পড়ান বিনা বেতনে, খাতা-কলমও দেন

জাভেদ হোসেন, গাইবান্ধা
 | প্রকাশিত : ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:০৬

পিছিয়ে পড়া ১৮০ জন গরিব ছাত্রছাত্রীদের প্রায় এক বছর ধরে ছুটির দিনগুলোতে বিনা বেতনে পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। প্রতিমাসে দিচ্ছেন খাতা-কলম। শিক্ষকের নাম রাকিবুল আলম রানা। তিনি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর পিএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের দক্ষিণ গিদারী গ্রামে রাকিবুল আলম রানার বাড়ি।

২০১৬ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তার এই কাজে সহযোগিতা করছেন গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র সেলিম মিয়া।

রাকিবুল আলম রানার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বাবা মরহুম আব্দুল ওয়াহাব মিয়া ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আর মা রাবেয়া বেগম ছিলেন গৃহিনী। দুই ভাই, ছয় বোনের মধ্যে রাকিবুল আলম সবার ছোট। ভাই-বোনদের সবার বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ভাই ফিরোজ আলম ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। আর সপ্তম বোন সেলিনা সুলতানা গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের ল্যাপটপের মাধ্যমে ইংরেজি শেখাচ্ছেন শিক্ষক রাকিবুল আলম রানা। তার সাথে গলা মিলিয়ে ইংরেজি উচ্চারণ রপ্ত করছে ছাত্র-ছাত্রীরা। পাশের কক্ষে গণিত করাচ্ছেন সেলিম মিয়া।

গিদারী ইউনিয়নের গিদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরকেরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্বধুতিচোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আনালের ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ধুতিচোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গিদারী দ্বিমূখী উচ্চ বিদ্যালয় ও পাশ্ববর্তী কামারজানি ইউনিয়নের কামারজানি মার্চেন্টস উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির প্রায় ১৮০ জন ছাত্রছাত্রী গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পড়ে এই শিক্ষকের নিকট।

পূর্বধুতিচোরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মিজানুর রহমান জানায়, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে আমি খুব দুর্বল ছিলাম। স্যার খুব ভালোভাবে পড়ান। রানা স্যারের কাছে পড়ে খুব ভালো লাগছে। পড়া না বুঝলে তিনি ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দেন। তার কাছে পড়ে খুব উপকার হচ্ছে।

গিদারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রুপালী আক্তার জানায়, চার ভাই-বোনের মধ্যে আমরা তিনজন পড়াশোনা করি। এতে অনেক টাকা খরচ হয়। কিন্তু বাবার পক্ষে এতটাকা খরচ করা সম্ভব হয় না। স্যারের কাছে পড়ি, কিন্তু স্যার কোন টাকা নেন না। আবার ভালোভাবেও পড়ান।

ধুতিচোরা গ্রামের অভিভাবক সোহরাব হোসেন বলেন, আমি কৃষি কাজ করে কোনরকমে সংসার চালাই। আমার এক ছেলে অষ্টম ও এক মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। রানা স্যার খুব ভালোভাবে পড়ান। ছাত্রছাত্রীদের আবার খাতা-কলমও কিনে দেন তিনি।

রাকিবুল আলম রানা ঢাকাটাইমসকে বলেন, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাস করতে না পারলে অনেক ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়ে যায়। তারা আর স্কুলমুখী হয় না। তাই তারা যাতে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে না যায়, তাই গরিব ছাত্রছাত্রীদের বিনাবেতনে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পড়ানো হয়। আমি ভবিষ্যতে ওদের জন্য সকল বিষয়ের ক্লাস নিতে চাই। ঘর করার মত জায়গা আছে, কিন্তু অবকাঠামো করার মতো আর্থিক অবস্থা আমার নেই।

তিনি আরও বলেন, পিছিয়ে পড়া দরিদ্র ঘরের এসব ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট পড়ার কোন সুযোগ পায় না। স্কুলে ঠিকমতো গণিত ও ইংরেজি বুঝতে পারে না বলে এই দুই বিষয়ে পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো হয় না তাদের। এর প্রভাব পড়ে হাইস্কুল ও কলেজে গিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় না। তাই শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে এসব ছাত্রছাত্রীদের গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস নেয়া হয়।

স্থানীয় সমাজসেবক গোলাম আশিক যাদু বলেন, রানা স্যারের এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। তার কাছে বিনা বেতনে পড়ে গরিব ছাত্রছাত্রীদের উপকার হচ্ছে। তার পাশে সকলের দাঁড়ানো উচিত। এ রকম সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, তার এই উদ্যোগ খুব ভালো। তাকে সবসময় উৎসাহ ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। রানা স্যারের কাছে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুব উপকার হচ্ছে। আগের চেয়ে ফলাফল অনেক ভালো হচ্ছে।

গিদারী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. হোসেন আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, তার এই ভালো উদ্যোগের কারণে আমাদের স্কুলের দুইটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে যারা দুর্বল আশেপাশের কয়েকটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ছুটির দিনগুলোতে শুধু তাদের ক্লাস চলে। এজন্য কোন ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে কোন টাকা নেয়া হয় না।

(ঢাকাটাইমস/২৪অক্টোবর/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :