যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

তায়েব মিল্লাত হোসেন
 | প্রকাশিত : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:০৭

কোনো প্রযুক্তিগত যুক্তি নয়। আমার মগজ যা বলতে চায়, তা হচ্ছে, রেলগাড়ির ক্ষুদে সংস্করণ ট্রাম। দেশবিভাগের সাত দশক পরে এসে আমরা যারা বাংলাদেশ কালের মানুষ তাদের কাছেও ট্রামের শহর মানেই কলকাতা। এই পুর্বে সাতকুলেও যে কেউ ট্রাম চলতে দেখেনি। ইংরেজদের শহর কলকাতার বুকে নাগরিকদের নিয়ে আজো চড়ে বেড়ায় এই বাহন। তারও আগের মুঘল নগর ঢাকায় কোনোকালেই ট্রাম ছিল না। তারই অধুনা সংস্করণ মেট্রোরেল আসলো বলে! যা ঢাকার আকাশ-বাতাসে ঝুলে থাকা লাইন ধরে ঘুরে বেড়াবে। কোনো এক পঞ্চমীর চাঁদরাতে, যখন চাঁদ ডুবে যাবে- তখন কেউ কী মেট্রোর লাইনে গিয়ে শুয়ে থাকবে? কেবল মৃত্যুকে ভালোবেসে?

যাই হোক নদীর মতোই জীবন আর মরণ পাশাপাশি শুয়ে থাকে রেললাইনে। রেলের চাকার ঝক ঝক ঝকে আছে প্রাণের পরশ। আবার এর অন্তঃপুরে লুকিয়ে আছে শেষ বিদায়ের বেদনার রাগিনী। যার সুর কেবল মৃত্যুবিলাসীদের কানে অবিরাম বেজে চলে। আরেক দল যারা নেশার লাটিমের মতোই জীবন চায়। চায় একটা ঝিম ধরা জীবন। তাদের জন্যেও দেশ-দেশান্তর থেকে রূপ-রস-সুধা নিয়ে হাজির হয় রেলগাড়ি। আবার বিবাগীরা নিজেরাও সব পিছুটান ফেলে চড়ে বসে অজানা গন্তব্যে, হারিয়ে যায় দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া রেললাইনের মতোই। সেই রেল ধরেই যুগান্তর শেষে ফিরে আসার গল্পও আছে। তাদের কেউ হারিয়ে যাওয়া শিশু, কেউ বিজয়ী যোদ্ধা, কেউবা অবিসংবাদিত নেতা। বরিত আর স্বাগতিক- সবার প্রচ্ছদে যেখানে আনন্দাশ্রু।

রেলের বিশালতা মহাবিশ্বের মতোই। দেশ থেকে মহাদেশ পেরিয়ে যেতে পারে। সেই তুলনায় ট্রাম কেবল একটি নগরের গল্পই বলে যেতে পারে। ঢাকায় নেই তা। আমরা হাত পাতি শুধুই কলকাতায়। সেই গল্পতো আমাদের আব্বাদের। এই কালে এসে তা শুধুই শোনা কথার মতো। রূপকথার মতো। চড়িনি বলে ট্রাম আমার কাছে সোনার পাথর বাটি। সেই বাটি তো নেই। ট্রাম আছে কলকাতাতেই, অদূরেই!

ট্রাম নিয়ে জানতে হলে কী আর খুব দূরে যেতে হবে। এই তো জ্ঞানের বিশ্বকোষ উইকিতে একটু হামলে পড়ি। তারা বলছে, ট্রাম প্রথমত যাত্রীবাহী যান। কিছু ক্ষেত্রে এ দিয়ে পণ্যও বাহিত হয়। রাজপথে স্থায়ী ট্র্যাকের উপর ট্রাম চালানো হয়। কোনো কোনো কেবল কারও ট্রাম নামে পরিচিত। এর আরো ডাক নাম আছে। যেমন, ট্রামকার, ট্রলি, ট্রলিকার বা স্ট্রিটকার। সিলেসিয়ান ইন্টারআরবানস ও মেলবোর্নের ট্রাম নেটওয়ার্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্রাম নেটওয়ার্ক। গেল শতকের আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ ট্রাম নেটওয়ার্কটি কিছুকালের জন্য বিশ্বসেরা ট্রাম নেটওয়ার্ক হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ঠাঁই নিয়েছিল। আমস্টারডাম, বাসেল ও জুরিখ শহরেও বৃহৎ ট্রাম নেটওয়ার্ক রয়েছে। তিরিশের দশকে ট্রলিবাসে রূপ নেয়ার আগে প্রথম প্রজন্মের লন্ডন ট্রাম নেটওয়ার্ক ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ট্রাম পরিষেবা।

বিশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, ফরাসি ও মার্কিন শহর থেকে প্রায় সব ট্রাম উঠে যায়। কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশে ট্রাম চালু থাকে। ট্রাম তবু কমতেই থাকে। তবে আশির দশকে আবার ফিরে আসতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আরো কিছু দেশে নতুন ট্রাম নেটওয়ার্ক চালু হয়। ভারতবর্ষে একমাত্র ট্রামপরিবহণ কলকাতায় চালু রয়েছে। যা চালু হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩ সালে ইংরেজ শাসকদের তত্ত্বাবধানে। প্রথমে ঘোড়ার সাহায্যে ট্রাম চালানো হত। পরে আসে বাষ্পীয় ইঞ্জিন। তারও পরে ১৯০২ সালে যোগ হয় বিদ্যুতায়িত ব্যবস্থা। সূচনাকালে যাত্রাপথের দূরত্ব ছিল তিন দশমিক নয় কিলোমিটার। কিন্তু যাত্রীর অভাবে এই পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি নামে একটি লন্ডনভিত্তিক কোম্পানি কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা শুরু করে।

কলকাতার বিখ্যাত ট্রাম শতবর্ষ থেকে যখন ১৯ বছর আগে, ঠিক তখন সেটা ১৯৫৪ সাল। ১৪ অক্টোবর। বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনা ঘটে। একজন আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর প্রায় দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু আর পাঁজরের হাড়। গুরুতর আহত সেই মানুষটির যন্ত্রণা-ধ্বনিতে ছুটে আসে কিছু মানুষ। তাঁকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। সপ্তাহখানেকের চিকিৎসা কোনো কাজে আসে না। ২২ অক্টোবরে এসে শেষ দম নেন আহত সেই মানুষটি। ডুবে যায় চাঁদ। অমরত্বের আকাশে নক্ষত্র হয়ে ভেসে ওঠেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। ট্রামের ঘটনা দুর্ঘটনা নাকি আত্মহননের ব্যর্থ চেষ্টা- আজ অবধি তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। তার উত্তর নেই মানুষের কাছে! শঙ্খচিল, শালিক, ভোরের কাক কিংবা হাঁসেদের কাছে কী আছে?

তায়েব মিল্লাত হোসেন: গণমাধ্যম ও সাহিত্যকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :