জাপানের গল্প ও আত্মসমালোচনা

মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন
 | প্রকাশিত : ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৫৮

বিশেষ কিছু মানবীয় গুণাবলীর জন্য জাপানিরা সারা বিশ্বে অতুলনীয়-এ কথা কম বেশি সবারই জানা। বয়স, লিঙ্গ ও সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন প্রায় প্রত্যেক জাপানিই শান্তশিষ্ট, সৎ, বিনয়ী, দয়ালু, মহানুভব, পরিশ্রমী, স্বনির্ভর, আত্মবিশ্বাসী, সময়নিষ্ঠ, পরিচ্ছন্ন, মেধাবী, লাজুক ও পরোপকারী স্বভাবের হয়ে থাকে। জাপানিদের সাথে আমাদের মানসিকতার পার্থক্য বিস্তর।

যেমন: ১. গত মাসে টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসে JDS Fellows দের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে আমাদের সাথে JICE এর দুজন কর্মকর্তাও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন JICE এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমরা গিয়ে চেয়ারে বসলাম। আর JICE এর দুজন কর্মকর্তা আমাদের পেছনে গিয়ে বসলেন। মান্যবর রাষ্ট্রদূত মহোদয় এলেন এবং JICE এর ওই দুজন কর্মকর্তাকে সামনে এসে বসার জন্য বিনীত অনুরোধ জানানোর পরেও তারা আসতে রাজি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিশেষ অনুরোধে তারা সামনে এসে বসলেন। আমি তাদের বিনয় ও উদার মানসিকতায় সত্যিই বাকরুদ্ধ। বিষয়টি বাংলাদেশে হলে কী হতো? কে কোথায় বসবে, কে হাতাওয়ালা চেয়ারে বসবে, আর কে হাতাছাড়া চেয়ারে বসবে, ব্যানারে কার নাম থাকবে, কে প্রধান অতিথি হবে, আর কে সভাপতি হবে এসব নিয়ে চলে রীতিমত স্নায়ুযুদ্ধ। কারণ, আমরা বাংলাদেশিরা সবাই কমবেশি হীনম্মন্যতায় ভুগি।

২. কয়েকদিন আগের ঘটনা। বিকেল বেলা। নতুন জায়গা। কিছুই চিনি না। আমি একটি শপিংমলে যাব, কিন্তু এটি আমি চিনি না। সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হলাম। ভাবলাম যে কারও সাহায্য নিয়ে চলে যাব। রাস্তায় দেখলাম তিনজন ১১/১২ বছরের স্কুলছাত্র সাইকেলে করে বাসায় ফিরছে। দুরন্ত ছেলেগুলো দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি "Sumimasen (Excuse me)" বলে একজনকে থামালাম। Yamada (একটি শপিংমল) কোথায় জানতে চাইলাম। ছেলেটা সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে আমাকে যাওয়ার রাস্তা বলে দিল। কিন্তু আমি ওকে বললাম যে আমি একা যেতে পারব না এবং আমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলাম। ছেলেটি তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ওই শপিংমলে আসল। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি শপিংমলে ঢুকলাম। প্রায় ৩০ মিনিট পরে আমি বের হলাম এবং দেখলাম ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম সে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার আমাকে আমার জায়গায় পৌঁছে দেবে। সে ভেবেছিল হয়তো আমি একা ফেরত যেতে পারবো না। যথারীতি আমরা দুজন আমার ডরমিটরিতে পৌঁছলাম। ছেলেটি সাইকেল থেকে নামলো। জাপানি প্রথা অনুযায়ী মাথা নত করে "Arigatogozaimas (ধন্যবাদ)" বলে চলে গেল।

বাংলাদেশে আমরা এগুলো প্রত্যাশা করতে পারি না। বাংলাদেশে কোনো জায়গা অথবা কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কারো কাছে জানতে চাইলে আপনি সদুত্তর পাবেন কি না তা নির্ভর করে ওই লোকের মুডের ওপর। মুড ভালো না থাকলে আপন ভাইকেও বলবে চিনি না।

৩. গত দুই দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের Student Support Centre এ গিয়েছিলাম ইন্সুরেন্স সংক্রান্তে একটি বিষয় জানতে। দায়িত্বরত একজন মহিলার কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম যে ইন্সুরেন্স করাটা আমার জন্য ঐচ্ছিক না বাধ্যতামূলক। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে এটা আপনার জন্য ঐচ্ছিক। আমি চলে আসলাম। কিন্তু ভদ্রমহিলার কাছ থেকে গতকাল আমি একটি ইমেইল পেলাম। ওই ভদ্রমহিলার মেসেজ ছিল এরকম- "তুমি গতকাল আমাদের অফিসে ইন্সুরেন্স সংক্রান্তে জানতে এসেছিলে। আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, ইন্সুরেন্স করাটা ঐচ্ছিক। আমার উত্তর সঠিক ছিল বটে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে যে, প্রত্যেক ছাত্র/ছাত্রীই ইন্সুরেন্স করুক। আমার এ বিষয়টিও তোমাকে বলা উচিত ছিল যা আমি তোমাকে বলিনি। আর এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।"

আর বাংলাদেশে কোন অফিসে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে আপনার কাছে উল্টো ‘স্মারক নং’ জিজ্ঞেস করে বোকা বানিয়ে দেবে।

যাই হোক, আমাদের মাঝেও মানবীয় গুণাবলী জাগ্রত হোক।

লেখক: শিক্ষার্থী, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :