প্রধান পাঁচ প্রস্তাবে আ.লীগ-বিএনপি পরস্পরবিরোধী

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৫৭ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:৩৩

তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস

আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে মতদ্বৈততা চলে আসছে বহুদিন ধরে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপের জন্য তৈরি দুই দলের প্রস্তাবেও আছে এর প্রতিফলন। অন্তত পাঁচটি প্রধান বিষয়ে দুই দলের প্রস্তাব পরস্পরবিরোধী।

সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে কি না, বর্তমান সংসদ বহাল রাখা হবে কি না, ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহার করা-না করা, সংসদীয় আসনগুলোর বিদ্যমান সীমানা বহাল রাখা-না রাখা, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা-না করা, করলে তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হবে কি না- মূলত এই পাঁচটি বিষয়ই ঘুরেফিরে প্রাধান্য পাচ্ছে আগামী নির্বাচন ঘিরে।

ইসির সংলাপের জন্য আওয়ামী লীগের তৈরি যে প্রস্তাবমালা পাওয়া গেছে দলীয় সূত্রে, তাতে দেখা যায় এই পাঁচ বিষয়ে দুই দলের অবস্থান পুরো বিপরীত।

সংবিধান অনুযায়ী সংসদ বহাল রেখে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন, ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহার, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করা (করলে শুধু স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখা), সংসদীয় আসনগুলোর বিদ্যমান সীমানা বহাল রাখাসহ ১১ দফা প্রস্তাব তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ। আজ বেলা ১১টায় আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে ইসির সংগে সংলাপে এসব প্রস্তাব তুলে ধরবে ক্ষমতাসীন দলটি।

এর আগে গত ১৫ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। সংলাপে বিএনপি বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত, নির্বাচনী সহায়ক সরকার, নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার না করা, সংসদীয় আসনের সীমানা ২০০৮ সালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়াসহ ২০ দফা দাবি জানায় ইসির কাছে।

তবে আরপিও সংশোধনের ক্ষেত্রে দুই দলের অবস্থান কাছাকাছি। বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। আজ সংলাপে বসতে যাওয়া আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রস্তাবমালায়ও আরপিওর কিছু ধারা-উপধারা সংশোধনের বিষয় থাকবে বলে জানা গেছে।

নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধের বিষয়ে প্রধান দুই দলের ভাবনা কাছাকাছি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও কয়েকটি পেশাগোষ্ঠার সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছে ইসি। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বুধবার সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসছে নির্বাচন কমিশন।

আওয়ামী লীগের সংলাপ প্রস্তুতি দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছে ঢাকাটাইমস।

ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবমালায় আরপিওর বাংলা সংস্করণে ইসির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এর প্রতি সমর্থন থাকবে। নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে নির্বাচনসংক্রান্ত সংবিধানের নির্দেশনা ও বিদ্যমান আইনের নিরপেক্ষ ও কঠোর প্রয়োগের সুপারিশ থাকবে প্রস্তাবমালায়।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ও নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সংস্থার নির্বাচনে অপেশাদার ও দায়িত্বহীন আচরণের জন্য কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবও করবে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচন পরিচালনায় বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারীদের নিয়োগ না দিয়ে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মচারীদের থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগের সুপারিশ করবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ তার সুপারিশে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ওই দলের তৃণমূল নেতাকমীদের ভোটের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের বাছাই করে সংশ্লিষ্ট দলের মনোনীত প্রার্থীদের একটি চূড়ান্ত প্যানেল প্রণয়নে আরপিও করতে বলবে।

এ ছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা অবলম্বন এবং কোনোভাবেই যাতে কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যশীল হিসেবে পরিচিত বা চিহ্নিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান না করা হয় তার প্রস্তাব দেবে তারা।

ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ গণমাধ্যম কর্মীদের নির্বাচনী বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য কার্যকর নির্দেশনা প্রদান, গণমাধ্যমকর্মীদের উপযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদান ও তাদের দায়িত্ব কর্ম-এলাকা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রস্তাব থাকবে।

পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রভিত্তিক তালিকা ছবি ও এনআইডিসহ নির্বাচনের অন্তত তিন দিন আগে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে প্রদান নিশ্চিতকরণ এবং প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক তাদের পরিচয়পত্র নিশ্চিত হয়ে ভোটকক্ষে প্রবেশ ও নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থানের অনুমতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার সুপারিশ থাকবে।

বিরাজমান সব বিধিবিধানের সঙ্গে জনমানুষের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মতো আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটদান প্রবর্তন করার সুপারিশ করবে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীন এ দলটি সংলাপে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করবে। দলটির মনে করছে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভুক্তি বা নির্বাচনকালীন তাদের নিয়োগের বিষয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দাবি তুলেছে। দেশের বিরাজমান আইন ও সাংবিধানিক নিয়মকানুনের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও আওয়ামী লীগ তার প্রস্তাবে তুলে ধরবে।

তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারা মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে তা উল্লেখ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাহিনীকে সাধারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাদের বিশেষায়িত অবস্থান বিনষ্ট হবে বলে ইসিকে তারা জানিয়ে দেবে।

আওয়ামী লীগ তার প্রস্তাবে সংসদীয় আসনগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ইসির ওপর ছেড়ে দেয়ার কথা বললেও প্রকারান্তরে এর বিরোধিতা করবে। ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে উল্লেখ করে নির্বাচনের কাছাকাছি সময় এসে আবার সীমানা নির্ধারণ করতে গেলে জটিলতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা থাকবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হবে।

নির্বাচন কমিশনের সংলাপে নিজেদের প্রস্তাব সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ঢাকাটাইমসকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব বিষয় আলোচনা করা দরকার আমরা তা-ই করব। এরই মধ্যে কতগুলো প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে সেনা মোতায়েন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং ভোটার তালিকাসংক্রান্ত, সেসব বিষয়ে আমরা কথা বলব।’

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলের পক্ষ থেকে ১১ দফা প্রস্তাবমালার পাশাপাশি আরপিওর কিছু ধারা-উপধারার সংশোধনী প্রস্তাব দেবে দলটি। সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন’ বা ‘নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ’-এর পরিবর্তে শুধু ‘নির্বাচন কমিশন’ রাখার প্রস্তাব করা হবে।

এ ছাড়া আরপিও সংশোধন করে ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, এনআইডির টিপসই ও স্বাক্ষরের সঙ্গে মিল রেখে ব্যালট পেপারের কাউন্টার ফয়েলের (মুড়ি) স্বাক্ষর ও টিপসই, ব্যালট পেপার ছিনতাই হলে প্রিজাইডিং অফিসারের করণীয় সুনির্দিষ্টকরণ, একাধিক দলের মনোনীত প্রার্থীকে কোনো দলের প্রতীক বরাদ্দ দেয়া যাবে না মর্মে বিধান নির্ধারণ, জামানত বাড়ানো, নির্বাচনী মামলা নিষ্পত্তির সময় বেঁধে দেওয়া, আরপিও এর ৪৪ এ এ এর উপানুচ্ছেদ (২) এর ‘if he is an income tax assessee’ বিলোপ, ৭৩ এর (২বি) এ bribery শব্দের পর as defined in Article 75, `personation` শব্দের পর as defined in Article 76` ও `undue influence` শব্দের পর as defined in Articles 77 যুক্ত করা; ৭৩, ৭৪, ৭৮, ৮১ এ উল্লেখিত সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছরের স্থলে ৫ বছর ও সর্বনিম্ন ১ বছর করা, ৯১ (বি) ও (ই) অনুচ্ছেদ বিলোপ, কমিশনকে কেউ সহযোগিতা না করলে তার ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান যুক্তকরণ, বিচারিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনে সুপ্রিম কোর্টের পূর্বানুমতি গ্রহণে ৯১এ ধারা সংশোধনসহ আরপিওর বেশ কিছু সংশোধনীর সুপারিশ করবে ক্ষমতাসীন দলটি।

(ঢাকাটাইমস/১৮অক্টোবর/মোআ)