আদনান কেন নিজেকে হত্যা করল?

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ২০:৩৪ | প্রকাশিত : ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:৫৮

শেষ পর্যন্ত হয়ত শুধু মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের দুঃখময় স্মৃতি হয়ে থাকবে আদনান। খুব কাছের বন্ধুরা হয়ত কখনো কখনো আদনানের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। পরিচিত ছোট ভাই, বড় ভাই, বন্ধুরা অন্য কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা উপলক্ষে হয়ত আদনানের ঘটনা উল্লেখ করবে। এ ছাড়া আর কী হবে? ইনডিভিজুয়ালিজমের যুগে মানুষের কি এত সময় আছে একজন আদনানকে নিয়ে ভাবার? অথচ আমরা এমন একটি সমাজ চেয়েছিলাম যেখানে সবাই সবাইকে নিয়ে ভাববে, ভালোবাসবে, সংকটের সময় একে অপরের পাশে দাঁড়াবে, একজন আরেকজনের দুঃখ কমিয়ে দেবে!

ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত জাহাঙ্গীরনগর। লাখ লাখ মানুষ ক্যাম্পাসে। হলের ছেলে-মেয়েদের বড় একটা অংশ নিজেদের রুমগুলো চেনা-অচেনা পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের জন্য ছেড়ে দিয়ে নির্ঘুম রাতগুলো পার করছিল। ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছে গাইড বই বেঁচে টু-পাইস কামানোয় ব্যস্ত এক দল। চুলের ফিতা থেকে শুরু করে হেন কোনো পণ্য নেই যা নিয়ে দোকানীরা দোকান সাজিয়ে বসেনি। যেন বিশাল এক মেলায় পরিণত হয়েছে ক্যাম্পাস।

শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা ব্যস্ত ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে। প্রশাসন ব্যস্ত সকলের নিরাপত্তা বিধানে। এই কর্মযজ্ঞেরই ফাঁকে নিজকক্ষের সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে মীর মশাররফ হোসেন হলের বাসিন্দা, একাউন্টিং বিভাগের ৪১তম আবর্তনের ছাত্র আদনান। ক্যাম্পাসের অনেকের সাথে আমার পরিচয় থাকলেও আদনানের সাথে ছিল না। ছবি দেখে মনে হল- এমন সুন্দর, স্মার্ট ছেলেটি কীভাবে নিজেকে হত্যা করতে পারে? আত্মহত্যা করা সহজ কাজ নয়। নিজেকে দড়িতে ঝুলিয়ে, বিষ পান করে, উঁচু ভবন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সাগর-নদীতে ডুবে মানুষ আত্মহত্যা করে। ঠিক কী পরিস্থিতি হলে মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাস্তবায়ন করে?

আদনানের নিশ্চয় ক্যাম্পাসে অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। ৪১তম ব্যাচ। অনার্স, মাস্টার্স কিংবা বিবিএ, এমবিএ শেষ করে হয় এরা রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে অথবা রেজাল্ট নিয়ে চলে গেছে। একাউন্টিং বিভাগের কী অবস্থা জানি না, তবে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের রেজাল্ট দেয়ার তোরজোর চলছে। এই আবর্তনের ছাত্র-ছাত্রীদের সিংহভাগই প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে আশে পাশে অস্থায়ী কোনো বাসা খুঁজে নিয়েছে। আদনানরাই ছিল ক্যাম্পাসের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচ। কত স্মৃতি, কত ঘটনা এই সবুজ ক্যাম্পাসে। কিন্তু নিয়ম মেনে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতেই হবে সবাইকে। কারণ জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি পরিবার ও রাষ্ট্র-সমাজকে কিছু দেয়ার তাগিদ থাকে, আছে অনেক বড় মানুষ হওয়ার হাতছানি। ক্যাম্পাস না ছেড়ে উপায় থাকে না। কিন্তু আদনান তো পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছে! কেন?

আদনানের ছবি দেখে তো মনে হয় না, কোনো পরাজিত কিংবা হতাশ মানুষ ছিল সে। আর যে অনুষদের ছাত্র ছিল সে, সেখানে বৈরাগী হওয়ার সুযোগ থাকার কথা না। বাণিজ্য অনুষদ; সেমিস্টার সিস্টেম; এসাইনমেন্ট আর প্রেজেন্টেশনের ঘনঘটা। ফর্মাল পোশাকে প্রেজেন্টেশন দিতে দিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাস জীবনেই কর্পোরেট অবয়ব এবং কম-বেশি কর্পোরেট স্বত্বা অর্জন করে। সবার সামনে থাকে বড় বড় অফিসে মোটা বেতনে চাকরি করার হাতছানি। খুবই ক্যারিয়ার-অরিয়েন্টেড একটা অনুষদ। আদনানের তো কদিনের মধ্যেই কোন বড় ব্যাংক বা কর্পোরেট অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক অফিসে কর্মব্যস্ত সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা কাটানোর কথা। তবু কেন আদনান নিজেকে মেরে ফেলল? কী কারণে আদনান চলে গেল না ফেরার দেশে?

আদনান কি ক্যাম্পাসে কোনো মেয়েকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসত? হৃদয় দিয়ে ভালোবাসা আর মগজ দিয়ে ভালোবাসা এক নয়। ভালোবাসার সেই মানুষের সাথে কি আদনান সফলভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিল? এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে মানুষ আত্মহত্যা করে। এ প্রবণতা বেশি দেখা যায় স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। প্রেম-ভালোবাসা এমন জিনিস যে, আপনাকে গড়েও দিতে পারে আবার ধ্বংসও করে দিতে পারে।

শুধু মগজ দিয়ে যারা চলে এদের জীবনে খুব বেশি অসুবিধা হয় না। লাভ-ক্ষতি হিসেব করে চলে মগজধারীরা। কিন্তু যাদের মগজের চেয়ে হৃদয় বেশি একটিভ সমস্যা তাদেরই বেশি। মন দিয়ে, হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে গিয়ে বন্ধু-বান্ধব, হলমেট, রুমমেট সবার কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে প্রেমিক-প্রেমিকারা একা হয়ে যায়। দুজন দুজনাতে এমনই ডূব দিয়ে থাকে যেন পৃথিবীর অন্য মানুষ, এমনকি নিজের বাবা-মাকে পর্যন্ত বেগানা মনে হয়। খেলার মাঠ, ডাইনিং, ক্যান্টিনে, খোলা আড্ডায় এদের দেখা যায় খুব কম। সকালের নাস্তা পর্যন্ত অন্যদের সাথে করে না অনেক জুটি। একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয় পড়ে দুজন। কিন্তু যখন কোনো কারণে মধুর সম্পর্কে তিক্ততা আসতে শুরু করে, তখনই বাস্তবতা পাল্টে যায়। কোনো কোনো বন্ধুও তখন টিপ্পনী কাটতে শুরু করে। কেউ ভালো কিছু বললেও প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে মনে হয়, তাদেরকে অপমান করা হচ্ছে। অনেক ‘সাহসী’ প্রেমিক-প্রেমিকা পুরনোকে ফেলে দিয়ে নতুনকে আঁকড়ে ধরে। নতুনের আগমনে নতুন গল্প জন্ম নিলেও পুরনো সম্পর্ক অনেকের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সম্পর্কের এই ভাঙ্গাগড়ার ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা বিশ্বের সর্বত্র ঘটে চলেছে। তবে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন কিছু হলে তার প্রতিক্রিয়াগুলো খুব দ্রুত এবং দৃশ্যমান হয়। নিজের ব্যর্থতা বা সাফল্য কোনটাই ক্যাম্পাসে গোপন রাখা যায় না। প্রেমঘটিত বিষয়ে তাই কোনো ‘ব্যর্থতা’ ছেলে-মেয়েদের জীবনে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। আদনানের বিষয়ে এমন কিছু ঘটেছিল কি না, এটা তার কাছের মানুষজন বলতে পারবে। আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। তবে না জেনে, কোনো গুজবে বা অপপ্রচারে কান দেয়া যাবে না। আর প্রেম-ভালোবাসা চিরঞ্জিব, সার্বজনীন। বন্ধ হবে না কোনোদিন। তবে আরেকজনকে ভালোবেসে ‘ব্যর্থ’ হয়ে নিজেকে হত্যা না করে বরং নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে পারলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

আদনানকে যদি কোনো নারী এভাবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়ে থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। অনেক ছেলেও বহু ঘটনায় মেয়েদের সাথে প্রতারণা বা বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হয়। সেক্ষেত্রে ভিকটিম মেয়েদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আদনান কী কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল, তার অনুসন্ধান দরকার আছে। সমাজে কেউ না কেউ হয়ত নতুন করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আত্মহত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

কেউ পছন্দের জামা না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, কেউ পরীক্ষায় ভালো ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করছে, কেউ ক্ষুধার জ্বালায় টিকতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। কেউ কোন কলঙ্ক থেকে বাঁচতে, কেউ কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অসহায় হয়ে আত্মহত্যা করছে। কেউ নিজের প্রাপ্য ন্যায়বিচার না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। প্রতিবেশী ভারতে কৃষক সার-পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করে। বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতা থেকে মানুষ আত্মহত্যা করে। ইন্টারনেটে নীলতিমি নামক গেমস খেলতে গিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে। মা-বাবার ভালোবাসামাখা বকুনি খেয়েও অনেক হতভাগা-হতভাগী আত্মহত্যা করে। ক্লাসে শিক্ষকের কথায় অপমানিত বোধ করেও অনেকে আত্মহত্যা করে। কেউ অন্যকে সবক শেখাতে গিয়ে নিজেকে হত্যা করে। আত্মহত্যার কারণ অনেক। কোনোভাবেই আত্মহত্যা থামানো যাচ্ছে না।

তবে আমরা আত্মহত্যা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি। মানুষের সংকটের সময় যদি তার কাছাকাছি থাকা যায় তাহলে কষ্ট কমিয়ে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু মানুষের কাছাকাছি থাকতে পারা এত সহজ নয়। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। অনেকে আছেন, নিজস্ব মামলায় অন্যের আগ্রহ ভালো চোখে দেখে না। বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষের সমাজে এই সমস্যা বেশি। শিক্ষিত মানুষ পারফেক্ট হতে গিয়ে অদ্ভুত সব আচরণ করে।

তবে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে ইতিবাচকভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে শিক্ষকদের। ছাত্র-ছাত্রীরা চায়ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে। অনেকক্ষেত্রে শিক্ষকরা দূরত্বের উঁচু দেয়াল দিয়ে রাখেন। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের গুটিয়ে রাখে। রাস্তাঘাটে, বিভাগের বারান্দায়, ক্লাসরুমে, খেলার মাঠে, মসজিদে, বাজারে দেখা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের হালচাল জিজ্ঞেস করলে, পড়াশুনার ফাঁকে একটু জীবনের গল্প করলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই নিজেদের প্রস্তুত করে নিবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে হয়ত অনেক শিক্ষক খুবই ছাত্রবান্ধব। আবার অনেক শিক্ষক আছেন যারা মেশিনের মত আচরণ করেন। কিন্তু সবাইকে বদলানো যাবে না। তাই দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি মনোচিকিৎসক নিয়োগ দেয়া যায় তাহলে ভালো হয়।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি বিভাগে ছাত্রউপদেষ্টার একটা পদ আছে। ছাত্র-উপদেষ্টারা সব বিভাগে সমানভাবে সক্রিয় কি না, সেটা প্রশাসন থেকে ভালো করে নজরদারী করতে হবে। তবে আমি মনে করি, হলগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশী শক্ত হওয়া উচিত। ছাত্র-ছাত্রীরা হলেই বেশি সময় কাটায়। হলগুলোতে মনোচিকিৎসক বা পরামর্শক নিয়োগ দিতে পারে প্রশাসন। তাছাড়া বিভাগে, হলে, ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দেয়া উচিত। পড়াশুনা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্ম ও জীবনযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ছাত্র-ছাত্রীরা একটা সমাজ নিয়ে বাস করতে বাধ্য হবে। একা থাকবে না। আত্মহত্যা করার সুযোগও তখন পাবে না খুব একটা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :