতে করেন।

আফজাল বলেন, ‘এই কুকুর বিড়ালের জন্য প্রতিমাসে চার মণ মুরগির মাংস, ১০০ টা ডিম, সাত কেজি চাল, ৫০ লিটার দুধ লাগে। কয়েক রকম ওষুধ আর ইনজেকশন লাগে। সকালে ডিম ও বিকালে দুধ দেওয়া হয় বেশির ভাগ দিন। আর দুপুরবেলা ও রাতে ভাতের সাথে মুরগির মাংস মিশিয়ে ওদের জন্য বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। আর খাওয়ানোর এই বিশাল দায়িত্বটা পালন করে আমার ছোটবোন রাকা।’

বাজারের এই ফর্দ শুনে প্রথমেই যে কথাটা মাথায় আসে তা হলো এতো টাকা তিনি কি করে যোগান দেন তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে আফজাল হেসে বলেন, ‘ আমি টিভিতে অভিনয় করে যা পাই তার সবটাই ওদের পেছনে খরচ করি। তবে এখন খরচ আরো বেড়েছে। কারণ সরকারি পশু হাসপাতালগুলোতে গরু, ছাগল বা অন্যান্য গৃহপালিত প্রানীর চিকিৎসা বা ওষুধ পাওয়া যায় কিন্তু কুকুর বিড়ালের কোন ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয়। আর তাতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়।’

এই বোবা প্রাণীদের যাদে কেউ না মারে, অত্যাচার না করে সেজন্য আফজাল আরো অনেক অনেক কাজ করতে চান। তার মধ্যে একটা বড় পরিকল্পনা তার, শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জন সচেতনা বাড়ানোর জন্য একটি দল তৈরি করবেন। যারা মানুষকে বোঝাবে রাস্তার কুকুর-বিড়াল কারও শত্রু নয়। এছাড়া রাজধানীর হোটেলগুলোতে প্রতিদিন যে খাবার ফেলে দেওয়া হয় সেগুলো যাতে কোনো একটা নিদৃষ্ট জায়গায় ফেলা হয় সেজন্যও ঘুরে ঘুরে কাজ করতে চানা তিনি। আফজাল চান তার দলের সদস্যরা যেন সেসব খাবার সংগ্রহ করে রাস্তার কুকুর, বিড়াল, কাকসহ বিভিন্ন পশু পাখিকে খেতে দিতে পারে।

এদিকে রাজধানীতে সিটি করপোরেশন কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ ও জলাতঙ্ক টিকা না দিয়ে কুকুর হত্যা করা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি আছে আফজালের। তার মতে কুকুর মানুষের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্বস্ত বন্ধু, আর এভাবে কুকুর হত্যা করাটা আদালত অবমাননার শামিল। কারণ ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে এরকম নৃশংস উপায়ে কুকুর নিধন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত।

তিনি বলেন, ‘আমি এরকম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছি, প্রতিবাদ করেছি। আশা করি সরকার এরকম নৃশংসভাবে কুকুর নিধন বন্ধ করবে।’

(ঢাকাটাইমস/০৩অক্টোবর/সিসা/কেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :