জহুরুলের স্বপ্নের বিদ্যালয়

জাভেদ হোসেন, গাইবান্ধা
 | প্রকাশিত : ১২ অক্টোবর ২০১৭, ২০:১৩

জহুরুল ইসলামের বয়স যখন ১০ বছর। তখন দেশের আর দশটা বাচ্চার মতো তার হাতেও থাকার কথা ছিল বই, খাতা আর কলম। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সেই বয়সে তারও পড়ার কথা ছিল চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে। কিন্তু দুর্গম চরাঞ্চলের ৫-৬ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় হতদরিদ্র পিতা মাঝি শাহ আলীর প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তি করান সম্ভব হয়নি। তাই ২০১২ সালে বই, খাতা আর কলমের বদলে সংসারের আয় উপার্জনের লক্ষ্যে দরিদ্র পিতার সাথে যমুনার উত্তাল নদীতে মাছ ধরার জন্য জহুরুল হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয় মাছ ধরার জাল আর নৌকার বৈঠা।

২০১৩ সালে মাঝি শাহ্ আলীর বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে এলাকাবাসীর উদ্যোগে গড়ে ওঠে একটি বিদ্যালয়। তিনি জহুরুলকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ১১ বছর বয়সে ২০১৩ সালে জহুরুলকে তিনি সেই স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন। ২০১৭-তে এসে বর্তমানে জহুরুল সেই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির মেধাবী একজন ছাত্র। এখন আগামী পিএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে দরিদ্র পিতা-মাতার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখছে জহুরুল।

বলছিলাম, গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার ফুলছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চল খঞ্চাপাড়া চরের কথা। স্কুলের নাম খঞ্চাপাড়া আনন্দলোক বিদ্যালয়। শুধু একজন জহুরুল নয়, এরকম ১৭৭ জন জহুরুলের অলিখিত গল্প বুকে ধারণ করে দুর্গম এই চরে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে চারশত পরিবারের স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ খঞ্চাপাড়া আনন্দলোক বিদ্যালয়।

স্থানীয় শিক্ষানুরাগী শহিদ আলী শেখের দানকৃত ৬৬ শতক জমির ওপরে নেটজ বাংলাদেশের সহযোগিতায় এবং বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গণউন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালনায় ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে এই বিদ্যালয়।

বিদ্যালয়ের ছিমছাম পরিপাটি সবুজ টিনের চারটি কক্ষের একটি কক্ষ অফিস-রুমের জন্য ও বাকি তিনটি কক্ষ ক্লাস-রুমের জন্য ব্যবহার করা হয়। মোট দুই শিফটে চলে স্কুল। শিশু শ্রেণি, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণি চলে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আর দুপুর ১২টা ২০ মিনিট থেকে বিকাল ৪টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত চলে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। মোট তিনজন শিক্ষকের মধ্যে দুইজন পুরুষ ও একজন নারী। এছাড়াও বিদ্যালয়ের আনুসাঙ্গিক কাজ সম্পাদনের জন্য নিয়োগ করা আছে একজন আয়া এবং সামনের পিএসসি পরীক্ষায় যাতে ভালো ফলাফল হয় এ উদ্দেশ্যে সম্প্রতি একজন খণ্ডকালীন শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়েছে।

এখন দুর্গম চরাঞ্চল খঞ্চাপাড়ায় সন্ধ্যা নামলেই এক নতুন দৃশ্যের অবতারণা হয়। এক হাতে লন্ঠন আর এক হাতে বই-খাতা নিয়ে পিএসসি পরীক্ষার্থীরা একে একে ছুটতে থাকে বিদ্যালয়ের দিকে। সন্ধ্যায় লন্ঠন হাতে বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার এই দৃশ্য খঞ্চাপাড়াবাসীর কাছে একেবারেই নতুন। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলে পিএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা প্রস্তুতি। পড়া শেষে যাদের বাড়ি এক বা দেড় কিলোমিটারের মধ্যে তারা রাতের অন্ধকার ভেদ করে তেল ফুরিয়ে আসা লন্ঠনের টিমটিম করা মৃদু আলোয় চরের দুর্গম পথকে অতিক্রম করে বাড়ি ফেরে; আর যাদের বাড়ি কিছুটা দূরে, তারা বাটি বা ছোট গামলায় নিয়ে আসা রাতের খাবার খেয়ে আলো ও ফ্যানবিহীন স্কুলের বেঞ্চ বা মেঝেতে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় বাকি রাত।

খঞ্চাপাড়া আনন্দলোক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জাহিদুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে জানান, এবার ২৪ জন পরীক্ষার্থী আমাদের স্কুল থেকে পিএসসি পরীক্ষা দেবে। আমরা যেভাবে তাদেরকে প্রস্তুত করছি তাতে আমরা আশাবাদী ১০ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পাবে এবং পাশের হার থাকবে শতকরা একশ ভাগ।

এই আশার বাণীর পাশাপশি আছে একটি নিরাশার বাণীও। এই দুর্গম চরটিতে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে এই শিক্ষার্থীগুলো যদি কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তবে তাদের যেতে হবে ৮ কিলোমিটার দূরের জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার মন্নিয়ার চরে বা ৯-১০ কিলোমিটার দূরের গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা বা ফুলছড়ি উপজেলায়। এই দুর্গম বালুচরের পথ অথবা স্কুলের টাইমের সাথে তাল ঠিক না থাকা নৌকোর সময় হয়তো বা তাদের জীবনে হাইস্কুলে ভর্তি হবার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। জহুরুল হয়তো বা পঞ্চম শ্রেণি পাস করবে ঠিকই, কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে দরিদ্রতার কাছে হার মেনে বাস্তবতার কশাঘাতে তাকে আবার বই ফেলে হাতে তুলে নিতে হবে মাছ ধরার জাল আর নৌকার বৈঠা।

এটা শুধু একজন জহুরুলের গল্প নয়, এটা গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার পুরো খঞ্চাপাড়ার গল্প।

এই অবস্থা উত্তরণে স্থানীয়দের কণ্ঠে ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে, আমরা কজন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে।’ গানের মতো শক্তি এবং সাহস থাকলেও স্থানীয়দের অগ্রণী ভূমিকার পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা এবং এগিয়ে আসা উচিত দেশের সামর্থবান সচেতন নাগরিকদের।

(ঢাকাটাইমস/১২অক্টোবর/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :