খোকার রক্তেভেজা পিরানটা

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ১১ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:৫৯

খোকাকে ওর বাবা কোনোদিন ভালো একটা পিরান (জামা) দিতে পারেনি। লেখাপড়ায় ভালো থাকলেও ভালো পিরানের অভাবে বন্ধুদের সাথে মোটেও খাপ খাওয়াতে পারতো না খোকা। হাট থেকে কিনে দেয়া খোকার পিরানটা যেন বন্ধুদের সাথে বড়ই বেমানান। সহপাঠীরা যখন আড্ডায় মজে খোকা তখন নিজেকে আড়াল করে কাঁদে। দিনক্ষণ ঠিক করলো বাবাকে জিজ্ঞেস করবে বন্ধুদের পিরান কোথা থেকে কিনে।

ঈদকে সামনে রেখে বাবাই জিজ্ঞেস করলো খোকা তোরতো এবার নতুন পিরান লাগবো বুঝি? খোকা মিষ্টি হাসে। এই বুঝি উৎসবে আসবে ভালো একটি নতুন পিরান। খোকার বাবা আব্দুস সামাদ, নিজেও জানে ঈদ কিংবা পূজা, বর্ষবরণ কিংবা বসন্তবরণ সব উৎসবেই শিশুদের নতুন পিরান চাই। ইচ্ছেও হয় খোকাকে একটি নতুন পিরান দেয়ার। কিন্তু কোথা থেকে দেবে।

খোকার দাদার সহায়-সম্বল যা কিছু ছিল তা দিয়ে যমুনার ক্ষুধাই মেটেনি। এপার আর ওপার করতে গিয়ে জমির নিশানাটা মনে নেই। ভাগে জমাজমি কিছু না পাওয়ায় গা খাটিয়ে সংসার চালাতে হয় সামাদকে। কিছুদিন ধরে তালুকদার বাড়ির দুই কাঠা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছেন সামাদ। জমি বর্গা নেয়াটা নেহাত লোকসান। কিন্তু খোকার যে বড় পছন্দ খেতের ধানের উড়–ম খেতে। গা খাটিয়ে যদি খোকার একটি আবদার সাধ্যের মধ্যে পড়ে তয় বাড়তি শ্রমটা লাভ বই ক্ষতি হবে না বলে জমিটি সবে মাত্র বর্গা নিয়েছে খোকার বাবা সামাদ।

ভাবছিল ঈদের আগে এবার জমির ধানটা ঘরে আইলে আধমন ধান বাজারে বেঁচে খোকাকে এবার সত্যিই একটা সুন্দর পিরান দিমু। কিন্তু তিনবার চারা রোপন করেও বন্যায় নিয়ে গেল সামাদের এতোদিনের খোয়াব। ঈদের উৎসব যেন অনেকটাই তেতো হয়ে গেল। বরং তালুকদার সাবের কাছ থেকে তিনবারের ধানের চারা কেনার টাকাটা ইতিমধ্যে ধার করে আনা হয়েছে। পিরানতো দূরের কথা, ধানের টাকাটা শোধ করাই যেন তার কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে শিশু ছেলেকে দেয়া কথা বলতেও একটা কিছু আছে। সামাদ ভাবছে কী দিয়ে ছেলের দেয়া কথা রাখবে।

মঙ্গলবারের হাটে পুরোনো কিছু তিল বীজ বিক্রি করতে গেলেন খোকার বাবা। চার কুড়ি টাকা বিক্রি করে দোকান থেকে একটি পিরান কিনে ছেলেকে বলছে দেখতো খোকা। পিরানটা কেমন হয়েছে? খোকা মাথাটা নামিয়ে হাসছে। বলছে বাবা কী দরকার ছিল নতুন পিরানের। আমার জন্য আনলা। তোমাদের জন্য পিরান লাগবো না?

বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছেন আমাগো পিরানতো নতুনই আছে। বলেই চলে গেলেন বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে। একাকি বসে ভাবছে এভাবে আর কতোদিন। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বিদেশে পাড়ি জমাবে। ধর্মের প্রতি সামাদের দুর্বলতা সেই শৈশব থেকেই। পাকা করে ফেললো আরবে চলে যাবে। যাই কামাই রোজগার করা যাক না কেন নবীর মাজারটা জেয়ারত আর খোদার ঘরটা একবার দেখে আসা যাবে।

বর্গা নেয়া জমির মালিক তালুকদার সাবের কাছে আবার গিয়ে বাড়তি টাকার আবদার। কোন সাহসে এতো টাকা ধার দেবে তালুকদার? অবশেষে ভিটেবাড়িটুকু বন্ধক রেখে আরবে যাওয়ার টাকা নিলেন। সামাদ চলেও গেলেন আরবে। ভালোই চলছিল। ধারের টাকাটা প্রায় শোধের দিকে। সামনের দিনটা সুখেই কাটবে।

গেলবারের ঈদের আগে দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে ঈদ কেনাকাটার জন্য। ঈদের আগে খোকার জন্য পছন্দসই একটি পিরান কিনে দিলেন খোকার মা। ঈদের দিন নামাজটা পড়েই পিরানটা খুলে রাখলো। কাল বেড়াতে যাবে মহেরার জমিদার বাড়ি। বাবার অনুপস্থিতিতে অভিভাবিকা মা না করতে পারলেন না। পরদিন পাখিদের ঘুম ভাঙার আগেই খোকার শব্দ। যেন পেছনের বছরগুলোতে এ রকম আনন্দ খোকার মায়ের আর কখনো চোখে পড়েনি।

মা, খোকা আর খোকার ছোট্ট বোন, তিনজনেই যাচ্ছিলেন মহেরা। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহসড়কের মহেরা সংযোগ সড়কের সামনে একটি ঘাতক বাসচাপায় পিষ্ট হলো ওরা তিনজন। খোকার নতুন পিরানটি আজ রক্তের দাগে লাল বর্ণ হয়ে গেল। ওদের মৃত্যের খবর শুনে খোকার চাচাও মারা গেল বিদেশে। খোকার বাবা সামাদ মিয়া খোকা, খুকি ও খোকার মায়ের লাশ দেখতে ফিরে এলেন দেশে। খোকার বাবা আর আরবে যাবে না। এখন খোকার ওই রক্তেভেজা পিরানটা বাবার কাছে শুধুই স্মৃতি।

লেখক: সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :