নিজের যে অসুখ গোপন রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:২০

‘গণতন্ত্র’ ও ‘মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার নামে পৃথিবীর সব দেশে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নাক গলায় যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার মত বহু সমৃদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস করতেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আমাদের অজানা নয়। অথচ নিজের সমাজে আজ পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ‘গায়ে মানে না, আপনি মোড়ল’ যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় ভয়াবহ সন্ত্রাসের উপস্থিতি। জুয়ার শহর বলে পুরো বিশ্বে পরিচিত লাসভেগাসের একটি কনসার্টে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী স্টিফেন পেডকের হামলায় কমপক্ষে ৫৯ জনের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসপ্রবণ সমাজের চিত্র বের হয়ে এসেছে।

স্টিফেন পেডককে সন্ত্রাসী বলছে না মার্কিন এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিডিয়া। শুধু এই ঘটনায় নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নানা স্থানে সংঘটিত প্রতিটি হামলায় হামলাকারীকে মিডিয়া কৌশলে ‘বন্দকধারীর গুলি’ কিংবা ‘সহিংস হামলা’ বলে প্রচার করে থাকে। এ কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সন্ত্রাস-জর্জরিত রাষ্ট্র বলে উপস্থাপিত হতে দিতে চায়না। যে কারণে মিডিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলাগুলোর কোনো ফলোআপ নিউজ প্রায় দেখায় যায় না। কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাসভেগাসের সন্ত্রাসী হামলা ১৯৪৯ সালের পর হতে সংঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক।

এর আগে ২০১৬ সালের ১২ জুন অরলান্ডোতে পালস নাইটক্লাবে এক সন্ত্রাসী হামলায় ৪৯ জন নিহত হয়। মার্কিন নাগরিক ওমর মাতিন সমকামীদের সেই ক্লাবে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ২০০৭ সালের এপ্রিলে মার্কিন নাগরিক হুই চো ভার্জিনিয়া প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা চালালে ২৭ জন ছাত্র এবং পাঁচ শিক্ষক মারা যায়। বিশ বছর বয়সী অ্যাডাম লানজা নামের আরেক মার্কিনি ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে কানেক্টিকাটে স্যান্ডি হুক ইলিমেন্টারি স্কুলে নিজের মাকে হত্যা করার আগে ২০ শিশু এবং ছয়জন প্রাপ্ত বয়স্ককে হত্যা করে। ১৯৯১ সালে টেক্সাসে এক রেস্টুরেন্টে ৩৫ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক জর্জ হেনার্ড সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ২২ জনকে হত্যা করে।

ক্যালিফোর্নিয়াতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন নাগরিক রিজওয়ান ফারুক এবং তার স্ত্রী তাসফিন মালিক একটি অফিস পার্টিতে হামলা চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করে। ওই হামলায় ২২ জন আহত হয়। ২০০৯ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর অফিসার নিদাল হাসান সামরিক ঘাঁটিতে গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনায় আহত হয় ৪২ জন। মার্কিন নাগরিক অ্যারন এলেক্সিস ওয়াশিংটন নেভি ইয়ার্ড হেডকোয়ার্টারে হামলা চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কদিন পরপরই স্কুল, মার্কেট বা খোলা জায়গায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। অনেক বড় ঘটনা ঘটলেই কেবল নিউজ হয়। তবে ফলোআপ না হওয়ার ফলে আমাদের মগজে এর স্মৃতি থাকে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে কানেক্টিকাট থেকে প্রতিনিধিত্ব করা ডেমোক্র্যাট ক্রিস মারফি ওয়াশিংটন পোস্টে এক নিবন্ধে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ম্যাস শুটিং (গণ-গুলি) একটি আমেরিকান সমস্যা। এর আমেরিকান সমাধানও আছে। সোমবার আমাদের জীবনে আরেকটি বেদনাদায়ক দিন। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা দেখা যায় না’।

নিউজউইক লিখেছে, ২০১৭ সালের ২৭৫ দিনের মধ্যে লাসভেগাসের ঘটনাটি ছিল ২৭৩তম সন্ত্রাসী হামলা। তার মানে প্রায় চলতি বছর প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন গণ-গুলির ঘটনা ঘটেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮৮.৮ শতাংশ মানুষের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। আরও শিউরে উঠবেন যখন জানবেন যে, বন্দুক সন্ত্রাসের ফলে ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১ হাজার ৬০০ জনের প্রাণ গেছে। ৯/১১ খ্যাত নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে নিহতের চারগুণ বেশি মানুষ এসব সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছে। ২০১৬ সালের মত বন্দুক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল ৩৮৩টি, যাতে নিহত হয় ১৫ হাজার মানুষ। বন্দুক সন্ত্রাসের সংখ্যা এবং মানুষের মৃত্যুর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে তাই এক নম্বর রাষ্ট্র।

পেডিয়াট্রিকস নামের জার্নালের বরাত দিয়ে নিউজউইক জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর গড়ে ১,২৯৭ শিশু বন্দুকসন্ত্রাসে প্রাণ হারায়। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এর এক রিপোর্টের বরাত দিয়ে নিউজউইক যে সংখ্যা উল্লেখ করেছে সেটি আরও ভয়াবহ। এখানে বলা হয়েছে, বন্দুক-সন্ত্রাস জনিত কারণে প্রতিবছর ৩৩ হাজার মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হল বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার সেন্টারের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক বর্তমান আগ্নেয়াস্ত্র নীতি সাপোর্ট করে। বিশেষ করে রিপাবলিকানদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নীতি সাপোর্ট করা সংখ্যা বেশি। আর হোয়াইট হাউস আর কংগ্রেস এখন রিপাবলিকানদের প্রাধান্য। রিপাবলিকানদের মধ্যেই অনেকে বড় বড় অস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িত। রিপাবলিকানদের মধ্যে ইহুদিদের আধিপত্য সর্বজনবিদিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটা কথা বলা হয়-‘এখানে আপনি ঈশ্বরের সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু ইসরায়েলের নয়’। সিআইএ এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদে তাই ইহুদি অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অনেক প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের নানা অঞ্চলে তাই অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র সরবরাহ কমে গেলে ব্যবসায় ধ্বস নামবে। তাই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের অস্ত্রনীতি বদলাতে পারে না। তদ্রুপ পৃথিবীর নানা বিদ্রোহী কিংবা জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছেও অস্ত্র বিক্রি করে বিশাল মুনাফা হয় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একটি আগ্রাসনপ্রবন রাষ্ট্র। সর্বশেষ আমাদের প্রতিবেশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট তৈরিতেও সিআইএ এবং মোসাদের নাম এসেছে।

তবে নিজ দেশের এই সন্ত্রাস-অসুখ এবং পুরো পৃথিবীতে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়ার অপপ্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা বিশ্ববাসীকে জানতে দিতে নারাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিউজের মধ্যে এমন সব শব্দ ব্যবহার করা হয় যাতে সন্ত্রাসীর আসল পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়। যেমন ধরুন লাসভেগাসে হামলাকারী স্টিফেন পেডক কোন ধর্মের সেটি চট করে আপনি বলতে পারবেন না। স্টিফেন হিন্দু, মুসলিম বা বৌদ্ধ নয়, এটি বোঝা যাচ্ছে। তার মানে, সে হয় খ্রিস্টান বা ইহুদি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত করে এটি বলতে পারব না, কারণ পশ্চিমা মিডিয়া এই সন্ত্রাসীর ধর্ম পরিচয় বেমালুম গায়েব করে দিয়েছে। যদি মোহাম্মদ বা আহম্মদ থাকত নামের সাথে, তাহলে তাকে বলা হত মুসলিম সন্ত্রাসী, ইসলামি সন্ত্রাসী।

যেসব হামলায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যায়, সেগুলোকে সন্ত্রাসী হামলা বলে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লন্ডনেও যদি কোনো ননমুসলিম সন্ত্রাসী হামলা করে তাহলে দেখবেন, বলা হয় সহিংস হামলা, বন্দুকধারীর হামলা। কিন্তু যদি মুসলিম হয়, বলা হবে মুসলিম সন্ত্রাসী, জিহাদি কিংবা ইসলামি জঙ্গি ইত্যাদি। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অবস্থান শক্ত করার জন্য এবং বিশাল খনিজ সম্পদের দখল নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল মিলেমিশে তৈরি করেছে আইএস নামের একটি জঙ্গি সংগঠন। দেশে দেশে এদের এজেন্ট আছে। সিআইএ এবং মোসাদের এজেন্টরা হামলা পরিচালনা করে। আইএসের নামে ওয়েবসাইট পরিচালনা করে। দরকার মত হামলা চালিয়ে বিবৃতি দিয়ে দেয় আইএসের নামে। পরিবার বিচ্ছিন্ন, হতাশ, আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক মুসলিম ছেলে-মেয়েদেরকে এরা রিক্রুট করে। জিহাদের করে বেহেশতে থাকার লোভে অনেকে সে পথে পা বাড়ায়।

মোল্লাদের ছদ্মবেশে অনেকে আপনার আমার আশপাশে কাজ করে। আইএস এবং আল-কায়েদার মত নেটওয়ার্ক থাকায় এরা পুরো মুসলিম সমাজকে সন্ত্রাসবাদী বলে পরিচয় করিয়ে দিতে সহজ হয় এদের। এজন্যই সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায় দেখবেন, রাজনৈতিক বা ভাবাদর্শগত কোনো উদ্দেশ্যে পরিচালিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাসবাদ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এক সময় ছিল আল-কায়েদা। ওসামা বিন লাদেন ছিল বুশ পরিবারের অন্যতম ব্যবসায়িক পার্টনার। আল-কায়েদার অফিস কোথায় ছিল কেউ জানত না। তদ্রুপ আইএসের অফিস কোথায়, প্রশিক্ষণ হয় কোথায় কেউ জানে না। যে কোন হামলা হলে আইএস তাদের স্বীকারোক্তি পাঠায় ইহুদী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টিলিজেন্সে। সাইট ইন্টিলিজেন্স থেকে নিউজ প্রচার করে বিবিসি, সিএনএন এর মত বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা এমন প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। বিদেশি মারা গেছে দিনাজপুরে। কিন্তু আইএস এর স্বীকারোক্তি পাঠিয়েছে ওয়াশিংটনে। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে নিউজ প্রচার করেছে আমাদের মিডিয়া। এদের জন্ম হয় অনলাইনে, মৃত্যুও হয় অনলাইনে।

তবে সন্ত্রাসী স্টিফেনের হামলায় আইএস এর স্বীকারোক্তিও ডিফেন্ড করতে পারছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আইএস বলেছিল, স্টিফেন নাকি কদিন আগে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল! এমন একটি নিউজ প্রচার করেও শেষ পর্যন্ত চুপ মেরে গেছে মার্কিন মিডিয়া। কারণ তাহলে স্বীকার করা হয়ে যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আইএসের উপস্থিতি আছে। নিজের দেশে অপকর্ম ঢাকতে আরেকটি কৌশল কাজে লাগায় পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, নিজ দেশের সন্ত্রাসীদের যুক্তরাষ্ট্র মানসিক ভারসাম্যহীন বলে চালিয়ে দিয়েছে। নরওয়েতে হামলা করেছিল লর্ড ব্রেইভিক নামের এক খ্রিস্টান সন্ত্রাসী। তাকেও শেষ পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন বলে প্রচার করে ঘটনা আড়াল করে ফেলে পশ্চিমা মিডিয়া। ছিনতাই, ধর্ষণ, পকেটমার, হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের সব শহরে নিয়মিত ঘটনা। অথচ এ চিত্র আমরা কয়জন জানি?

যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের মনে যে উপনিবেশ তৈরি করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে, তার অবসানের দরকার আছে। বিদেশ সম্পর্কে যত জানবেন, তত বেশি আবিষ্কার করবেন নিজেকে। নিজেদের সবসময় অসুখী ভাবার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিদেশ সম্পর্কে আমাদের জানা অতীব প্রয়োজন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :