অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৪৫

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৪৯

সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে শীতল বিরোধের সূচনা হয় এক বছরের মাথায়। তিনি আমার উপর প্রথম বিরক্ত হন ১৯৯১ সালে তার ব্রিফ মতো পত্রিকার কাভার করতে আপত্তি করায়। তবে সঙ্গত কারণেই মালিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কর্মচারীর আপত্তি টেকার কথা নয়; টেকেওনি। কিন্তু কর্মচারীর ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। মালিকের সঙ্গে দ্বিতীয় বিরোধ হয় বরিশালে সুগন্ধার ব্যুরো চিফ নিয়োগ নিয়ে। এ পদের জন্য লবিং করছিলেন কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল। কিন্তু আমি তার বিরোধী ছিলাম। তবে আমার এ বিরোধিতাও শেষতক টেকেনি। ঠেকাতে পারিনি কাজী বাবুলকে; তাকে কেউ ঠেকাতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু এখন পর্যন্ত তার যে ইতিহাস জানা গেছে, তাতে বারবার সংকটে পড়লেও অদম্য মনোভাবে এবং সনাতনী এক উপকরণে ভর করে আবার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন কাজী বাবুল। বরিশালে নেতিবাচক ইমেজের কারণে সুগন্ধার ব্যুরো চিফ হিসেবে তার নিয়োগের বিরোধিতা করেছিলাম। এ বিরোধিতা আমার প্রতি সৈয়দ মোয়াজ্জমের চরম অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা ছিলো ১৯৯১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রচ্ছদ করা নিয়ে তার বক্তব্য না মানার চেষ্টা করার ‘অপরাধের’ চেয়েও তীব্র। কাজী বাবুলের ইচ্ছা পুরনের কৌশলের এতোই জহুরা!

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ সরকারের পতনের পর আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। এরশাদ সরকারের পতনের পর প্রায় সকলেরই ধারনা সৃষ্টি হয়েছিলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে। কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে এলিট মহলে দৃঢ় ধারণা ছিলো, আওয়ামী লীগই বসবে মসনদে; কেবল নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মন্ত্রী হবার স্বপ্নে শুধু বিভোর হননি, মন্ত্রী হিসেবে পছন্দের বাড়িটি অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। একই সাথে নেতাদের বাসায় লেগে থাকলো কর্মীদের ঠাসাঠাসি ভিড়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে- অন্যান্য মিডিয়ার মতোই সাধারণ এ পারসেপশনের সঙ্গে গা ভাসালো সাপ্তাহিক সুগন্ধা; গড্ডলিকা প্রবাহ! সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সুগন্ধার ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় আওয়ামী লীগের জয়-জয়কারের খবর প্রকাশিত হলো। এ খবরের সঙ্গে সকলেই একমত ছিলেন। একমাত্র দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন সংবাদিক আলী মামুদ। এনিয়ে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও ছিলো।

কিন্তু তার জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা শোনার কোন আগ্রহ আমাদের ছিলো না। কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন মাসুদ কামাল। সে নিজে যেমন কথা বলতে ভালোবাসে, তেমনই অন্যের কথা শোনারও অদ্ভূত ধৈর্য আছে তার; তা অতি উদ্ভট হলেও! যে কারণে সুগন্ধা হাউজে আলী মামুদ একমাত্র মনোযোগী শ্রোতা পেয়েছিলেন মাসুদ কামালকে। আমরা মনে করতাম, মামুদ ভাই গঞ্জিকায় অনুরক্ত হয়েছেন অথবা তিনি গাঁজার বাগানের পাশ দিয়ে নিয়মিত চলাচল করছেন। ফলে তার কথা বিবেচনায় নেয়া তো দূরের কথা, কানেও নিতাম না। সে সময় ভোট গ্রহণের চার দিন আগে বাজারজাত করার জন্য নির্ধারিত সুগন্ধার কাভার স্টোরি তৈরির কাজ করছিলো পুরো টিম, অনেকটা ঈদের উৎসবে। পত্রিকা প্রকাশের নির্ধারিত তারিখ ছিলো ২৫ ফেব্রুয়ারি। নির্ধারিত সময়ের অন্তত দুই দিন আগে পত্রিকা মার্কেটে যেতো।

৯১ এর সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় মাথায় রেখে প্রচ্ছদ রিপোর্ট তৈরি করার মূল দায়িত্ব পালন করেছিলো ছাত্রশিবিরের হাতে নির্যাতিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণে বেঁচে আসা শওগাত আলী সাগর। সম্ভবত তার সঙ্গে ছিলেন শহিদুল আজম। এরা কাজপাগল। আর সাধারণ এ প্রবণতাকে ছাপিয়ে গিয়ে শওগাত আলী সাগর সবটুকু আবেগ ও পরিশ্রম দিয়ে উল্লেখিত আইটেম তৈরি করেছিলো। এদিকে প্রচ্ছদ রিপোর্টের সহায়ক আইটেম তৈরি করলেন নঈম নিজাম (মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক), কাজী আবদুল হান্নান, সন্তোষ শর্মা, খায়রুল আলম বকুল, মুজাহিদ মোস্তফা (মোস্তফা কামাল), দেবাশীষ সান্যাল, ফারজানা রহমান ঝুমাসহ আরো অনেকে। উল্লেখিত সংখ্যাটির ৮০ শতাংশ ছিলো সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক। যাতে তুলে ধরা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয়ের জোর সম্ভাবনার কথা।

সুগন্ধার উল্লেখিত সংখ্যাটির সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। প্রচ্ছদের জন্য ছবি আকার কাজও শেষ করেছেন কামাল পাশা চৌধুরী। অন্যান্য কাজ শেষে কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা নাগাদ পত্রিকা ছাপার জন্য যাবে প্রেসে- এমন প্রস্তুতিতে দ্রুত গতিতে আগাচ্ছিলো সকল কাজ। পেস্টিং-এর কাজ শুরু করে দিয়েছেন ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘ববিতার চেয়েও বেশি ব্যস্ত’ শাহাদত হোসেন; কাজের সময় হাতের সঙ্গে তার মুখও চলে সমানতালে। সব কিছু চলছিলো দারুন এক ছন্দে। কিন্তু ছন্দপতন ঘটলো দুপুরে একটু পরে মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন যখন আমাকে তার রুমে ডাকলেন। প্রডাকশনের দিন তিনি যা সাধারণত করেতেন না। ফলে তার ডাকে বিরক্তির পাশাপাশি অবাকও হয়েছিলাম। আরো অবাক হলাম যখন তিনি প্রচ্ছদ দেখতে চাইলেন। প্রথমে মনে হলো, ভুল শুনেছি। দ্বিতীয় বার বলায় বুঝলাম, না ঠিকই শুনেছি; তিনি প্রচ্ছদ দেখতে চাইছেন। যা তিনি এর আগে কখনো করেননি। তার কথায় বিরক্ত হয়ে আমার টেবিল থেকে অফিস সহকারী মিলনকে প্রচ্ছদের ছবিটি আনতে বললাম।

মিলন প্রচ্ছদের ছবি নিয়ে আসলো। তখনো আমার চায়ের কাপ শেষ হয়নি। এরপরও মোয়াজ্জেম সাহেব আমাকে কোক দিতে বললেন। বিষয়টি আমার বিস্ময় ও বিরক্তির উদ্রেক করে। আর বিরক্তি সকল সীমা ছাড়ালো, যখন তিনি কাভার স্টোরি বদল করার আবদার করলেন। তিনি বললেন, “আলম রায়হান, আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপির বিজয়ের সম্ভাবনার কথা বলতে হবে।” তার এ কথা শুনে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। কারণ দুটি। এক. সৈয়দ মোয়াজ্জেমের প্রস্তাব আমাদের সকলের বিবেচনায় বাস্তবতার বিপরীত। দুই. শেষ মুহুর্তে সাপ্তাহিক পত্রিকার রিপোর্ট উল্টে ফেলা খুবই কঠিন; যেখানে সংশ্লিষ্ট সকল কাজই করাতে হয় অন্য প্রতিষ্ঠানে। তার ইচ্ছাপূরণে নানান প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরলাম। রেগে গিয়ে এমনও বললাম, এমন করলে এক সপ্তাহ পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে! মোয়াজ্জেম সাহেব অধিকতর শান্তভাবে বললেন, ‘তাতে আপনারা কেউ বেকার হবেন না; আমি আপনাদের চালিয়ে নেবো।’ মানে সে নাছোরবান্দা। শেষ চেষ্টা হিসেবে বললাম, কামাল পাশা চৌধুরী আওয়ামী লীগ বিরোধী ছবি আঁকতে রাজি হবে না। মোয়াজ্জেম সাহেব বললেন, তাকে আমার রুমে পাঠান।

কামাল পাশা চৌধুরীকে কোন মন্ত্রে মোয়াজ্জেম সাহেব ম্যানেজ করছিলেন জানি না। মোয়াজ্জেম সাহেবের রুমে বসেই গোঁজামিল দিয়ে প্রচ্ছদের ছবি বদল করলেন। যাবার সময় পাশা ভাই বলেছিলে, “আলম ভাই আমি আর আসবো না।” তার কথার কোন জবাব দেয়ার অবস্থা আমার ছিলো না। মনে মনে বললাম, আপনি আর কি আসবেন; পত্রিকাই তো থাকবে না।

প্রচ্ছদের ছবি গোজামিল দিয়ে পরিবর্তনের পর ঝামেলা দেখাদিলো লেখা পরিবর্তন করা নিয়ে। কারণ, একটি টার্গেট নিয়ে তৈরি করা বড় লেখা সম্পূর্ণ উল্টে দেয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু এ কাজ করতে হয়েছে। মালিকের ইচ্ছা বলে কথা! তবে এটি সঠিকভাবে করা যায়নি। লেখার মধ্যে নানান রকমের বৈপরিত্য সৃষ্টি হলো। প্রচ্ছদ রিপোর্টটি দাঁড়ালো, চিত্রা হরিণের শরীরে হনুমানের মাথা লাগাবার মতো। অদ্ভূত লেখা নিয়েই সাপ্তাহিক সুগন্ধা মার্কেটে গেলো নির্বাচনের চারদিন আগে; তবে প্রচ্ছদের ছবি ছিলো খুবই স্পষ্ট।

এ প্রচ্ছদের কারণে নির্বাচনের পর কি অবস্থা হবে তার অস্বস্তিকর প্রমো দেখালেন মাসুদ কামাল। তিনি পত্রিকার প্রডাকশনের দিন সাধারণ থাকতেন না। ছিলেন না সেবারও। পত্রিকা মার্কেটে যাবার দিন তার প্রথম কাজ ছিলো পুরো পত্রিকা পড়ে নানান ত্রুটি চিহ্নিত করা যাতে এর রিপিট না হয়।

কিন্তু এবার তিনি পত্রিকা পড়ার ধারেকাছেও গেলেন না। প্রচ্ছদ দেখেই গরম হয়ে গেলেন। সামনে পেলেন আমাকে। আর এমনভাবে কথা বলা শুরু করলেন যা সহ্য করা ছিলো খুবই কঠিন; আবার উপেক্ষা করারও উপায় ছিলো না। তার প্রধান বক্তব্য ছিলো, পত্রিকা মার্কেটে থাকতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে: তখন পাঠক আমাদের কি ভাববে! তার উচ্চারণ এবং মনোভাবের সঙ্গে আমার দ্বিমত প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিলো না। কেবল বললাম, ভাই আমার কিছু করার ছিলো না; মোয়াজ্জেম সাহেব হাইড্রোলিক প্রেসার দিয়ে করিয়েছে। মাসুদ কামাল বললেন, চাপ দিলেই উল্টা কাজ করবেন? আমি বললাম, ‘ছিলেন না তো; থাকলে বুঝতেন!’ কিন্তু মাসুদ কামাল এতোটাই তেঁতে ছিলেন যে, কিছুই বুঝতে চাইলেন না।

কেবল মাসুদ কামাল না, সকলেই প্রকাশিত পত্রিকা নিয়ে বিক্ষুব্ধ ছিলাম। যে যার মতো ক্ষোভ প্রকাশ করছিলো। কেবল আমি ছিলাম অনেকটা নির্বাক অবস্থায়। কারণ আমার কথা শোনার মতো কেউ ছিলো না। যে কারণে আমি মোয়াজ্জেম সাহেবের কথা শুনতে বাধ্য হয়েছি সেই বাধ্যবাধকতা টিমের অন্য কারো থাকার কথা নয়। আর ধরেই নিয়েছিলাম, এটিই আমাদের টিমের আখেরি ইস্যু; আমরা আর আসবো না। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল আমাদের সকল ধারনা পাল্টে দিলো। নির্বাচনের ফলে সকল পত্রপত্রিকার রিপোর্ট ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলো; কেবল সত্য প্রমাণিত হলো সুগন্ধার প্রিডিকশন। বিএনপি বিজয়ী হলো; পরাজিত হলো আওয়ামী লীগ। সবাই জানলো, নির্বাচনের ফল সম্পর্কে প্রিডিকশন করার ক্ষেত্রে সুগন্ধা টিম ইউনিক। কিন্তু পাঠকের কাছে অজানাই থেকে গেলো, সৈয়দ মোয়াজ্জম হুসাইনের ইচ্ছাপূরণের বিষয়টি।

আলম রায়হান, জেষ্ঠ্য সাংবাদিক

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :