জেগেছে পদ্মা সেতু-২

কর্মব্যস্ত কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ওয়ার্কশপ

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ০৮:০৬

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

সদ্যই বসেছে প্রথম স্প্যান। উত্তাল পদ্মার বুকে এখন সেতু অনেকটাই দৃশ্যমান। এর বাকি কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতেই। যা দেখে এসেছে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম টিম। মাওয়া ও জাজিরা ঘুরে এসে লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ছবি তুলেছেন শেখ সাইফ

প্রথম স্প্যান থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম মাওয়া পয়েন্টে। এখানে কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের ওয়ার্কশপ। বিরতিহীন কাজ চলছে। কেউ গ্রাইন্ডিং (যন্ত্রের সাহায্যে ইস্পাত ঘষে তোলা) করছেন। কেউবা ব্যস্ত ওয়েল্ডিং নিয়ে। কেউ করছেন রঙের কাজ। ঘুরে ঘুরে দেখা গেল, বিশাল আকারের চারটি স্প্যান দাঁড়িয়ে আছে। একটির কাজ শেষের দিকে। এখন বাকি রঙের কাজ। বাকিগুলোতে ছোটখাটো কিছু কাজ আছে। প্রয়োজনবোধে ঘষামাজার কাজ চলছে। ইয়ার্ডের ভেতরটায় একটার পর একটা স্প্যান লম্বালম্বি করে রাখা। দেখে মনে হয়, এখানে তৈরি হয়ে গেছে পদ্মা সেতু।

ওয়েল্ডিং চলছিল স্প্যান তুলতে সহায়ক স্ট্যান্ডে। ক্রেন দিয়ে স্প্যানগুলো উঁচু করার সময় এই স্ট্যান্ডগুলোর সহায়তা লাগে। তবে ইস্পাতের বিশাল এই কাঠামোটি নড়াচড়ার জন্য আছে রেলপথ। রেলের মতো দুটো লাইন বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ এই ব্যবস্থা। ইয়ার্ডের পুরোটাতেই আছে এই রেলপথ। যে কেউ দেখলে এটিকে রেলের ইয়ার্ডও বলতে পারেন।

গ্রাইন্ডিংয়ের কাজ করছিলেন শিমুল। বললেন, ‘বৃষ্টি এলে কাজ বন্ধ থাকে। সেদিন তাদের হাজিরাও পান না।’ তার সহযোগী আব্দুল কাদেরও একই অভিযোগ করলেন। শ্রমিক আমিরুল ইসলাম বললেন, ‘এত ঝুঁকির কাজ করি। এই আজও চোখে কী যেন ঢুকছে। বের হচ্ছে না। পানি পড়তেছে। বসদের বললে একটা ড্রপ তারা এনে দেয়। তবে এখানে সবসময় কোনো ডাক্তার নেই।’

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত ইস্পাতের কাঠামোগুলো সবই চীন থেকে আসে। চীনের শিং হোয়াং দাও শহরে ইস্পাতের বিশাল ট্রাসগুলো তৈরি হয়। সেখান থেকে জাহাজে করে আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দর থেকে আসে কুমারভোগ ইয়ার্ডের ওয়ার্কশপে। ট্রাসগুলোর কোনোটাই তৈরি হয়ে আসে না। এগুলোর আলাদা আলাদা অংশে ভাগ করা থাকে। পরে দক্ষ প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয় প্রকা- স্প্যান।

ইয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, চীন থেকে আসা ইস্পাতের কাঠামোগুলো কাঠের বাক্স থেকে বের করে রাখা হয়েছে। অনেকটি জোড়া দেয়ার কাজ চলছে। কাঠামোগুলোতে প্রথমে অফহোয়াইট রং থাকে। পরে সেগুলোতে কয়েকপ্রস্থ রং দেয়া হয়। শেষে করা হয় ধূসর (গ্রে কালার) রং। রঙের কাজ করেন মকবুল। বললেন, যে রং ব্যবহার করা হচ্ছে তা রোদ-বৃষ্টিতে কিছুই হবে না। ইস্পাতকে ভালো রাখবে।

পড়ন্ত বিকেলের আলো ওয়ার্কশপে পড়েছে। ক্লান্ত শ্রমিকরা একদ- জিরিয়ে নিচ্ছেন বসে। কাজ থেকে বিদায় নেয়ার সময়ও হয়ে এসেছে। দেখতে দেখতে বেরিয়ে যাওয়ার পথে পরিচয় হলো নিরাপত্তা কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। বললেন, ‘সিঙ্গাপুরে টানা দশ বছর ছিলাম। সেখানে নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়ে অনেক কোর্স করেছি। হাতে কলমে শিখেছি। এখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছি। এখানকার শ্রমিকদের সব সময়ই নিরাপত্তার প্রতি জোর দেয়া হয়। নিরাপত্তার জন্য যেসব সরঞ্জাম দরকার তার সবই এখানে আছে। এসব নিয়ে কারোই অবহেলার সুযোগ নেই। হেলমেট, মাস্ক আর সেফটি বুট পরে ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করতে হয়।’

পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে দু পারেই। মাওয়ার দিকটায় কুমারভোগ ইয়ার্ড। শরীয়তপুরের জাজিরায় আছে আরও একটি ইয়ার্ড। সেখানেও দিনরাত কাজ চলছে। মাওয়া ইয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, এখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একাধিক কার্যালয় রয়েছে। বেশ গোছানো, পরিপাটি কার্যালয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও বটে। বিভিন্ন ধরনের গাছপালাও লাগানো হয়েছে। তৈরি হয়েছে ইটের রাস্তা। বৃষ্টির পানি যেন পথে না জমে এজন্য ড্রেনও তৈরি আছে পাশে। প্রতিটি কার্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমে সূর্য লাল হয়ে আছে। একদল শ্রমিক কাজ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্কশপ থেকে। তাদের পাশ দিয়েই ঢুকছে নতুন কর্মী দল। রাতেও এখানে কাজ হয়। পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হওয়ার আগে তাদের কর্মময় হাতের যেন বিশ্রাম নেই।

বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়েই শুরু করতে হয়েছে পদ্মার দু পারকে এক করার কাজ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। বলা হয়, পদ্মা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি। এই নদীর যে জায়গায় সেতুটি নির্মিত হবে, সেখানে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। মূল সেতুর দৈর্ঘ হবে ছয় দশমিক পনেরো কিলোমিটার। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু। তবে সেই চ্যালেঞ্জ জয় করেই দৃশ্যমান হচ্ছে বিশাল এই স্থাপনা।

আগামীকাল তৃতীয় পর্ব: সড়কে, রেলে বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চল

ঢাকাটাইমস/১৮অক্টোবর/এইচএফ/টিএমএইচ