রাত পোহাবার কত দেরি?

মোল্লা মোহাম্মাদ শাহীন
| আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:৩১ | প্রকাশিত : ১৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:২৭

‘চেষ্টা করলে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি হতে পারি’ এটি গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের স্বনামধন্য বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণের একটি সংবাদ শিরোনাম। ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে দেশের ৯৬ জন অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কথাটি আপতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবিবর্জিত নয়। হয়ত শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা যোগাতেই তিনি এরকম কথা বলেছেন। তবে তিনি শর্ত হিসেবে ‘চেষ্টা করলে’ শব্দ ব্যবহার করে তার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। সংবাদ শিরোনামটি অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ না করলেও আমার মনের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ:-

১। গত বছর হঠাৎ একদিন আমার এক বন্ধু ফোন করে বলল, আমি একটা বিপদে পড়েছি। তোমার সাহায্য দরকার। বললাম, কী সমস্যা। ও বললো যে, তার এক চাচাতো ভাই সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং আজকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠেছে। তার চাচাতো ভাই ফোন করে কান্নাকাটি করে তাকে জানাল যে, তাকে তার হলে দুজন ছাত্র নেতা একটি রুমে আটকে রেখে র‌্যাগিং করছে। সে কৌশলে বাথরুমে এসে ফোন করেছে এবং তাকে উদ্ধারের জন্য আকুতি মিনতি করছে। আমার ওই বন্ধু আমাকে ফোন করে বললো, তুমি স্থানীয় পুলিশকে বলে ওকে একটু উদ্ধারের ব্যবস্থা কর। আমি বললাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পুলিশ যেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষের সাথে কথা বলতে হবে। বরং আমি তোমাকে প্রক্টরের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে দিই এবং তুমি তার সাথে সরাসরি অভিভাবক হিসেবে কথা বলো।

তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। আমার পরামর্শ মোতাবেক সে প্রক্টরের সাথে ফোনে কথা বললে প্রক্টর ওই ছেলেটিকে বিমর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করেন। ছেলেটি এতটাই Traumatised হয়েছিল যে, সে নাকি পড়াশোনাই বাদ দিতে চেয়েছিল।

২। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের অহংকার। অন্য অনেকের মতো আমারও দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন ছিল এখানে পড়ার। ২০০১ সাল। স্বপ্ন পূরণ হলো। ভর্তি হলাম। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে সংযুক্তি পেলাম। এবার হলে ওঠার পালা। এলাকার পরিচিত বড়ভাইদের সাহায্য নিয়েই হলে উঠতে হয়। এটাই নিয়তি। এটাই নিয়ম। ভাগ্যক্রমে আমিও একজন এলাকার বড় ভাই পেলাম। তার কাছে গেলাম এবং হলে ওঠার অভিপ্রায় ও অপরিহার্যতা তাকে জানালাম। সে বললো আমার এক বন্ধু হলে রাজনীতি করে এবং হলে লোক উঠায় আমি রাতে তোমাকে ওর কাছে নিয়ে যাব।

তার কথা অনুযায়ী একদিন রাত ১২টার পরে আমার ওই বড় ভাইটি তার বন্ধুর কাছে নিয়ে গেল এবং বিস্তারিত বললো। তার বন্ধু আমার ছোটখাট একটা সাক্ষাৎকার নিলেন। রাজনীতি করব কি না জানতে চাইলেন। আমি নীরব রইলাম। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ হলেও আমার নীরবতা যে অসম্মতির লক্ষণ ছিল তা ওই রাজনীতিবিদ বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদেরকে কৌশলে বললেন যে, তারা এখনো হলে ছাত্র উঠানো শুরু করেননি এবং আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমার ওই বড়ভাই কিছুটা লজ্জা পেলেন এবং আমাকে নিয়ে চলে এলেন। বাইরে এসে আমাকে বললেন তুমি আপাতত আমার রুমে উঠে যাও এবং কিছুদিন পরে আমি তোমাকে কোনো একটা রুমে তুলে দেব।

যেই কথা সেই কাজ। আমি পরেরদিন থেকে তার রুমে থাকা শুরু করলাম। সপ্তাহখানেক পরে একদিন রাতে সে রুমে ফিরে বললো তুমি ঘুমিয়ে যেও না। আজকে রাতে তোমাকে একটা রুমে তুলে দেব। আমি বললাম কখন। তিনি জানালেন রাত ২টার পরে। এত রাতে কেন জিজ্ঞাসা করলে জানালো যে, রাত ১২টার আগে হলে লোক উঠানো হয় না। যাই হোক আমি রাত জেগে রইলাম। রাত ২টার দিকে আমার ওই বড়ভাই তার এক ছাত্রনেতা বন্ধুসহ এসে আমাকে আমার ব্যাগ ও বিছানাপত্রসহ তাদের সাথে যেতে বললো। আমি তাদের সাথে চললাম। একটি রুমের সামনে এসে থামলাম। দরজায় নক করল। একজন দরজা খুলল। রুমে ঢুকে আমাকে দেখিয়ে ওই রুমের এক ভাইকে বললো যে, এখন থেকে সে তোমার সাথে একই বেডে থাকবে। আমাকে বললো, তুমি শুয়ে পড় এবং কোনো সমস্যা হলে আমাদের জানাবা বলে চলে গেল। আমার হলে ওঠা শেষ। সময় নিল মাত্র দুই মিনিট। আমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গেলাম। আর রুমের ওই বড়ভাইটি বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসেই রাত কাটিয়ে দিল। তার এ অবস্থা দেখে আমারও সারারাত ঘুম হয়নি। এরপরের সব শুধুই ইতিহাস!

উপরের ঘটনা দুটো বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

৩। কাজের কথায় আসি। গত ১ সেপ্টেম্বর জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনের কাছাকাছি জাপানে এসেছি। টোকিও আর ফুকুওকায় হোটেলে থাকার পরে গত ২০ সেপ্টেম্বর Kyushu University এর International Student House এ উঠলাম। আগে থেকেই সবকিছু নির্ধারিত ছিল। এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের জন্য International Student Support Centre একজন করে Tutor দিয়ে থাকে। এসব Tutor রা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র হয়ে থাকে এবং এদের কাজ হলো স্বেচ্ছায় নতুন বিদেশি শিক্ষার্থীদেরকে নতুন জায়গায় Settle down হতে সাহায্য করা। আমার Tutor হলো Hirofumi Oguri. সে একজন জাপানি এবং Kyushu University তে PhD করছে। আমরা হোটেল থেকে গাড়িতে করে International Student House(Kaikan) এ এসে দেখলাম সবার জন্যই প্রত্যেকের Tutor দাঁড়িয়ে আছে। একটা অকৃত্রিম হাসি দিয়ে আমাদের বরণ করল। আনুষ্ঠানিকতা শেষে রুমে নিয়ে গেল। রুমের সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বাইরে নিয়ে গেল আশেপাশের দোকান, মার্কেট, হোটেল, পোস্ট অফিস ও ব্যাংক এগুলো চেনানোর জন্য। দুপুরে আমরা সবাই একসাথে একটি হোটেলে খেতে বসলাম। খেতে খেতে সবার সাথে পরিচয়। একজনের সাথে পরিচয় হলো তিনি Kyushu University তে শিক্ষকতা করেন এবং স্বেচ্ছায় একজন শিক্ষার্থীর Tutor হিসেবে কাজ করতে এসেছেন। তার পরিচয় জানার পরে আমি তো রীতিমত বাকরুদ্ধ।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় এক মাস সময় পার করলাম। এখন পর্যন্ত কেউ কাউকে র‌্যাগিং করলো না। হয়তবা তারা জানে না কীভাবে র‌্যাগিং করতে হয়। অথবা জাপানিরা জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে পৌঁছেছেন।

কবি ফররুখ আহমেদ এর কবিতা দিয়ে শেষ করছি-

"পাঞ্জেরি!

জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,

জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!

দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!"

লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।

শিক্ষার্থী, কিউশু ইউনিভার্সিটি, জাপান।

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :