শান্ত সুনিবিড় ইকবাল রোড!

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৪৮

প্রভাষ আমিন

ইদানীং আর যাই না। কিন্তু কদিন আগেও আমি সকালে প্রসূনকে স্কুলে দিয়ে আসতে যেতাম। অবশ্য যাওয়াটা খুব যে দরকারি ছিল, তা নয়। আমার বাসা থেকে প্রসূনের স্কুল তিন মিনিটের দূরত্বে। তবু আমি যেতাম আমার আগ্রহে। মুফতে একটা মর্নিং ওয়াক হয়ে যেত। তবে আমার মূল লোভ ছিল, সকালবেলায়ই নিজেকে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর করে ফেলা। একসঙ্গে এতগুলো বাচ্চার কিচিরমিচির দেখে আমার মন ভালো হয়ে যেত। সকালে প্রসূনের স্কুল থেকে আমি সারা দিন উজ্জীবিত থাকার জ্বালানি সংগ্রহ করতাম। স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি একটু হেঁটে আসতাম। এ হাঁটতে হাঁটতেই তিন বছর আগে এক সকালে ইকবাল রোড থেকে মধুমঞ্জরি ফুলের ছবি তুলে ফেসবুকে ‘শুভ সকাল’ লিখে পোস্ট দিই। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন আমি নতুন নতুন ফুলের ছবি তুলে ফেসবুকে শুভ সকাল জানাই। যারা ফেসবুকে আমার সঙ্গে আছেন, তারা আমার এ বদভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত। এখন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফুলের ছবি তুললেও প্রথম আড়াই মাস আমি শুধু ইকবাল রোড থেকে তোলা ফুলের ছবি পোস্ট করেছি। দেখতে দেখতে একদিন খ্যাতনামা সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় ঝুমা আপা (পারভিন সুলতানা মুসা ঝুমা) বললেন, ‘আমার জন্ম ইকবাল রোডে, ছোট থেকে এখানেই বড় হয়েছি। কিন্তু ইকবাল রোডে যে এত ধরনের ফুল আছে, জানতামই না।’ আমিই কি ছাই জানতাম! ফেসবুকে এ শুভ সকাল-এর ফাঁদে পড়ে দেখছি, আমাদের চারপাশেই লুকিয়ে আছে প্রকৃতির কত ঐশ্বর্য। জানি আপনারা বিরক্ত হন, তবু সকালে নিজের তোলা ছবি দিয়ে ফেসবুকে শুভ সকাল জানাতে আমার ভালো লাগে। আমাদের সব কিছুই এখন ভার্চুয়াল হয়ে গেছে। ছবি তোলার সুবাদে আমি অ্যাকচুয়াল প্রকৃতির ছোঁয়া পাই। ঝুমা আপার মতো মৌসুমী কাজীরও ছেলেবেলা কেটেছে ইকবাল রোডে। আমার এ ফেসবুক-বন্ধু এখন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে। আমি মাঝেমধ্যে ইকবাল রোডের কোনো ফুলের ছবি দিলে হাজার মাইল দূর থেকে ছেলেবেলায় ফিরে যান মৌসুমী কাজী। বলেন, এ কামিনীগাছটা আমার মা লাগিয়েছেন বা ঠিক এই হাস্নাহেনার গন্ধে মাতাল ছিলাম ছেলেবেলায়। তার আবেগ ছুঁয়ে যায় আমাকেও।

হঠাৎ ইকবাল রোড নিয়ে পড়ার কারণ অবশ্য ওয়ারী। আমরা দেখিনি, কিন্তু বইয়ে পড়েছি, ওয়ারী ছিল ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত ও অভিজাত আবাসিক এলাকা। এখন গেলেও চওড়া রাস্তা দেখে কেউ চমকে যেতে পারেন, পুরান ঢাকায় এত পরিকল্পিত রাস্তা! কিন্তু ওয়ারীর সেই আভিজাত্য আর নেই। কে নষ্ট করেছে? আমি-আপনি নয়, ওয়ারীকে নষ্ট করেছে ওয়ারীর বাসিন্দরাই। আসলে লোভ কেড়ে নিয়েছে ওয়ারীকে। এখন ওয়ারী আবাসিক না বাণিজ্যিক এলাকা, বোঝা দায়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্ট আগামী ১০ মাসের মধ্যে ওয়ারী থেকে সব বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশটি শুনে আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু আমি জানি এ আদেশ কোনোদিনই প্রতিফলিত হবে না। কারণ আমরা চোখের সামনে ধানমন্ডিকে নষ্ট হতে দেখেছি। আমাদের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকার নামে জাপান গার্ডেন সিটি বা নিকেতনের মতো কংক্রিটের জঞ্জাল। ওয়ারীর পর ঢাকার অভিজাত আবাসিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল ধানমন্ডিকে। সেই ধানমন্ডি এখন বাণিজ্যিক এলাকা না আবাসিক এলাকা? কেউ দেখে আলাদা করতে পারবে না। ধানমন্ডি কে নষ্ট করেছে? উত্তর একই- ধানমন্ডিবাসীরাই। এখানেও সেই লোভের থাবা। কিন্তু নিজেরা ধ্বংস করে পরে বাঁচানোর জন্য কান্নাকাটি করা কোনো কাজের কথা নয়। গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে সেই গাছ বাঁচে না।

বলছিলাম ইকবাল রোডের কথা। মোহাম্মদপুরের মধ্যে ইকবাল রোড আর স্যার সৈয়দ রোড একটু অভিজাত। তবে আভিজাত্যের লোভে নয়, ছেলের স্কুলের কাছে হওয়ার সুবাদে সাত বছর ধরে আমি ইকবাল রোডের বাসিন্দা। তারও আগে থেকে ইকবাল রোডকে দেখেছি। দুটি বড় মাঠ, চওড়া রাস্তা, অনেক গাছপালা, শান্ত-নিরিবিলি ইকবাল রোডে একটা গ্রাম গ্রাম ব্যাপার আছে যেন। পুরোনো বাসিন্দারা বলেছেন, আগে ইকবাল রোডের বাসিন্দারা একে অপরকে চিনতেন। গ্রামের প্রতিবেশীদের মতো আন্তরিকতা ছিল। ছিল বলছি, কারণ সাত বছর ধরে চোখের সামনে ইকবাল রোডকে বদলে যেতে দেখেছি। ওয়ারী বা ধানমন্ডির মতো ইকবাল রোডও কি তবে আবাসিক এলাকার চরিত্র হারিয়ে ফেলছে? শুরুতে যে ফুলের প্রাচুর্যের কথা বলেছি, এই চার বছরেই অনেকটা বদলে গেছে ইকবাল রোড। এখনও ফুল আছে, এখনও ঢাকার অন্য অনেক এলাকা থেকে অনেক বেশি বাসযোগ্য। তবে কত দিন থাকবে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। বছর পনেরো আগেও ইকবাল রোডে অনেক একতলা-দোতলা বাড়ির আধিক্য ছিল। এখন সেখনে প্রায় সবই বহুতল ভবন। বাড়ি খুঁজতে গেলে হাতেগোনা। ঢাকায় জনসংখ্যার যে চাপ, একসময় হয়তো সবই বহুতল হয়ে যাবে। নইলে আমরা থাকব কোথায়। কিন্তু বহুতল ভবন গড়েও আবাসিক চরিত্র ধরে রাখা সম্ভব। কিন্তু ওয়ারী আর ধানমন্ডি যেমন নষ্ট হয়েছে, ইকবাল রোডও কি সেদিকে যাচ্ছে?

গত ৩০ বছর ধরে আমি ঢাকায় শরণার্থী। ভেসে ভেসে ঢাকায় অনেক এলাকায় থেকেছি। কিন্তু ইকবাল রোডের মতো কোনো এলাকার জন্য এতটা মায়া জন্মায়নি। এই যে লোভের এত গ্রাস, তবু ইকবাল রোডে এখনও দুটি বড় মাঠ আছে, চওড়া রাস্তা আছে, এখনও অনেক গাছপালা আছে। ইকবাল রোডের আদি বাসিন্দাদের ধন্যবাদ, বহুতল হলেও সব ভবনের সামনে অল্প কিছু হলেও গাছ আছে। সকালে ইকবাল রোডের মাঠে হাঁটতে আসেন অনেকে, বিকালে ইকবাল রোডের মাঠে খেলতে নামে এলাকার শিশুরা। অনেকে রাস্তায়ও ক্রিকেট খেলতে নেমে যায়। বিকালে সাইকেল নিয়ে শিশুদের ক্যারিকেচার দেখলেও মন ভালো হয়ে যায়। শিশুরা বাসার সামনের রাস্তাকে গ্রামের মতো উঠান বানিয়ে ফেলে। রাতে এখনও ইকবাল রোডে গা ছমছমে নীরবতা, কেমন গ্রাম গ্রাম অনুভূতি। কিন্তু রাতের এ গ্রাম গ্রাম ব্যাপারটা বদলে যায় দিনে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইকবাল রোডকে চেনাই দায়। আমি যে কারণে ইকবাল রোডে বাসা ভাড়া নিয়েছে, সে কারণে দিনে অনেকে ছুটে আসেন এখানে। ইকবাল রোড আসলে যেন শিক্ষা এলাকা। সেন্ট যোসেফ, সেন্ট পলস, গ্রিন হেরাল্ড, প্রিপারেটরি, ওয়াইডব্লিউসিএ তো আছেই; আছে অনেক ছোটখাটো স্কুলও। এমনকি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ও। সকালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের পদচারণে গমগম করে ইকবাল রোড। এ সময় ইকবাল রোড হয়ে ওঠে ভাসমান বাজার, দিনভর লেগে থাকে জ্যাম। পুরো ইকবাল রোডই হয়ে ওঠে পার্কিং এরিয়া। ইকবাল রোড আর স্যার সৈয়দ রোডের বাসিন্দার তাদের এলাকাকে রক্ষা করতে মাঠে নেমেছেন, গঠন করেছেন টাস্কফোর্স। তারা নানা পদক্ষেপও নিচ্ছেন। কিন্তু ধ্বংস করে পরে বাঁচানোর জন্য কান্নাকাটি করে লাভ হয় না। আবাসিক এলাকার ভেতরে যে স্কুল, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে, সে তো স্থানীয় বাসিন্দারা ভাড়া দিয়েছেন বলেই। একটি আবাসিক এলাকা কিভাবে ধ্বংস হতে পারে, তার ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ইকবাল রোডে ঢোকার মুখে একটি ছোট্ট পান-সিগারেটের দোকান আছে। সকালে স্কুলছাত্ররা সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। দৃশ্যটা দেখতে খুব খারাপ লাগে। হয়তো সিক্স-সেভেনে পড়ে। অ্যাডভেঞ্চারের লোভে হয়তো লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আর এই দোকানকে ঘিরে যে জটলা তা দিনভরই থাকে। দুপুরের পর রিকশাওয়ালারা ভিড় জমায়। প্রবর্তনা এখানে ভাড়া নিয়েছিল অফিস হিসেবে। এখন কিন্তু রীতিমতো হোটেল।

ওয়ারী ও ধানমন্ডির অসুখ নিরাময় অযোগ্য হলেও ইকবাল রোড-স্যার সৈয়দ রোডকে এখনও বাঁচানোর সুযোগ আছে। আর বাঁচানোর কাজটি করতে হবে এলাকার বাসিন্দাদেরই। কেউ যেন লোভে পড়ে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া না দেন। নিজের বাসার সামনেটা যেন পরিষ্কার রাখেন। ওপর থেকে যেন পাশের ছাতে টুপ করে ময়লাটা ছুড়ে না ফেলেন। বাসার আশপাশে যেন আরো বেশি গাছ লাগান। সকাল-দুপুর যানজট সমস্যা নিরসনে ইকআল রোড-স্যার সৈয়দ রোড টাস্কফোর্স ইতোমধ্যে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছে। এ চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের গাড়ি আসা ঠেকানো যাবে না। তবে তারা যাতে অপ্রয়োজনে যত্রতত্র পার্ক না করেন, সে জন্য একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে পার্কিং চার্জ আরোপ করা যেতে পারে।

ইকবাল রোডকে যতই ভালোবাসি, আমার অত সমস্যা নেই, এলাকাটি আবাসিক চরিত্র হারিয়ে ফেললে আমি বাসা বদলে অন্য কোথাও চলে যাব। তবে যারা এখানকার আদি বাসিন্দা, সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে তাদেরই। ইকবাল রোড যেন টিকে থাকে আগের মতোই শান্ত, নিরিবিলি সবুজ এলাকা হিসেবেই। ইকবাল রোডের পরিণতি যেন ওয়ারী, ধানমন্ডি, জাপান গার্ডেন সিটি বা নিকেতনের মতো না হয়।

সাত বছর ধরে থাকি বলে, মায়া জন্মে গেছে বলে আমি ইকবাল রোড নিয়ে লিখেছি। এটা আসলে প্রতীকী। আমি জানি সব এলাকারই এমন নিজস্ব নানা সমস্যা আছে। যার অনেকগুলো ওই এলাকার মানুষেরই সৃষ্ট। ধানমন্ডিতে কেন ধানক্ষেত নেই, কলাবাগানে কেন নেই কলাবাগান, কাঁঠালবাগানে নেই কেন কাঁঠালের গাছ, শান্তিনগরে কেন শান্তি নেই, ভূতের গলির জ্যাম দেখলে কেন ভয়ে ভূতও পালিয়ে যায়; এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ওই এলাকার লোকদেরই। সরকার বা সিটি করপোরেশনের আশায় বসে না থেকে বা তাদের গালাগাল না করে নিজ নিজ এলাকার সমস্যার সমাধান বের করতে হবে নিজেদেরই। আপনি মেয়রকে গালাগাল করতে পারবেন, পাঁচ বছর পর ভোট না দিতে পারবেন; কিন্তু প্রতিদিন কিন্তু সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে হবে আপনাকেই।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ