দূর দিগন্তে

মোহাম্মদ অয়েজুল হক
 | প্রকাশিত : ০৯ অক্টোবর ২০১৭, ২০:৪৮

হেলিকপ্টার আর যুদ্ধ বিমানের তর্জন গর্জন শুনে রুম থেকে একপ্রকার দৌড়ে বের হয় বাবু। তড়িঘড়ি করে তালা মেরে বের হয়। কী হচ্ছে জানা দরকার। এমনিতেই নানা কারণে মন খারাপ। বেশ কিছুদিন হলো কিছুই ভালো লাগছে না। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টের গুরুত্বপূর্ণ কারণ তমা। তারপর আবার শুরু হয়েছে নদীর ওপারে মানুষের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড। দেশটা আলাদা হলেও প্রতিবেশী দেশ, ব্যবধান নাফ নদী। বাবুর বাসা থেকে নাফ নদী প্রায় চার কিলোমিটারের পথ। সন্ধ্যার দিকে টেকনাফ সদরে অটোরিকশার অভাব নেই। সুদীর্ঘ বছর ধরে রাখাইনে জাতিগত নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে দিনের পর দিন বাড়ছে অসহায় মানুষের আগমন। মিয়ানমারের মানুষের আনাগোনা, শরণার্থী মানুষের ভিড়ে টেকনাফ হয়েছে সদাজাগ্রত এক নগরী। গভীর রাতে রাস্তা, ফুটপাতে যেমন মানুষের কান্না শোনা যায়, চিৎকার শোনা যায় তেমনি শোনা যায় আইন রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর গাড়ির হুইসেল। নদী আর পাহাড়ের দেশে ছোট থেকে বেড়া ওঠা বাবুর বহুকাল আগে থেকেই মনের টান নদীর প্রতি, সবুজ অরণ্যেঘেরা পাহাড় তার সুখ-দুখের সাথী, সাক্ষী।

দেখতে দেখতে নাফ নদী সামনে চলে আসে। ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে হাঁটতে থাকে নদীর কূল ঘেষে। আকাশজুড়ে কালো মেঘ, রাতের আঁধারের সাথে মিলেমিশে একাকার। এখনো ঘন কালো হয়ে ঝপঝপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়নি। বৃষ্টি হলে ভালো হতো। ওপাশে জ্বলা লাল, নীলাভ, বীভৎস আগুনগুলো হয়তো নিভে যেত। গুলির শব্দ, মানুষের কান্না, চিৎকার, কটু গন্ধ বাতাসে ভর করে ছুটে আসছে এদিকে। সেই সাথে সমানতালে চলছে মানুষের ছোটাছুটি। কতো মানুষ! বাতাসের একেকটা ঝাপটায় মনে হয় এই বুঝি বাবু উড়ে গিয়ে পড়ে নদীর ভেতর। পড়লে মন্দ হতো না! জোয়ার ভাটার টানে গন্তব্যহীন এক যাত্রায় শুরু হতো তার পথচলা। কতো মানুষই তো ভাসছে, চলছে।

পকেটের ভেতর মোবাইলটা বেজে ওঠে। বাবুর মেজাজ খারাপ হলেও কিছু করার নেই। মোবাইল তার ইচ্ছা মতো বাজবে না। মানুষ তার প্রয়োজন মতো সময়ে তাকে খুঁজে বেড়াবে। ফোন করবে। বেজে উঠবে মোবাইল। আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে আর কেউ খুঁজবে না। পৃথিবীটা একটা স্বার্থের আস্তাকুড়। স্বার্থের পেছনে দৌড়ানো, মানুষের চোখ বোজার আগ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে চলতেই থাকবে। আজকাল মোবাইল বেজে উঠলে বুকের ভেতর কেমন খাঁ খাঁ করে ওঠে। মাঝে মাঝে রাগও হয়। কষ্ট হওয়ার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেলেও রাগ হওয়ার কারণ খুঁজে পায়না।

ফোনটা রিসিভ করতেই কর্কশ কণ্ঠস্বর, করেছেনটা কী! কথা বলেন পঞ্চাশোর্ধ বয়সের একজন মানুষ। পাশের বাসার ভাড়াটিয়া।

- কী করেছি?

- আপনি কি পাগল?

- আমি পাগল হতে যাবো কেন! আপনি পাগল।

- বাজে কথা বলবেন না। সেই একঘণ্টা ধরে ফোন দিচ্ছি, ফোন ধরেন না।

- আপনাকে ফোন দিতে কে বলেছে? আর কখনো ফোন দেবেন না। কথা শেষ করেই ফোনটা কেটে দেয়, বন্ধ করে দেয়। কেন খোলা থাকবে মোবাইল! কী জন্য খোলা থাকবে? বাবুর কারও সাথে কথা বলার দরকার নেই। কী কথা বলবে! কেন কথা বলবে? বহুদিন হয়ে গেল আর তো শোনা হয় না তমার কথা, একটি বারের জন্যও নয়, এক মুহূর্তের জন্যও নয়। এমন পাষাণ তমা পৃথিবীতে ঠিক কতোগুলো আছে কে জানে! কতোগুলো বাবু নদীর পাড়ে বসে চোখের পানি ফেলে বুকের ব্যাথা নদীর ঢেউয়ের সাথে মিশিয়ে দিতে চায় তার হিসাবই বা কে রাখে? এমনিতেই মনটা মেঘের মতো কালো হয়ে আছে এরপর উল্টোপাল্টা কথা শুনলে কার মেজাজ ঠিক থাকে! মোবাইলটা ফেলে দিতে ইচ্ছা করে নদীর ভেতর। ইচ্ছেটা চেপে যায়, মিলিয়ে যায়, গুড়িয়ে যায়। মোবাইল গার্ডেন থেকে পছন্দ করে কিনেছিল মোবাইলটা। প্রথম পছন্দ, প্রথম হাতের ছোঁয়া ছিল তমার। তমা চলে গেল কেন! এই যে ওপারের মানুষগুলোর কষ্ট, মরে যাওয়া, ঘর পোড়া, মানুষ পোড়া। মায়ের ছেলে হারানো, ছেলের মা হারনো! এর সামনে তমার কী এমন কষ্ট বা সংগ্রাম ছিল! কী এমন স্বপ্নে বিভোর তমা চলে গেল তাকে আজন্ম বুকে পোষা মানুষ ফেলে!

রাতের গভীরতা বাড়ে। নদীর তুফান আর বাতাসের বেগ মিলিয়ে কী এক অদ্ভুত ধরনের শব্দ হয়। এই নাফ নদীটাই এঁকে বেঁকে একটু দূরে গিয়ে সাগরে মিশেছে। সাগরের কোলে যেন তার অনন্তকালের আশ্রয়। জোয়ার ভাটার তীব্র টানের ভেতর, ঝড় ঝাপটা আর বানের ভেতর ছোট ছোট নৌকা, কোনো রকম জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলোর জীবন বাঁচাবার সংগ্রাম চলে নদীর ভেতর। বেশ দূরে দূরে ক্ষীণ আলো তাদের অস্তিত্বের কথা বলে। বিকট শব্দ আসে মাঝে মাঝেই। এ শব্দের সাথে ফিনকি দিয়ে রক্তঝরা, জীবন্ত মানুষের নিথর হয়ে যাওয়া আর কিছু আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটির দৃশ্য আগোচরেই থেকে যায়। সভ্য, মানবিক দাবীদার মানুষগুলোর অন্ধ চোখ তা দেখতে পায় না।

বাবু যেখানে বসেছিল তার বিশ-পঁচিশ গজ দূরেই একটা ছোট নৌকা ভেড়ে। হুড়মুড় করে নামতে চেষ্টা করছে সবাই। বাবু এগিয়ে যায়। আনুমানিক ষাটজনের মতো মানুষ। একে একে সবাই নেমে যায়। অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যায়। ব্যতিক্রম এক মেয়ে। নৌকা থেকে অনেক কষ্টে তাকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়েছে দুই মহিলা। নামার পরও সে যাবে না। মহিলা দু'জন তাকে বোঝাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। কিছুতেই যাবে না মেয়েটা।

-কী হয়েছে, আপনি যাবেন না?

বাবুর কথা যেন তার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। মানুষটা বাকরুদ্ধ। জবাব না দিয়ে ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবু একটু জোরের সাথেই অনেকটা চিৎকার দেবার মতো বলে, চলে যান। আপনি মেয়ে মানুষ, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিপদ ডেকে আনবেন না।

বাবুর কথা শেষ হয় না, হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার তো আর কিছু নেই। চোখের সামনে স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেললো, কোলের সন্তানটাকে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ছুড়ে দিল। আমি ওর আগুনে পোড়া চিৎকার শুনেছি...।

বুকফাটা আর্তনাদের পরই মেয়েটা চরের উপর লুটিয়ে পড়ে। মহিলা দু'জন ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যায়। বাবু দিগন্তের ওপারে তাকায়। আগুনের লেলিহান শিখা বিরামহীনভাবে আকাশে ওঠে।

-এই অন্ধকারে বসে বসে কী করিস?

চমকে ওঠে বাবু। অনেকগুলো মানুষ, হাতে অস্ত্র।

-বসে আছি।

-বসে আছিস সেটা তো দেখা যাচ্ছে, কী করিস? গলার স্বর বেশ কড়া, রুক্ষ।

বাবু অবাক হয়, মিয়ানমারের সেনা এলো, না ভুল করে সে ঢুকে পড়েছে মিয়ানমারে!

-এই চুপ করে আছিস কেন?

-স্যার কিছু বুঝতে পারছি না।

-বুঝতে পারছিস না মানে?

-মানে স্যার আপনারা বিজিবি না বিজিপি!

-মাথায় গণ্ডগোল আছে নাকি?

-না স্যার, আমি বাবু, একজন সুস্থ মানুষ।

- তা এতো রাতে এখানে কী?

- কতোরাত? বাবুর কথা শেষ না হতেই ওর দিকে কয়েকজন ধেয়ে আসতে যায়। বাধ সাধেন একজন। উনি হয়তো বড় অফিসার। বাবু নিশ্চিত হয় এরা আমাদের, হায়েনা নয়। অন্ধকারে কারও চেহারা দেখা যায় না, মনের চোখে একটা পরিচ্ছন্ন, পবিত্র মুখের ছবি আকে।

-স্যার ওপারে কী ভয়ংকর আগুন আকাশে উঠছে। আগুনের এতো রঙ আমি আগে দেখিনি। মানুষ বাঁচতে ছুটছে, বাঁচতে পালাচ্ছে, সাগর নদীতে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে ভাসছে মানুষ। ওরা কি মরে যাবে স্যার? একটাই তো দেশ আমরা, মানবিক কারণে যুগের পর যুগ আশ্রয় দিচ্ছি মানুষকে। এবার কি তার ব্যতিক্রম হবে?

লোকটা কোনো উত্তর দেয় না। নিস্তব্ধ, নির্বিকার। কিছুক্ষণ পরে নাম, ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে শুধু বলেন, অনেক রাত হয়েছে, বাড়ি চলে যান।

বাবু ওঠে, আবার সেই পথ। বাসার দিকে চলে। পেছনে আগুনের লেলিহান শিখা, থেমে থেমে গুলির শব্দ। মানুষের চিৎকার, কান্না, হুড়োহুড়ি। রাত দুইটা। বাবু ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। দোতলায় উঠতেই অনেক মানুষের শোরগোল শোনা যায়। তমা কি ফিরে এসেছে? প্রশ্নটা মনের কোনে উঁকি দেয়।

- এই যে এসেছে। বাবুকে দেখেই একযোগে অনেকগুলো মানুষের কণ্ঠে বেজে ওঠে এক সুর। ভেতর থেকে চিৎকার দেয় সেই বদ লোকটা, কে এসেছে? জড়ো হওয়া মানুষের ভেতর থেকে একজন বলে, বাবু এসেছে।

- চাবি নিয়ে দরজাটা খুলুন। বদটাকে কষে দুটো থাপ্পড় মারবো, দুটো লাথি দেব। ওর সামনের দুটো দাঁত ফেলে দেব। ঘাড় ধরে দোতলা থেকে ফেলে দেব।

- দেন চাবি দেন। হারুন সাহেব বাবুর কাছে চাবি চান।

বাবু আগামাথা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, চাবি দেব কেন?

- ওনারা কি ঘরে আটকা পড়ে মরবেন?

- আমার চাবির সাথে ওনাদের বাচা মরার কী আছে!

হারুন সাহেব ঠান্ডা মাথার মানুষ। ঠান্ডা মেজাজেই বলেন, আপনার বাসার দরজা খোলা। আপনার তালাটা লাগিয়েছেন প্রতিবেশীর দরজায়।

বাবু চমকে ওঠে। এজন্যই লোকটা বারবার ফোন করেছিল। ওর মুখটা লজ্জায় লাল হয়। পকেট থেকে চাবিটা বের করে দেয়। দরজা খুলতেই বয়স্ক মানুষটা বাবুকে মারতে তেড়ে ওঠেন। বাবু একটুও নড়ে না। কথা বলে না। লোকজন বলে, ইচ্ছা করে তো আর করেনি, বাদ দেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজের ঘরে যায়। নিস্তেজ শরীরটা এলিয়ে দেয় সোফার উপর। ভাবনায় দোলা দেয়, দিগন্তের ওপারের আগুন, নদীতে ডোবা নৌকা, ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর মরণ চিৎকার। শরীরটা কেঁপে ওঠে।

লেখক: গল্পকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :