হালের নোবেল পুরস্কার ও কিছু কথা

সৈয়দ শিশির
 | প্রকাশিত : ২০ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১৭

সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। ১৮৯৫ সালে তার উপার্জিত অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার হিসেবে দিতে একটি উইল করে যান। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল কমিটি বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দিয়ে আসছে। নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলেও বাকি পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। মোট ৬টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের ইংরেজিতে ‘নোবেল লরিয়েট’ বলা হয়। প্রতি বছর তারা প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু অর্থ পেয়ে থাকেন। বরাবরের মতো ২০১৭ সালেও ৬টি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র: এ বছর পদার্থবিদ্যায় মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রাইনার ওয়েইস, ব্যারি বারিস এবং কিপ থর্ন। রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী ও গবেষক। তিনজন তিন দেশের নাগরিক। তারা হলেন জ্যুকেয়েস ডোবেশেট (সুইজারল্যান্ড), জোয়াকিম ফ্রাংক (জার্মানি) ও রিচার্ড হ্যান্ডারসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। ক্রিয়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপি উদ্ভাবনের জন্য এই তিন বিজ্ঞানীকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রবণে জৈব অণুর গঠন সুস্পষ্টভাবে (উচ্চ-রেজ্যুলেশনে) চিহ্নিত করা যায়।

চিকিৎসাশাস্ত্র: শারীরবিদ্যার নোবেল পেয়েছেন জেফ্রি হল, মাইকেল রসব্যাশ, মাইকেল ইয়ংÑ এই তিন মার্কিন বিজ্ঞানী। সার্কাডিয়ান রিদম বা বডি ক্লক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা এবং মৌলিক অনুসন্ধানের স্বীকৃতি হিসেবেই নোবেল পেলেন এই তিনজন। দিন বা রাত হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রাণীর দেহ যে ধরনের আচরণ করে বা যে রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা আসলে শরীরের একটি অভ্যন্তরীণ আণবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই প্রক্রিয়াটিকেই খুঁজে বার করেছেন হল, রসব্যাশ এবং ইয়ং।

অর্থনীতি: ২০১৭ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন আমেরিকান অর্থনীতিবিদ রিচার্ড এইচ থ্যালার। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মনস্তত্ত্বের প্রভাব বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল জিতেছেন। ৭২ বছর বয়সী মার্কিন এই অর্থনীতিবিদ ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট অরেঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। থ্যালার যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর আচরণগত বিজ্ঞান ও অর্থনীতির অধ্যাপক। ২০০৮ সালের এপ্রিলে হার্ভার্ড ল স্কুলের অধ্যাপক কাস আর সানস্টেইনের সঙ্গে ‘নাজ’ (ঘঁফমব) নামে যৌথভাবে একটি বই লিখে জনপ্রিয়তা লাভ করেন থ্যালার। এই বইয়ের মাধ্যমেই পরিচিতি পায় তার ‘আচরণগত অর্থনীতি’ তত্ত্ব (বিহ্যাভিয়রাল ইকোনমিকস)।

সাহিত্য: সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার ও ছোটগল্পকার কাজুরো ইশিগুরো। ইংল্যান্ডের নাগরিক হলেও ইশিগুরোর জন্ম ১৯৫৪ সালে জাপানের নাগাসাকি শহরে। ১৯৭০ সালে ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট থেকে ইংরেজি ও দর্শনে স্নাতক শেষে ইউনিভার্সিটি অব এঙ্গেলিয়াতে পড়েন সৃজনশীল সাহিত্য নিয়ে। তার প্রথম উপন্যাস ‘আ পেইল ভিউ অফ হিলস।’ ১৯৮৯ সালে ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’ বইয়ের জন্য ইশিগুরো ম্যান বুকার পুরস্কারে ভূষিত হন। এই বইটির উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও তার কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হলো- ‘নেভার লেট মি গো’, ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’, ‘দ্য আনকনসোলড’, ‘দ্য বেরিড জায়ান্ট।’ ইশিগুরোর উপন্যাসের একটা বৈশিষ্ট্য হলো তা কোনো সমাধানে পৌঁছায় না। তার চরিত্ররা অতীতে যে সমস্যা-সংঘাতে পড়ে, তা অমীমাংসিতই থেকে যায়। বিষণœতায় শেষ হয় তার কাহিনি। সুইডিশ একাডেমি তার প্রশংসায় বলেছে, ‘জোরালো আবেগীয় শক্তির’ প্রকাশ ঘটে তার উপন্যাসে, যেখানে ‘দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের কাল্পনিক অনুভূতির তলার হাহাকার’ প্রকাশিত হয়।

১৯০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভকারীদের মধ্যে ১৪ জন নারী। এ পর্যন্ত সাহিত্যে যৌথভাবে নোবেল দেওয়া হয়েছে মাত্র ২ বার। ১৯১৪, ১৯১৮, ১৯৩৫, ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে (যোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে) সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয়নি। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে দুজন সাহিত্যিক নোবেল প্রত্যাখান করেছেন- বরিস পাস্তেরনাক ও জাঁ পল সার্ত্র। সাহিত্যে নোবেল পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। ৪১ বছর বয়সে ‘দ্য জাংগল বুক’র জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। আর সাহিত্যে নোবেলজয়ী সর্বোজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন ডোরিস লেসিং। ২০০৭ সালে যখন লেসিংকে পুরস্কার বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তখন তার বয়স ছিল ৮৮ বছর।

শান্তি: পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস (আইসিএএন) ২০১৭ সালে শান্তিতে নোবেল জিতে নিয়েছে। পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রচারণার স্বীকৃতি হিসেবে তারা এ সম্মানজনক পুরস্কারটি পেয়েছে। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসন বলেন, ‘পরমাণু অস্ত্রের কোনো প্রকার ব্যবহারের ফলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কর পরিণতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এবং এই ধরনের অস্ত্রের বিরুদ্ধে একটি চুক্তিভিত্তিক নিষিধাজ্ঞায় পৌঁছাতে এর (আইসিএএন) অসাধারণ প্রচেষ্টার স্বীকৃতিতে এই গ্রুপকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ বেসরকারি অনুদানের ওপর ভিত্তি করে ২০০৭ সালে আইক্যান তাদের যাত্রা শুরু করে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংগঠনটির সদর দপ্তর অবস্থিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার, উন্নয়ন, পরিবেশ, শান্তি সংগঠনসহ ১০১টি দেশের ৪৬৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইক্যানের সঙ্গে কাজ করছে।

প্রসঙ্গত, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় বিশেষ অবদান রেখে যুগে যুগে অনেকেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই পরে ভক্ত-সমর্থকদের হতাশ করেছেন। শুধু যে হতাশ করেছেন তা নয়, যারা একসময় প্রশংসায় ভাসিয়েছেন, পরে রীতিমতো তাদের সমালোচনার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্রকামী’ নেত্রী অং সান সু চি এই শান্তিকামীদের তালিকার সর্বশেষ জন, যারা শান্তি রক্ষার কথা রাখেননি। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি রাখাইন বৌদ্ধদের চলমান সহিংসতায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে অনেকে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে হাজারো বাড়িঘর। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৫ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মিয়ানমারের সু চি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় নির্বিকার। সু চির এমন ভূমিকায় তার সমালোচনা যারা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুও।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে নোবেল পান ১৯৭৩ সালে। যে প্রচেষ্টার জন্য তারা এই পুরস্কার পান, সেটা ভিয়েতনাম যুদ্ধ অবসানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। থো এ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তার অভিযোগ ছিল, ওয়াশিংটন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েও যারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে না পেরে সমালোচিত হয়েছেন তাদের অন্যতম ইসরাইলি নেতা মেনাচেম বেগিন। ১৯৮২ সালে লেবাননে আগ্রাসন চালানোর নির্দেশ দেন। এর মাত্র চার বছর আগেই ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি সই করে মিশরের আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল ভাগাভাগি করে নেন তিনি। ১৯৮১ সালে ইসলামপন্থি এক সেনাসদস্যের হাতে খুন হন সাদাত। শীতলযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ অবসান ঘটাতে ভূমিকা রাখায় ১৯৯০ সালে শান্তিতে নোবেল পান সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ। এক বছর বাদেই ১৯৯১ সালে বাল্টিক দেশগুলোর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মাটিতে মিশিয়ে দিতে দেশগুলোতে সামরিক ট্যাংক পাঠান তিনি। শেষ পর্যন্ত দেশগুলো স্বাধীনই হয়েছে। অসলো চুক্তির জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল জয় করেন ইসরাইলি নেতা আইজ্যাক রবিন ও শিমন পেরেজ। তবে এটি আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব স্থায়ীভাবে মেটাতে পারেনি। পুরস্কার পাওয়ার এক বছর পরই ১৯৯৫ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন আইজ্যাক রবিন। ২০১৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করেছিলেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস। বহুল প্রত্যাশিত একটি শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রায় ৫২ বছরের রক্তাক্ত সংঘাতের ইতি টানার জন্য তিনি এই স্বীকৃতি পান। কলম্বিয়ায় ৫২ বছরের ওই সংঘাত ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

সৈয়দ শিশির: কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :