অবহেলায় পড়ে আছে উত্তরাঞ্চলের চার খনি

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর
| আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:১৭ | প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:৫০

উত্তরাঞ্চলের চারটি খনি থেকে মূল্যবান খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কোনো গরজ নেই সরকারের। উত্তরাঞ্চলবাসীর মনে মাঝেমধ্যেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তাতে খুব একটা গা লাগাচ্ছে না প্রশাসন। তাই এত দিনেও কেন এই খনিগুলোর উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি এর কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি এখনো।

অথচ অবহেলায় পড়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের চারটি খনিতে মজুদ সম্পদ ঘুরিয়ে দিতে পারে দেশের এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার।

রংপুরের পীরগঞ্জে আবিষ্কৃত দেশের একমাত্র লৌহ খনিটি। চারটি খনির একটি হলো জয়পুরহাটের কয়লা খনি। এই খনি থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদন করা হলে তা পুরো উত্তরাঞ্চলের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার শালবাহানের তেলকূপ এবং নওগাঁ জেলার চিনামাটির খনি থেকে সম্পদ আহরণ করা হলে বদলে দেয়া যাবে পুরো উত্তরাঞ্চলের চিত্র। অথচ এসব খনিজসম্পদ আহরণের কোনো উদ্যোগই দেখতে পাচ্ছেন না উত্তরাঞ্চলবাসী।

এসব খনি আবিষ্কারের পেছনের ঘটনাগুলো খুবই চমকপ্রদ। পাশাপাশি খনিগুলো জন্ম দিয়েছে কিছু ঘটনারও। যেমন লোহার খনি আবিষ্কারের ঘটনাটি এখনো এ অঞ্চলে রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে আছে।

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের পরপরই তৎকালীন পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের একদল বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যচিত্র অনুযায়ী বিমান ও গাড়িবহর নিয়ে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পাথুরে এলাকায় আসেন। খনির অবস্থান নিশ্চিত করতে তারা বিমানের নিচে ঢেঁকির মতো বড়সড় একটা শক্তিশালী চুম্বক ঝুলিয়ে বিমানটি মাটির কাছাকাছি দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যান। এর একপর্যায়ে বিমানের ঝুলন্ত চুম্বকদণ্ড ছোট পাহাড়পুর গ্রামের আবুল ফজল ও আব্দুল ছাত্তার নামে দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন জমির দিকে আকর্ষিত হয়। সেই আকর্ষণ নাকি এতটাই তীব্র ছিল যে বিমানটিকে বারবার মাটির দিকে টেনে নিচে নামাতে চেষ্টা করে।

এরপর এখানকার মাটি পরীক্ষা করে পাকিস্তানের খনিজ বিজ্ঞানীরা এখানে লোহার খনির উৎস আছে বলে ঘোষণা দেন এবং সেই জমির ওপর কংক্রিটের ঢালাই করা চিহ্ন দিয়ে খনি এলাকায় প্রাথমিক জরিপকাজ সম্পন্ন করে চলে যান।

প্রথম জরিপ সম্পন্নের পরের বছর পাকিস্তান খনিজ বিভাগের লোকজন এসে চিহ্নিত স্থানে খননকাজ শুরু করেন। ওই বছরই তারা কয়েক মাস ধরে তেলমারী পাথারের তিন কিলোমিটার দূরে কেশবপুর ও ছোট পাহাড়পুর, প্রথম ভাজা গ্রাম, পবনপাড়া সদরা কুতুবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় অসংখ্য স্থানে পাইপ বসিয়ে লোহার খনির বিস্তৃতি নিশ্চিত করেন।

এ সময় অনুসন্ধানের কাজে পাইপের ভেতর দিয়ে মাটির গভীরে একটি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। জনশ্রুতি আছে, বিস্ফোরণের ফলে এলাকার অনেক মাটির কুয়া ভেঙে পড়ে।

দ্বিতীয় বছরও পাইপের মাধ্যমে আরেক দফা জরিপকাজ সম্পন্ন করা হয়। পরে ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা একদল বিদেশি খনিজ বিশেষজ্ঞসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বিশাল বহর নিয়ে স্থানীয় পানবাজার হাইস্কুল মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর তারা তেলমারী পাথারের বিভিন্ন স্থানে পাইপের মাধ্যমে সন্ধান পাওয়া লোহার উপাদান উত্তোলন করেন। এ সময় খনি বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন এখান থেকে আহরিত লোহা বিশ্বের অন্যান্য খনির তুলনায় উৎকৃষ্ট মানের।

সে সময় খনি সন্ধানকে কেন্দ্র করে এ এলাকায় কয়েক মাস ধরে মেলা চলেছিল।

খনি কর্মকর্তারা সে সময় এলাকাবাসীকে জানান, মাটির ৯০০ ফুট নিচ থেকে ২২ হাজার ফুট পর্যন্ত পাইপ খনন করে তারা উন্নত মানের লোহার স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। এর বিস্তৃতি প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত।

কিন্তু কিছুদিন পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জানায়, এ খনি থেকে লোহা উত্তোলনের উপযোগী হতে আরো ২০-২৫ বছর সময় লাগবে। এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপক খনি অনুসন্ধান কাজ শেষ করে ভেলামারীতে স্থাপিত চারটি মূল পাইপের উৎসমুখ কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে বন্ধ করে খনি কর্মকর্তারা ক্যাম্প গুটিয়ে ফিরে যান পাকিস্তান।

এরপর দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে অভ্যুদয় হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।

এরও ২৮ বছর পর ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকার আবার খনি অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে। কিন্তু আবিষ্কৃত লৌহ খনির উৎসমুখ ভেলামারী থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে পরীক্ষামূলকভাবে খনন করেন তারা। এরপর হঠাৎ করে সবকিছু গুটিয়ে চলে যান সরকারি কর্মীরা। ফলে আবার খনিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, যা বহাল গত ১৮ বছর ধরে।

প্রায় একই ঘটনা ঘটে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার শালবাহানে। দেশের একমাত্র এই তেলখনিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। এতে উত্তরাঞ্চল তথা দেশবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছিল ব্যাপক আনন্দ, উৎসাহ আর উদ্দীপনা।

আবিষ্কারের পরপরই উত্তোলনের কার্যক্রম জোরদার করার উদ্দেশ্যে সরকারিভাবে বিশাল যান্ত্রিক গাড়ির বহর নিয়ে শালবাহানে হাজির হয় খনি গবেষকদের দল। ১৯৮৯ সালে শালবাহানের খনি থেকে তেল আহরণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ফ্রান্সের ফস্টাল কোম্পানি ভূমি থেকে মাত্র ৬ হাজার ফুট নিচে তেলের স্তরের সন্ধান পায়। পরবর্তী সময়ে ৮ হাজার ফুট গভীরে ১২ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটি তেলকূপ খনন করে। সেখান থেকে তেল পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ নিজে শালবাহান তেল খনির উদ্বোধন করেন এবং অবিলম্বে এ তেল খনি থেকে তেল উত্তোলনের ঘোষণা দেন।

কিন্তু ফস্টাল কোম্পানি হঠাৎ করে ‘এই এলাকায় তেল নেই’ বলে ঘোষণা দিয়ে খননকৃত কূপটি চিরস্থায়ী সিল করে চলে যায়। জানা যায়, পরবর্তী সময়ে ফস্টাল কোম্পানি বাংলাদেশের শালবাহান থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানার জমিদারপাড়া গ্রামে তেলকূপ খনন করে। সেই তেলকূপ দিয়েই ভারত সরকার এখনো তেল উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে জয়পুরহাট জেলার একমাত্র জামালগঞ্জ কয়লা খনি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৬২ সালে খনিটির সন্ধান পাওয়া যায়। জরিপ কাজ ৬৭০ মিটার থেকে ১১৬০ মিটার পর্যন্ত মাটির গভীরে ছিল। এখানকার কয়লা উত্তোলন করে গ্যাসে রূপান্তর করতে পারলে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব। এই খনিটি চালু করা হলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়ার পর সরকারিভাবে প্রায় ২ দশমিক ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং কয়লা আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার পর জায়গাটি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭৯ সালে জারুরিভাবে অতিথিশালা, কোয়ার্টার বিল্ডিং এবং গুদামঘর নির্মাণ করা হয়। সে সময় কর্মকর্তারা এসব জায়গায় বসবাস করতেন।

উত্তরাঞ্চলের এই ৪টি আবিষ্কৃত খনি সম্পর্কে সরকারির উদ্যোগ কি জানতে চাইলে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘পীরগঞ্জের লৌহ খনি ও পঞ্চগড়ের খনিতে রিজার্ভের পরিমাণ কম থাকায় এই দুটি খনির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। আর জয়পুরহাটের খনির গভীরতা অনেক বেশি ফলে উত্তোলন হবে ব্যয়সাপেক্ষ। তবে এ খনির কয়লা থেকে গ্যাস উৎপাদন করে এ অঞ্চলের জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব।’

পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারের সদিচ্ছাই পারে এই চার খনি আলোর মুখ দেখতে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল উত্তরাঞ্চলের খনি থেকে সম্পদ উত্তোলন করে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবেন। উত্তরাঞ্চলবাসী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার পূরণের অপেক্ষায়।

(ঢাকাটাইমস/১৬অক্টেবার/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :