সাংবাদিক হতে সাংবাদিকতার ডিগ্রি কতখানি জরুরি?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১২ অক্টোবর ২০১৭, ১০:৪৯

ইদানিং অনেক বড় বড় পত্রিকা বা সম্প্রচারমাধ্যম শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিকতার ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণী চায়; স্পষ্ট উল্লেখ করে দেয় যে, সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করা ছেলে-মেয়েরাই সিভি দিতে পারবে। সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-বিহীন ‘সাংবাদিক’দের পারফরমেন্স অনেকক্ষেত্রে সুখকর নয় বলেই অফিসগুলো এমন সিদ্ধান্ত নেয়। আবার এটাও সত্যি যে, সাংবাদিকতার ডিগ্রিবিহীন সাংবাদিকরাও খুব ‘ভালো’ করছেন।

এ কথাও বলা যায় যে, সাংবাদিকতার ডিগ্রিবিহীন সাংবাদিকরাই বাংলাদেশে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে রাস্তা দেখিয়েছেন, যার সুফল এখন সবাই ভোগ করছে। বাংলাদেশে বড় বড় সাংবাদিকদের অধিকাংশেরই সাংবাদিকতায় ডিগ্রি ছিল না। এ কথা বলে আবার অনেকে সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির গুরুত্ব কমাতে চায়। কিন্তু তাদের এই অবস্থান যে নিছক ছেলেমানুষি এবং অবিবেচনাপ্রসূত, সেটাও অন্যরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির দরকার আছে কি, নেই, এ নিয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক, সাংবাদিকতার ডিগ্রিধারী এবং ডিগ্রিবিহীন সাংবাদিক তথা সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে বিতর্ক হয়ে আসছে আগে থেকেই। নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখেছি, সাংবাদিকতা বিভাগে অনার্স মাস্টার্স করে অনেকে আছেন যারা কর্মক্ষেত্রে শুরু থেকেই কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারছে না। আবার অন্য বিষয়ে পড়াশুনা করে অনেকের ‘সাংবাদিকতা’ শিখতে বেশিদিন লাগে না। তবে দক্ষ ও পেশাদারী সাংবাদিক হতে গেলে, প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন এবং প্রশিক্ষণের যে বিকল্প নেই, এ কথা এখন সর্বজন স্বীকৃত।

সাংবাদিকতার উপর অনলাইন-ভিত্তিক প্রশিক্ষন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান পয়েন্টার ডট নিউজ ইউনিভার্সিটি ২০১৩ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল। নিউজ ইউনিভার্সিটির অন্যতম পরিচালক হাওয়ার্ড ফিনবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সম্মেলনে জরিপ প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। সে প্রতিবেদনে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর জোর দেয়া হলেও বলা হয়েছিল যে, সাংবাদিকতা বিভাগগুলো যদি নিজেদের কারিকুলামে সময়ের দাবি অনুযায়ী পরিবর্তন না আনে, তাহলে চার বছর মেয়াদী ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সংখ্যা হবে হাতেগোনা।

গবেষণা জরিপে মোট ১৮০০ মানুষকে তিন মাস সময় ধরে নানা প্রশ্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ উত্তর দাতা ছিলেন সাংবাদিকতার শিক্ষক, আরও ৩৮ শতাংশ ছিলেন সংবাদ মাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি। বাকিদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীন মিডিয়াকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী এবং নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। জরিপ ফলাফলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, সাংবাদিকতার ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষক এবং প্রফেশনালদের মধ্যকার বিশাল মতপার্থক্য।

প্রশ্ন করা হয়েছিল, সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ অনুধাবনে সাংবাদিকতার ডিগ্রি দরকার আছে কি না? এর জবাবে ৯৬ শতাংশ সাংবাদিকতার শিক্ষক বলেছেন, এক্ষেত্রে ডিগ্রি অর্জন খুবই জরুরি। তবে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ অনুধাবনে পেশাগত ডিগ্রি দরকার, এমন মনে করা সাংবাদিকের সংখ্যা ৫৭ শতাংশ। সংবাদমূল্য অনুধাবন এবং সংবাদ প্রতিবেদনে তৈরিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা অর্জনে সাংবাদিকতার ডিগ্রি কতখানি দরকারি? এমন প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকতার শিক্ষকদের ৯৮ শতাংশ বলেছেন, অত্যন্ত দরকারি। তবে এমনটি মনে করা পেশাদার সাংবাদিকের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপরে উল্লেখিত জরিপের প্রাসঙ্গিকতা এবং যথার্থতা অনস্বীকার্য। জাতীয় পর্যায়ের সংবাদমাধ্যমগুলোতে সাংবাদিকতার ডিগ্রিধারী সাংবাদিকরা এখন শীর্ষ পদসমূহে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন অনেকেও বড় সাংবাদিক পরিচয়ে সমাজে আছেন। অনেক হাউজে খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে চলেছেন ইনারা। কোনো কোনো হাউজে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারীদের উপস্থিতি প্রায় ১০০ ভাগ। অধিকাংশ হাউজে বিশেষ করে রিপোর্টার এবং সাব-এডিটর বা নিউজরুম এডিটরদের একটা বড় অংশ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার পর কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে সমবয়সীদের তুলনায় বড় দায়িত্ব পালন করছেন, বেতনও বেশী পাচ্ছেন; কারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়ার আগেই এরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, সাংবাদিকতা পেশাকে আরও সিরিয়াসলি নেয়ার সময় এখন এসেছে। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে যেমন রোমাঞ্চকর, তেমন চ্যালেঞ্জিং। প্রক্রিয়া এবং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য অপরিহার্য একটি অস্তিত্ব। গঠনমূলক এবং ইতিবাচক সাংবাদিকতা দিয়ে একটি সমাজকে বদলে দেয়া সম্ভব। উচ্চশিক্ষিত এবং সৃজনশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব সাংবাদিকতার মূল্য অনুধাবন এবং আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করার। প্রতিদিনের রুটিন বা গতানুগতিক সাংবাদিকতার কাজ হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিবিহীন সাংবাদিকদের দিয়ে চালিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র এবং সমাজের চাহিদার আলোকে গভীর অনুসন্ধানমূলক এবং ব্যাখ্যামূলক সাংবাদিকতা করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচির ভেতর দিয়ে না এসে উপায় নেই।

যোগাযোগ প্রক্রিয়ার অন্যতম টুল হিসেবে সাংবাদিকতার শক্তি উপলব্ধি করতে হলে যে লেখাপড়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া ফরজ, সেটি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একটি বিভাগেই সম্ভব। সাংবাদিকতার মূল শক্তি নিহিত থাকে ইন-ডেপথ টাইপ প্রতিবেদন প্রচার বা প্রকাশের মধ্যেই। নানা বিষয়ে অনুসন্ধানি হতে হলে আগে সমাজ এবং বিশ্বকে চিনতে হয় সঠিকভাবে। আর এ পরিচিতি এবং সম্যক অনুধাবন আসতে পারে কেবল পদ্ধতিগত পড়াশুনার মাধ্যমে। গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে চমৎকার সব প্রতিবেদন তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

সাংবাদিকতার ধারণাসমূহ, বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বাংলাদেশের প্রাচীন এবং সমকালীন ইতিহাস, মিডিয়া সমাজ ও সংস্কৃতি, তত্ত্ব এবং ব্যাবহারিক নানা কোর্স, বৈশ্বিক গণমাধ্যম ব্যবস্থা, গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি, জেন্ডার ও যোগাযোগ, পদ্ধতিগত অনুসন্ধান, ইত্যাদি নানা বিষয়ে পারদর্শী হয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র-ছাত্রীরা যখন সাংবাদিকতা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওন, তখন একেকটি প্রতিবেদন নতুন মাত্রা লাভ করে। সাংবাদিকদের সর্ববিষয়ে কিছু না কিছু ধারনা রাখতেই হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই সাংবাদিকতার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে যথেষ্ট বিস্তৃত লেখাপড়া করানো হয়। দক্ষতা এবং জ্ঞানের মিশেলে একেকজন গ্র্যাজুয়েট তাই সহজেই তাই মূলধারার সাংবাদিকতায় নিজেদের মেলে ধরতে পারে।

সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা জরুরি বলেই, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট এবং নানা দেশি-বিদেশী প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকরা ডিপ্লোমা এবং মাস্টার্সসহ নানা কোর্স সম্পাদন করে থাকেন। সাংবাদিক সমিতিগুলো নানা সময়ে ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। সাংবাদিকতা পেশার মূল্য বুঝে এখন সময় এসেছে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করার। সাংবাদিকতা পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি নানা বিধি-নিষেধ জারি করে এ পেশায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সাংবাদিকতার উপর ডিগ্রি নেই, কিন্তু অন্য বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক। আবার সাংবাদিকতার উপর ডিগ্রি নিয়েও অনেকে এ পেশায় আসে না। কিছু মানুষ আছে, যারা সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এ পেশায় এলেও বেশি একটা সুবিধা করতে পারেন না। যাইহোক, যারাই সাংবাদিকতায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইবে, তাদের একটি বিশেষ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আসা উচিত। যেমন উকিল হতে হলে নানা স্তরের পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও এমন পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নানা স্তরের পরীক্ষা পাশ করলেই কেবল কোন ব্যক্তি সাংবাদিক হওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন জমা দিতে পারবে। যেমন স্কুল-কলেজে টিচার হতে গেলে নিবন্ধন পাশ করতে হয়।

সময় এসেছে ঢাকার এবং মফস্বলের সাংবাদিকদের জন্য মিনিমাম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়ার। ওয়েজ বোর্ড শুধু ঘোষণা করলেই হবে না। বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা করতে হলে সবার আগে ঐক্যমতে আসতে হবে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের। হাজার হাজার সংবাদমাধ্যমের আমাদের দরকার নেই। মানসম্মত, ভালো মজুরি প্রদানে সক্ষম এমন সংবাদমাধ্যমগুলোই শুধু কার্যকর থাকার অধিকার রাখে।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :