ছাত্রলীগ খারাপ, ছাত্রলীগ ভালো

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ২১:০৯

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিংবা এর সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো কর্মের প্রশংসা বা অপকর্মের নিন্দা দুটোই সমান বিপদজনক। প্রশংসা করলে অনেকে মনে করেন, এর পেছনে রাজনৈতিক অভিলাস (প্রচলিত ভাষায় ধান্দাবাজি) আছে। আবার নিন্দা করলে অনেকে ভাবেন, এর পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা রয়েছে। কিন্তু, ভালো কাজের প্রশংসা করতেই হবে, তেমনই মন্দ কাজের নিন্দা। শুধুই প্রশংসা বা শুধুই নিন্দা মানুষের কাজের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়। দিন দিন সমাজ থেকে প্রশংসাও যেন উঠে যাচ্ছে। প্রশংসার নামেও যা হয়, তার অধিকাংশই আবার চামচামি। আর নিন্দা করতে আমাদের অনেকেরই অনেক ভালো লাগে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

দেশের কৃষক-শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ সরল মনে নানা ঘটনায় ভালো-মন্দ বলে ফেললেও দেশের শিক্ষিত মানুষের একটা অংশ শিক্ষার ‘আলোয়’ সমস্ত সরলতাকে কবর দিয়ে বেশ জটিলতা অর্জন করেছে। নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ-অনুকূলে কিছু ঘটলে বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোনো ভুল বা অপরাধ করলে একে কেন্দ্র করে শিক্ষিত সমাজের এই অংশের মুখে কথার খই ফোটে। আবার নিজেদের পক্ষের কেউ অপরাধ করলে বা প্রতিপক্ষ ভালো কাজ করলেও এই ‘শিক্ষিত সমাজ’ মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে।

বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কোনো কাজের প্রশংসা করা সহজ কাজ নয়। ছাত্রলীগ কোনো ভালো কাজ করলে, তথাকথিত ‘সুশীল’ সমাজ ও রাজনৈতিক নিন্দুকরা বলে এতো ‘লোক দেখানো’। ক্ষমতাসীনরা নিজেরাও অনেক ক্ষেত্রে উটকো লোকের প্রশংসা পছন্দ করে না। ভাবে নতুন কোনো স্বার্থান্বেষীর আগমন ঘটেছে। তাই তাদের প্রকৃত ভালো কাজও যথাযথ প্রশংসা পায় না। কাজে-অকাজে নেতিবাচক সংবাদ হতে হতে ছাত্রলীগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারনা নেতিবাচকতায় পরিপূর্ণ। এর জন্য ছাত্রলীগকেই দায়ী করতে হয়। কারণ ক্ষমতা কাঠামোর মারপ্যাঁচে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করে ফেলে যার ফলে জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠনকে খুব বাজে কথা শুনতে হয়। অথচ সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে ছাত্রলীগের ছেলে-মেয়েদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে।

ছাত্রলীগ নিয়ে কিছু ভালো-মন্দ লিখতে আমাকে বাধ্য করল এই সংগঠনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা-কর্মীদের সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি দারুণ সমাজসেবামূলক কাজ। ছাত্রলীগের মূলদল আওয়ামীলীগ গত ৮ বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তাই ছাত্রলীগ মানে অনেক বুঝে শুধু ক্ষমতা আর ক্ষমতা। নেতা-কর্মীদের অধিকাংশ নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালেও দুএকজন নেতা যে অবৈধ বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেন না, তা নয়। নানা কারণে ছেলে-মেয়েরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। তবে এখনো অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মানবতাবাদী আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়। তবে আগ্রাসী ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একে অপরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি কোনো কোনো ইউনিটের ছাত্রলীগ।

এখানেই ব্যতিক্রম কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গত সাড়ে তিন বছর ছাত্রলীগের মধ্যে বড় ধরনের কোনো কোন্দল বা সংঘর্ষ দেখা যায়নি। ছাত্রলীগের জন্য হল বা পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি। এর মধ্যে সদ্য সমাপ্ত ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন ও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ এমন দুটি কাজ করেছে যার জন্য এরা প্রশংসার যোগ্য। ভর্তি পরীক্ষার সময় দেশের অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়, ছাত্রলীগ নবীনদের স্বাগত জানানোর নামে মিছিল-মিটিং করে ক্যাম্পাসে আতংক সৃষ্টি করে। এখানে ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর ছাত্রলীগ। মিছিল যে করেনি তা নয়; করেছে, তবে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই।

ছাত্রলীগ নিজেদের একটা টেন্ট বানিয়ে সেখানে নবীনদের জন্য সার্বক্ষণিক নানাবিধ সেবা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে মাইকে সারাক্ষণ কেউ না কেউ কথা বলেছে। এমনকি দূর থেকে পরীক্ষা দিতে আসা অচেনা পরীক্ষার্থীর হারিয়ে যাওয়া কাগজপত্র খুঁজে পেতে আকাশ-পাতাল এক করেছে এই ছাত্রলীগ। শুধু ছাত্রলীগ নয়, ছাত্র ইউনিয়ন, ফ্রন্টসহ সব রাজনৈতিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, জেলা-উপজেলা ছাত্রকল্যাণ সংগঠনসহ প্রায় সবাই টেন্ট বানিয়ে বহিরাগত অতিথিদের নানাবিধ সেবা দিয়ে গেছে। হলের ছেলে-মেয়েরা নিজেরা নিজেদের রুমে না ঘুমিয়ে পরীক্ষার্থীদের ঘুমোতে দিয়েছে।

ভর্তি পরীক্ষার পরের দিন ছাত্রলীগ যা করল তাতে বিস্মিত হয়েছি। সকালের বাসে ক্যাম্পাসে গিয়ে রসায়ন ভবনের কাছেই নেমে যাই। ফাঁকা ক্যাম্পাসে হাঁটতে ইচ্ছে করল। হাঁটতে গিয়ে এখানে-সেখানে ময়লার স্তূপ দেখে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। ময়লার ছবি তোলে রাখলাম। ভাবলাম প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দেখিয়ে দ্রুত এই ময়লা পরিস্কারের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করব। কারণ ময়লা যে বা যারাই করুক, পরিষ্কার করার দায়িত্ব অফিসিয়ালি কর্তৃপক্ষেরই। সিঁড়ি বেয়ে চারতলার অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই শুনি জয়বাংলার স্লোগান। প্রথমে ভাবলাম, সাধারণ নিয়মিত কোনো মিছিল। কানে এল ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা অভিযান সফল হউক’। শহীদ মিনারে কয়েক শ ছেলে-মেয়ে জড়ো হল। মাইকে ঘোষণা করা হল খানিকবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর ফারজানা ইসলাম এই পরিষ্কার অভিযানের উদ্বোধন করবেন।

চারতলার বারান্দা থেকে দেখলাম। উপাচার্য মহোদয় উদ্বোধন করে নিজেই ঝাড়ু নিয়ে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে নেমে গেলেন। শহীদ মিনার ঝাড়ু দিয়ে, পাইপের পানি দিয়ে একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে ফেলল একদল মেয়ে। ছাত্রলীগের ছেলে-মেয়েরা ঝাড়ু ও বস্তা হাতে পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ল। বিকেল বেলা যখন বাসে ঢাকায় ফিরি, তখন আশপাশে তাকালাম। ময়লা-আবর্জনা চোখে পড়ল না। অন্য শিক্ষকরাও বিস্মিত হলেন আমার মত। বললেন, এবার ক্যাম্পাস খুব একটা ময়লা হয়নি। আমি বললাম, ময়লা হয়েছিল ঠিকই, ছাত্রলীগ পরিষ্কার করে ফেলেছে। একজন বললেন, ‘বাহ, এমন ছাত্রলীগই তো আমরা চাই’।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :