সন্তানের মৃত্যুর পর অবশেষে হাসপাতালে ঠাঁই পারভীনের

প্রকাশ | ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৫৮

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

তিনটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান জন্ম দেওয়া পারভীন বেগম তার ছেলের মৃত্যুর পর এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাজার দেড়েক টাকার অভাবে যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তাকে বের করে দিয়েছিল এখন তারাই তাকে শয্যার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক সালমা রউফের অধীনে ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর শয্যায় অবস্থান করছেন পারভীন।  অবস্থা ভাল হলেই তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক সালমা রউফ।

রবিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বিছানায় গিয়ে দেখা যায় পারভীন বেগম রুই মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন।

ঢাকাটাইমসকে পারভীন জানান, তিনি আগের চেয়ে ভালো বোধ করছেন। তবে সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

পারভীন জানান, একমাস আগে তার স্বামী হৃদয় ওরফে সোহেলের সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় এসে গোলাপশাহ মাজারে আশ্রয় নেন। পরে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে পারভীনকে একা ফেলে নেত্রকোণায় চলে যান সোহেল। সেখানে গিয়ে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন সোহেল।

পারভীনের বাবার বাড়ি যশোরের শার্শা থানায়। সোহেল তার দ্বিতীয় স্বামী। আগের ঘরে তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।

যে অমানবিকতার শিকার পারভীন

গত ১৬ অক্টোবর ভোরে গুলিস্তান গোলাপশাহ মাজারের বসে কাঁদছিলেন পারভীন বেগম।  ওই সময়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সোহেল নামের এক যুবক। পারভীন তাকে ডেকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানান। পরে পারভীনকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে  নিয়ে যান সোহেল। সেখানে প্রথমে পারভীনের স্বাভাবিক প্রসবের কথা বলা হয়। পরে চিকিৎসকরা জানান, সিজারের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু ওষুধ-পথ্য কিনতে টাকা না থাকায় সে অস্ত্রোপচার আর হয়নি।

সংকটাপন্ন অবস্থায় পারভীনকে পাঠান হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। পরে সোহেল ভোরের দিকে পারভীনকে নিয়ে যান আজিমপুর ম্যাটারনিটিতে। কিন্তু সেখানেও পরিস্থিতির কোনো বদল হয়নি। প্রসব বেদনায় কাতরান মায়ের টাকা না থাকায় টানাহেঁচড়া করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেন হাসপাতাল কর্মীরা। কিছুক্ষণ পরই ওই ম্যাটারনিটির গেটের সামনে সড়কের ওপর পড়ে যান পারভীন। সেখানেই এক ছেলে সন্তান প্রসব করেন তিনি। পথচারী ও আশপাশের কয়েকজন নারী এ সময় এগিয়ে এসে পারভীনকে শাড়ি পেঁচিয়ে আড়াল করে প্রসবে সাহায্য করেন।

সোহেল জানান, নবজাতক জন্ম নেওয়ার আনুমানিক মিনিট দুয়েক পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই দৃশ্য দেখে এবং পরভীনের কান্না শুনে এলাকাবাসী ও পথচারীরা এগিয়ে এসে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ আসে। একপর্যায়ে হাসপাতালের লোকজন এসে পারভীনকে ট্রলিতে তুলে ভেতরে নিয়ে প্রসব-পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

হাসপাতালের কর্তা ব্যক্তিরা এখন যা বলছেন

পারভীনের প্রসবের ব্যবস্থা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড) পরিচালক ব্রায়ান হালদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সিজার করতে কিছুই কিনতে হয় না। কিন্তু এমনটা কেন হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ওই রোগী পারভীন আমাদের এখানে এসেছিল এটাও সত্য আবার তার চিকিৎসা হয়নি এটাও সত্য। আবার আমাদের এখানে বিনামূল্যে সব ধরনের গরিব রোগীর চিকিৎসা করা হয় এটাও সত্য। তবে পারভীনের ক্ষেত্রে কেন তার ব্যতিক্রম হয়েছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম নাসির উদ্দিনের মুঠোফোনে পারভীনের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন রাস্তায় আছি আপনি আধাঘন্টা পর ফোন করেন।’ পরে একাধিকবার তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি তার ফোন ধরেননি।

আজিমপুর ম্যাটারনিটির তত্ত্বাবধায়ক ইশরাত জাহান বলেন, ‘ওই রোগী আসার পর তাকে লেবার রুমে শোয়ানো হয়। এ সময় হয়তো দালালচক্রের সদস্যরা রোগীকে কোনোভাবে বাইরে নিয়ে যায়। এর পরও গেটে দারোয়ান থাকতে কীভাবে ঘটনাটি ঘটল তা দেখা হবে।’

এই চিকিৎসক জানান, এ ঘটনায় গাইনি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট হোসনে জাহানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পারভীন বেগমের বিষয়টি গণমাধ্যমে জানাজানি হলে কেন উচ্চ আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং তাকে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল করতে বলেছেন আদালত। আগামী ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সমাজকল্যাণ সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং আজিমপুর মাতৃসদনের সুপারিন্টেডেন্টকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা হাইকোর্টকে তদন্ত করে রুলের জবাব দেব। তাই এই মূহুর্তে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমাদের দেশের সকল সরকারি হাসপাতালেই রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে নেই স্বদিচ্ছার অভাব।

(ঢাকাটাইমস/২৩অক্টোবর/এএ/ডব্লিউবি)