জার্মানিতে উগ্রবাদ এবং উদারপন্থার ভবিষ্যৎ

মোহাম্মদ জমির
| আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:১২ | প্রকাশিত : ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:১০

জার্মানিতে চতুর্থবারের মতো চ্যান্সেলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। কিন্তু এবারের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই আঁচ করা যায় তার ভোট কমছে। আগের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি। তার দল পার্লামেন্টে প্রধান দল হিসেবে টিকে আছে ঠিকই। তারপরও ভোটের হিসাবে দেখা যায়, দেশটিতে ডানপন্থা তথা উগ্রবাদীরা ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে। জনসমর্থন তাদের ক্রমাগত বাড়ছে। এতে করে উগ্র জাতীয়তাবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার ঝুঁকি আবার দেখা দিতে পারে, যা আমাদের হিটলারের সময়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

এবারের নির্বাচনে জার্মান পার্লামেন্টে কট্টর ডানপন্থি দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের ১৩ শতাংশ ভোট পাওয়া ও সংসদে ৮৮ আসনে প্রতিনিধিত্ব করাকে ভাবিয়ে তুলছে তাবৎ পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষকে। ভোটের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের তিন শরিক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন চার বছর আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে। অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও শরিক দল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন পেয়েছে ৩৩ শতাংশ ভোট। পার্লামেন্টে এদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ২১৮টি। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি পেয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ ভোট, তাদের প্রতিনিধিত্ব ১৩৮ আসনে। কট্টর ডানপন্থি পার্টি অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) পেয়েছে ১৩ শতাংশ ভোট। পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব ৮৮টি। ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি পেয়েছে ১০ শতাংশ (৬৯ প্রতিনিধি)। বাম দল পেয়েছে ৯ শতাংশ ভোট (৬০ প্রতিনিধি) এবং পরিবেশবাদী সবুজ দল পেয়েছে ৯ শতাংশ ভোট (৬০ প্রতিনিধি)। এবারের নির্বাচনের ফলাফলে বিগত জোট সরকারেরও পরিবর্তন ঘটবে বলে বলা হচ্ছে। নতুন জোট সরকারের সম্ভাব্য শরিক ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি ও পরিবেশবাদী সবুজ দল। এর আগেরবারের জোট সরকারের অন্যতম শরিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবার জোট সরকারে থাকবে না বলে জানিয়েছে।

জার্মানির জাতীয় নির্বাচনে ডানপন্থি দল ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ বা এএফডি ১৩ শতাংশের মতো ভোট পাওয়ায় মুসলিম শরণার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দলটি কার্যত অভিবাসী এবং ইসলামবিরোধী হিসেবে পরিচিত। ডানপন্থি পপুলিস্ট দল এএফডি জার্মান সংসদে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায় অনেক জার্মান বিস্মিত হয়েছেন। পাশাপাশি অভিবাসনবিরোধী এই দলের জনসমর্থন বাড়ায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে আফগান এবং অন্যান্য মুসলিম শরণার্থীর মধ্যেও। নির্বাচনে এএফডি ১৩ শতাংশের মতো ভোট পেয়ে জার্মানির তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। দেশটির বড় দুই রাজনৈতিক দল অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ এবং সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডির অনেক সমর্থকও এই দলকে ভোট দিয়েছে। ফলে ৫০ বছর পর এই প্রথম একটি উগ্র ডানপন্থি দল জার্মান সংসদে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। নির্বাচনে এএফডির এত ভালো করার পেছনে মূলত তাদের অভিবাসনবিরোধী নীতি কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে ইউরোপে ব্যাপকহারে শরণার্থী প্রবেশ করলে জার্মানিসহ ইউরোপে এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যা পুঁজি করে এগিয়েছে ডানপন্থি দলটি। যদিও অভিবাসীবিরোধী মানুষের সংখ্যা সামগ্রিকভাবে বেশি নয়, তা সত্তে¡ও বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ডানপন্থি দলটি গত কয়েক বছর ধরে দাবি করে আসছে যে, জার্মানিকে ‘ইসলামিকীকরণ’ করা হচ্ছে। ২৪ সেপ্টেম্বর নির্বাচনে জয়লাভের পর সিডিইউ দলের প্রধান অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তার বিজয়ী ভাষণে জানান, ডানপন্থি ভোটারদের পুনরায় কাছে টানতে আগামী চার বছর কাজ করবেন তিনি। তার এই বক্তব্যের ফলে অনেকে ধারণা করতে শুরু করেছেন যে, এএফডির সাফল্যের কারণে হয়ত মূলধারার রাজনৈতিক দল সিডিইউ চাপে পড়ে তাদের অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে, যার ফলে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার বিষয়টি আরো জটিল হয়ে যেতে পারে এবং আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়াদের আরো দ্রæত নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।

২০১৩ সালের তুলনায় তার দল আট শতাংশ কম ভোট পাওয়া সত্তে¡ও অভিবাসন নীতিতে নিজের অবস্থানে কোনো ভুল ছিল না বলে জানিয়েছেন মার্কেল। তিনি পরিষ্কারভাবেই জানান যে, ২০১৫ সালে সিরিয়া, ইরান এবং আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তবে অনেকেই এমনকি তার দলের কোনো কোনো রাজনীতিবিদও মনে করেন, মার্কেলের সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। সর্বশেষ নির্বাচনের পর কেউ কেউ মনে করছেন ডানপন্থি সমর্থকদের ফিরে পেতে মার্কেল হয়তো শরণার্থী নীতিতে আরো কঠোর হতে বাধ্য হতে পারেন। এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শরণার্থী ইস্যুতে ইতিমধ্যে একটি কঠোর অবস্থানে চলে গেছে জার্মান সরকার। নির্বাচনের আগে আগে আফগান শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা হয়, যা গত জুনে সেদেশে জার্মান দূতাবাসের সামনে হামলার পর বন্ধ ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম একটি চরম দক্ষিণপন্থি দল জার্মানির সংসদে প্রবেশ করল। শুধু ‘পপুলিস্ট’ ও ইউরোপবিরোধী হিসেবে এএফডি বা ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ দল যাত্রা শুরু করলেও নির্বাচনি প্রচারে দলের নেতারা বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী ও বিদেশি-বিদ্বেষী মন্তব্য করে জার্মানির রাজনৈতিক আঙিনায় গভীর অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কালো অধ্যায়ের পর জার্মানিতে কীভাবে এমন এক দল এই মাত্রায় সাফল্য পেল? বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন দেশটির অর্থনীতির অবস্থা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং বেকারত্বের হার খুবই কম। অর্থাৎ ইউরোপের বাকি দেশের তুলনায় জার্মানির পরিস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল। এমনকি ২০১৫ সালে শরণার্থীর ঢল নামার ফলে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল, গত ২ বছরে সরকার তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। তা সত্তে¡ও এমন অসন্তোষ কেন?

অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, এএফডির উত্থান ঠেকাতে মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক কৌশল গ্রহণ করেনি। এএফডির সম্ভাব্য সমর্থকদের মন বুঝে তাদের দলে টানতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অনেক মানুষও এই দলকে ভোট দিয়েছে। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ বাকি দলগুলোর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে এই দলকে ভোট দিয়েছে। অর্থাৎ এএফডির কর্মসূচির প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল না।

সংসদে এএফডি দলের শক্তিশালী উপস্থিতি আগামী চার বছরের জন্য বাকি দলগুলোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। প্ররোচনা সত্তে¡ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে এই দলকে কোণঠাসা করা তাদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। আগামী চার বছরে এএফডি বনাম বাকি দলগুলোর সংঘাতের ফলাফল কোন পথে এগোয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে জার্মানিসহ গোটা বিশ্বের মানুষ।

নানা শঙ্কা তৈরি হলেও ৬৩ বছর বয়সী অ্যাঙ্গেলা মার্কেল যে এখন জার্মানির অবিসংবাদিত নেতা, তা এবারের ভোটেও প্রমাণিত হয়েছে। জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ও ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন দলের সভানেত্রী হিসেবে অদম্য তিনি। এবার একজন নারী হিসেবে একনাগাড়ে ২০০৫ থেকে ২০২১ অর্থাৎ ১৬ বছর দেশ শাসন করার বিরল সম্মানে ভূষিত হতে চলেছেন মার্কেল। অবশ্য আগে তার দলের এবং তার রাজনৈতিক গুরু সদ্য প্রয়াত হেলমুট কোহল ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮; এই ১৬ বছর জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তবে মার্কেল যেভাবে ইউরোপে নেতৃত্বে চলে এসেছেন, তেমনটা কিন্তু জার্মানির কোনো নেতা পারেননি। দুর্গতদের পক্ষে তার মানবিক আচরণ আর অবস্থানও আজ পৃথিবীজুড়ে প্রশংসিত। আমি মনে করি, এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই নিজ দেশে মার্কেল উগ্রবাদীদের প্রতিহত করতে পারবেন। এমনকি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপকেও কল্যাণের পথে চালিত রাখতে পারবেন। এটাই আমরা দেখতে চাই।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :