শেখ হাসিনার ‘নোবেল’ নিয়ে বানোয়াট সাংবাদিকতা কেন?

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ২২:৩৯

শেখ আদনান ফাহাদ

গত আট বছরে নিজেকে নেতৃত্বের এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতাবাদী অবস্থান নিয়ে শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার নয়, তাবৎ দুনিয়ার একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাইতো পশ্চিমা গণমাধ্যম পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের অর্জন কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার সংক্রান্ত একশ্রেণীর ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজপেপারের ‘বানোয়াট’ সাংবাদিকতা।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, চরম অবিশ্বাসযোগ্য কিছু সস্তা ‘সংবাদ’ প্রতিবেদন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত শেয়ার করেছেন। এতে করে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে, শেখ হাসিনা নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেও পেতে পারেন! কিন্তু প্রশ্ন হল, শেখ হাসিনাকে নোবেল পুরস্কার পেতে হবে কেন? এই শান্তি পুরস্কার  ভারতের ইন্দিরা গান্ধী কিংবা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পাননি। অথচ এই দুই মহান নেতা যৌথভাবে অথবা এককভাবে একই প্রেক্ষাপটে নোবেল পুরস্কার কেন, এর চেয়েও বড় কোনো পুরস্কার থাকলে পেতে পারতেন।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিপরীতে গিয়ে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র স্বাধীন করার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জীবনে শান্তি এনেছিলেন। আর ইন্দিরা গান্ধী এক কোটিরও বেশি মজলুম মানুষকে তাঁর নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁরা যে কারণে  নোবেল শান্তি পুরস্কার পান নি, সে একই কারণে শেখ হাসিনাও পাবেন না, এ তো সহজ সমীকরণ।  বঙ্গবন্ধু নিয়ে পড়াশুনা থাকলে, বঙ্গবন্ধুকে বুঝে থাকলে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ এসব বানানো গল্প-নির্ভর ‘সংবাদ’ প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার করতেন না। বঙ্গবন্ধু সরাসরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে স্বাধীনতার আহবান এবং ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গালে বড় এক থাপ্পড়। যার প্রতিশোধ এই যুক্তরাষ্ট্র পরে নিয়েছিল আমাদের জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিরাপদে বিদেশে চলে যেতে এবং বিদেশে আশ্রয়লাভের প্রক্রিয়ায় সামনে থেকে সব কাজ করে দিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। শেখ হাসিনাও শক্ত হাতে পদ্মা ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির ষড়যন্ত্র সামলেছেন। আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কয়েকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। শেখ হাসিনা বহুবার তাঁর ভাষণে ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশী-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। তখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করতে রাজি হননি। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান।  স্প্যান বসানো শুরু হয়ে গেছে। এটা যে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর কত বড় পরাজয় সেটি সচেতন মানুষ মাত্রই বুঝতে পারবেন। তথাকথিত আইএস ইস্যুতেও শেখ হাসিনার সরকার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। এত কিছুর পর শেখ হাসিনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হবে, এটি যারা প্রচার করে তারা হয় নির্বোধ না হয় বড় ধরনের ষড়যন্ত্রকারী।

আমার, আপনার চেনাজানা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকা একটু দেখে নিন। তাহলে বুঝতে পারবেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার কারা পায়, কীভাবে এবং কী জন্য পায়। আমাদের বাংলাদেশেরও একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া মানুষ আছেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস। একজন অর্থনীতিবিদ নোবেল পাবেন অর্থনীতিতে। কিন্তু তিনি পেলেন শান্তিতে! বাংলাদেশের মানুষের জীবনে তিনি কী শান্তি এনেছেন যে, তাকে নোবেল পুরস্কার দিতে হবে? ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা বাংলাদেশে নতুন কিংবা মৌলিক কিছু নয়। তাছাড়া বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অনেক ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি রয়েছে। সামাজিক ব্যবসার নামে ক্ষুদ্র ঋণের ধারণায় কিছুটা মৌলিকত্ব আনার চেষ্টা হলেও আদতে ঋণ এবং সুদের সম্পর্কই এখানে মুখ্য চরিত্র।

সামাজিক ব্যবসা যদি অর্থনীতির মৌলিক কোনো ধারণা বা তত্ত্ব হয়ে থাকে, তাহলে অধ্যাপক ইউনুসকে অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া  যেত। আদতে পুঁজিবাদী বিশ্ব সামাজিক ব্যবসার নামে মানুষের একেবারে ক্ষুদ্রতম পরিসরেও পুঁজির নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। এর জন্য একজন এজেন্ট দরকার ছিল তাদের। আর ডক্টর ইউনুসও মার্কিন ব্লকের সাথে একেবারে মিশে গিয়ে তাদের যোগ্য এজেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এইজন্যই হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ফান্ডে লাখ লাখ ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনুস। শান্তির সাথে যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত এই অধ্যাপকের কোনো সম্পর্ক নেই তার প্রমাণ তিনি নিজেই। এই অধ্যাপক কখনোই ন্যাটো বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের জন্য একটা কথাও বলেন না। বিদেশ তো দূরের কথা, নিজের দেশের নানা প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়েও তার কোনো অবস্থান আমরা দেখি না।

আরেকজন নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত মানুষ (?) হলেন পাশের দেশের অং সান সু চি। স্মরণকালের ভয়াবহতম রোহিঙ্গা গণহত্যায় তিনি একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রোহিঙ্গানিধন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমন কিছুই বলে না। কারণ মিয়ানমারে প্রবেশ করতে হলে অং সান সু চিকে সেদেশে সেনাবাহিনীর কাছে বিতর্কিত করলে হবে না। তাই তো, আমরা দেখি রোহিঙ্গাদের কচুকাটা করা হলেও অং সান সুচি এর পক্ষে কাজ করেন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ থাকে।  

নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে আমাদের দাসসুলভ মনোভাবের অবসান ঘটাতে হবে। প্রতিটি দেশে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দোসর হিসেবে কাজ করে তারাই নোবেল শান্তি পুরস্কার পান অথবা পাওয়ার আলোচনায় আসেন। যেমন ধরুন চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা লিও জিয়াবাও এর কথা। তাকে মার্কিনী এবং অন্যান্য পশ্চিমা মিডিয়া বলে ‘অহিংস’ নেতা হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পছন্দের ব্যক্তি  তিনি। কারণ চীনের সরকার এবং কম্যুনিস্ট পার্টির কট্টর বিরোধী তিনি। চীনের আরেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা দালাইলামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। কারণ তিনি চীনের সরকার এবং কম্যুনিস্ট পার্টির একজন কট্টর সমালোচক। তিব্বতকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান এই দালাইলামা। আবার ধরুন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা। ইরাকে, আফগানিস্তানে কিংবা লিবিয়ার জর্জ বুশের সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ সুচারুরুপে চালিয়ে যাওয়া বারাক ওবামা কেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাবেন? কেউ আমাকে বলতে পারেন?

নোবেল শান্তি পুরস্কার বহুদিন থেকে সাম্রাজ্যবাদীদের পকেটে ঢুকে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্লকের হয়ে যারা কাজ করবেন, তারাই শুধু এ পুরস্কার পেয়ে আসছেন। যদি বস্তুনিষ্ঠ ভাবে নোবেল পুরস্কারের জন্য মানুষ খুঁজে দেখা হয়, তাহলে অবশ্যই শেখ হাসিনা শীর্ষে থাকবেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি কিংবা ছিটমহল বিনিময়ের কত কাজ করে শেখ হাসিনা বহু আগেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ের কাজ করেছেন। আর সর্বশেষ ৮ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনার শান্তির কাজকে বহু দূর এগিয়ে নিয়েছেন। এরপরেও শেখ হাসিনা নোবেল পুরস্কার পাবেন না, এটা আমরা বহু আগেই থেকেই লেখালেখি করেছি। কিন্তু কিছু ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজপেপার যেভাবে সস্তা সাংবাদিকতার নজির দেখাল এবং আওয়ামী লীগের কয়েকজন এমপি, বড় বড় নেতা যেভাবে এগুলো শেয়ার করল তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।

কদিন আগে আমরা দেখেছি, ভারতের এক ‘সাংবাদিক’ সুবীর ভৌমিক ভয়ংকর এক অপরাধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং নিষ্ঠায় চিড় ধরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে যে এই ভারতীয় সাংবাদিক এই অপসাংবাদিকতা করেছেন, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, যারা আপনার নামে ভুয়া সংবাদ করে এদের বিরুদ্ধে আপনি ব্যবস্থা নিন। কিছু কট্টরবিরোধী বাদে আপনি দেশের মানুষের সিংহভাগের হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের মানবতাবাদী সাধারণ মানুষ আপনাকে ভালোবাসে। নোবেল পুরস্কার থেকে বহু উপরে আপনার অবস্থান। যারা বানোয়াট সাংবাদিকতা করে আপনার অসাধারণ সব সাফল্য কিঞ্চিৎ ম্লান করে দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির হাতে সমালোচনার অস্ত্র তুলে দিয়েছে, এদের বিরুদ্ধে আপনি ব্যবস্থা নিন। আপনি নিজেও বলেছেন, দেশের মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার হতে পারে না।  

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়