ঢাকার ফুটপাতে শিক্ষিত হকার

কাজী রফিকুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:৩৩

রাজধানীর ফুটপাত দখল করে তাদের দোকান-পাট, ব্যবসা। চিত্রটি বেশ পুরনো। দুই সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি নিয়ে বেশ উঠে পড়ে লাগলেও সফল হতে পারেননি কেউই। পুরোনো যারা হকার ছিলো তারাতো আছেই, প্রতিদিনই গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন ফুটপাতের দোকান। কিন্তু এরা আসলে কারা? কোত্থেকে এসে ঢাকার ফুটপাতে আস্তানা গাড়ছে? ভেবে দেখেছেন কখনো?

গুলিস্তান, ফার্মগেট, নিউমার্কেট ও মিরপুর-১ নম্বর এলাকাজুড়েই তাদের মতন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেশি ছিল। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের হস্তক্ষেপে এদের অনেককেই ফুটপাত ছাড়তে হয়েছে। তারপরও তারা রাজধানীর বুকে সন্ধ্যা নেমে আসতেই, রাজপথে নেমে আসেন। কারণ একটাই জীবিকার তাগিদ।

শুনলে আশ্চর্য হবেন ফুটপাতের হকারদের অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে। তাদের কারো কারো রীতিমত চাকরি করার অভিজ্ঞতাও আছে। কোনো কারণে চাকরি হারিয়ে বা চাকরি পাননি, তাই নেমে এসেছেন ফুটপাতে। নাম লিখিয়েছেন হকারির খাতায়। অনেকেই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রয়েছে স্নাতক ডিগ্রী, স্নাতকোত্তরের সনদ পাবার অপেক্ষায় আছেন কেউ কেউ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত ফুটপাতের হকারিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন এমন কারো কারো দেখাও মিলেছে অনুসন্ধানে।

ভেজাল বাধলো সাংবাদিক পরিচয়ে তাদের সাথে কথা বলতে চাইলে। অনেকেই বেঁকে বসলেন। কথা বলতে চাইলেন না। এ সময় রেগে গিয়ে রীতিমত এই প্রতিবেদককে মারতে আসেন মোহাম্মাদপুর শিয়া মসজিদ এলাকার একজন প্যান্ট বিক্রেতা। প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন "সরকার বহুত করছে আমাদের জন্য, আর এরাও করবে। ভাতের কষ্টে পারি না রিক্সা চালাই। আর ইনি আইছেন আমাদের ফটো তুলতে। মজাই লাগে, না? এতো দয়ার দরকার নাই। যান, অন্যখানে যান।" কথাগুলো বলে দোকান ছেড়ে চলে যান ফুটপাতের সেই ব্যবসায়ী। পরে অন্যান্য হকারদের সাথে কথা বলে যানা গেল তার নাম রাশেদ। ভোলা জেলা থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকায় এসেছিলেন কয়েক বছর আগে। চাকরির জন্য ঘুরেছেন দুই বছর ধরে। জোটাতে না পেরে অবশেষে বাধ্য হয়ে নেমেছেন ফুটপাতে। হকারি করলেও সেটা কাউকে জানাতে চান না খুব সম্ভবত। তাই তার প্রতিক্রিয়াটা একটু আক্রমণাত্মক।

অনেকেই আবার এর ব্যতিক্রম। তাদের এসবে কিছুই যায় আসে না। ফুটপাতে হকারি করতে খারাপ লাগে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ বললেন "চুরিতো করি না, ডাকাতিতো করি না। ফুটপাতে হকারি করি, ব্যবসা করি। সমস্যা কোথায়?"

এদেরই একজন আসিফ আজাদ। ময়মনসিংহ জেলা থেকে কয়েক বছর আগে রাজধানীতে পাড়ি জমিয়েছেন আসিফ আজাদ। চাকরি নামের মায়া হরিণের পেছনে ছুটে ক্লান্ত হয়ে শেষে হকারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন বছর খানে হলো। ময়মনসিংহের একটা আলিয়া মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। পরিবারে অভাব আর অভাব। শেষে পরিবারের আর্থিক অনটন কমাতেই বেছে নিয়েছেন এই পেশা। ভ্যানগাড়িতে শার্ট বিক্রি করেন আসিফ। আসিফ বললেন "আমার পরিবারের অবস্থা ভালো না। দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৮৮ পেয়েছিলাম। ইন্টারে ভর্তি হয়েছি। পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছিলাম না আর। সংসারের জন্য ইনকাম করারও দরকার হয়ে পড়ে। তাই ঢাকায় এসে এই কাজ করছি। চাকরির অনেক চেষ্টা করেছি ভাই। কেউ দেয় না। ঢাকায় চাকরির জন্য রেফারেন্স লাগে। আমাকে কেউ চেনে না, রেফারেন্স কে দিবে? তাই বাধ্য হয়ে এটাই করছি। বাড়িতে মিথ্যা কথা বলেছি, তারা জানে আমি এক অফিসে চাকরি করি।"

একই ফুটপাতে আরেকজন হকারের সাথে কথা হলো। তিনি অবশ্য এখনও পড়ালেখা শেষ করেননি। তবে শেষ হবার পথে। নিউমডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ স্নাতক ডিগ্রি হাসিলের উদ্দেশ্যে এখনো পড়ছেন আসাদুজ্জামান রাজু। পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে পার্টটাইম একটা চাকরি খুঁজেছেন অনেক। না পেয়ে পড়ালেখার ফাঁকে ফুটপাতেই তৈরি করে নিয়েছেন নিজের খরচের সংস্থান। হকারি করে যা রোজগার হয় তাই দিয়েই পড়ার খরচ চালাচ্ছেন তিনি। রাজু বলছিলেন, "চাকরির বাজার ভালো না সেটা আমিও জানি। সুপারশপ, কল সেন্টার সব জায়গায় চেষ্টা করেছি। চেষ্টা এখনো চলছে। কিন্তু জব পাওয়া কি এতই সহজ? তাই যত দিন না পাই এটাই করছি। অনেক সময় বিব্রত হতে হয়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, ক্লাসমেট, ফ্রেন্ড অনেকেই এ পথে আসে যায়। তারা আমাকে দেখলে লজ্জা পায়, কথা বলে না। তখন একটু না, অনেক খারাপ লাগে। কি করবো? কিছু করার নাই।"

শাহবাগ মোড়ে দেখা হয়ে গেলো মোহাম্মদ মিলনের সাথে। তিনি ফুটপাতে বই আর বাহারি টুপি বিক্রি করেন। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর চারুকলার ছাত্ররাই তার দেশি-বিদেশি ম্যাগাজিন, ইংরেজি উপন্যাস, জার্নাল, রেফারেন্স বই, বাংলায় লেখা গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, শিশুসাহিত্য, নামি-দামি লেখকের বইয়ের অনুবাদের মূল ক্রেতা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন, বিশ্ববিখ্যাত বইয়ের বাংলা অনুবাদসহ দেশি-বিদেশি ক্যাটালগও বিক্রি করেন তিনি। পাওয়া যায় আত্মোন্নয়নমূলক নানান রকম বইও। বোঝাই যায় নিজেই বেছে বেছে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করেন এসব। ফুটপাতের ব্যবসা নিয়ে বললেন-"আমিতো মনে করি পৃথিবীর কোনো কাজই ছোটো না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি চুরি বাটপারি করছেন। পড়ালেখা শেষ করে চাকরির খোঁজ করেছি, পাইনি। বড় ব্যবসা করতে বড় পুঁজি লাগে, সেটাও নেই। তাই ফুটপাতে বই বিক্রি করে সংসার চালাই। আমার পরিবারের লোকজন জানে আমি কি করি, তাদেরও এটা নিয়ে কোনো রকমের চুলকানি নেই। আত্মীয়-স্বজনরা কেউ কিছু বললে তাদের সাথে যোগাযোগ অফ করে দিই। ব্যস হয়ে গেলো। ফুটপাতে হকারি করি বলে আমাকে কেউ ছোটো করে দেখবে এটাতো তার সমস্যা।"

এই শিক্ষিত হকারদের কেউ কেউ জানালেন তাদেরই চেনা জানা অনেক মানুষ চাকরি খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেছেন গ্রামে। বেকার বসে আছেন কিন্তু নিজের উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করছেন না। তারা মনে করেন বরং বেকার বসে থাকাটাই লজ্জার ব্যপার। চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে নিজের যোগ্যতায় কিছু করার মতন সাহস তারা দেখিয়েছেন এবং এটা নিয়ে তাদের বেশিরভাগেরই কোনো লজ্জা নেই। তবে তাদের একটাই দাবি, সরকার যেন কথায় কথায় ফুটপাত দখলমুক্ত করার নামে তাদের পেটে লাথি না মারে। কিছু করতে না পেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বলেই তারা ফুটপাতে জীবিকা খুঁজেছেন। বিষয়টা আইনের চোখে হয়তো সরল নয়, কিন্তু তাদের জীবন সংগ্রামও মিথ্যা নয়। যত যাই হোক, শখ করে কেউ পুলিশের লাঠির বাড়ি খেতে ফুটপাতে আসে না।

ঢাকাটাইমস/১৪অক্টোবর/কারই/কেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :