পায়ে পায়ে রোহিঙ্গা-০৩

পাহাড় কাটা থেমে নেই

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
| আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:০০ | প্রকাশিত : ২৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:৪১

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ঠাঁই হয়েছে রোহিঙ্গাদের। পাহাড় কেটে ঘর তোলা হয়েছে। জ¦ালানির জন্য উজাড় হচ্ছে বন। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পণ্যমূল্য, গাড়িভাড়া দ্বিগুণ বৃদ্ধি। নিরাপত্তাহীনতায় স্থানীয় অধিবাসীরা। ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরো নানা উদ্বেগজনক তথ্য।

উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুরে এসে লিখেছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ। সহযোগিতায় ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন, সৈয়দ ঋয়াদ ও বলরাম দাশ অনুপম। আজ থাকছে তৃতীয় র্পব।

গইয়ালমারা পাহাড়ের চারপাশেই মাথা তুলেছে রোহিঙ্গা ডেরা। কোথাও এখন আর একটি গাছও নেই। অথচ মাস ছয়েক আগেও এখান থেকে বনমোরগ ধরেছেন স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল আলম। তিনি বলেন, ‘এখানে একা আসতে আগে ভয় হতো। এখন পাহাড়ের নিচে দাঁড়ালে কান্না আসে। কী পাহাড় কী হই গেলোগুই!’

এই পাহাড়ে ঠাঁই পাওয়া রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বালুখালী-কুতুপালংয়ে নতুন বরাদ্দ পাওয়া এক হাজার একর বনের জায়গায় হচ্ছে নতুন বসতি। সেখানেও চলছে গাছ নিধন। পাহাড় কেটে গর্ত করে তোলা হচ্ছে ঘর। সপ্তাহ দেড়েক ধরে এই প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন সেনা সদস্যরা। তবে এখনো কয়েক শ পরিবার আছে পাহাড়ে। আর যারা চলে গেছেন তাদের হাতে করা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়।

পাহাড়ে ঘর করে থাকা রোহিঙ্গা নারীদের অনেকে গর্ভবতী। সদ্য সন্তানও প্রসব করেছে কেউ কেউ। লালু তাদের একজন। উত্তরের দিকে প্রথম সারিতে তার ঘর। ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা গেল, সদ্য নবজাতক শিশুটিকে একটা পাতলা কাপড় বিছিয়ে মাটিতেই শুইয়ে রাখা হয়েছে। এই নারী জানান, রাখাইনে সেনা নির্যাতনে তিনি তার স্বামী হারিয়েছেন। মংডুর জামুইননা গ্রাম থেকে এখানে এসেছেন ভাইয়ের সঙ্গে।

এই নারীর ঘরের ঠিক দশ গজ পেছনে মাটি কাটতে দেখা গেল দুই ব্যক্তিকে। এদের একজন আইয়ুব। অন্যজন ইদরিস। জানালেন, এক মাস হয় এখানে এসেছেন। এখন পাহাড়ের মাটি কাটার কারণ জানতে চাইলে আইয়ুব বলেন, ঘর তুলবেন। এক ঘরে হচ্ছে না। নতুন ঘর লাগবে। কথা বলার সময়ও কোদাল চলছিল তাদের। ইদরিস জানান, তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস সন্তান-সম্ভবা।

রাস্তার পশ্চিমে শফিউল্লা কাটা পাহাড়ের পেছনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আরও কয়েকটি পাহাড় রয়েছে। এখন সবকটিই গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা নিবাস। এখানকার পরিবেশ এতটা বিপর্যস্ত যে, খোলা হাওয়ায় নিঃশ^াস নেয়ার উপায় নেই। প্রশ্রাব-পায়খানার বিদঘুটে দুর্গন্ধ বাতাসের দমকায় রাস্তাতেও এসে পৌঁছাচ্ছে। এই পথেই যেতে হয় টেকনাফে। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় বাসযাত্রীদেরও চলতে হয় নাক চেপে।

কিছু দূরেই থ্যাংখালী। এই এলাকার পাহাড়গুলো আছে রোহিঙ্গাদের দখলে। থ্যাংখালী বাজারের আশপাশে বেশকিছু কৃষি জমিতেও আছে রোহিঙ্গা স্থাপনা। বাঘঘোনা এলাকার উদ্বিগ্ন বাসিন্দা ইসলাম আরো যোগ করলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। গ্রামের বাড়িঘর খোলামেলাই থাকে। সবাই সবার কমবেশি মুখ চেনা। যে কারণে চুরিধারি প্রায় হয় না বললেই চলে। এখন রোহিঙ্গাদের কারণে পথ চলাই কঠিন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তাদের পদচারণায় পথঘাট ব্যস্ত থাকে।’

রোহিঙ্গারা জ¦ালানির কাঠ সংগ্রহ করার জন্য দেদার উজাড় করছে বন। প্রায় আট লাখ মানুষের রান্নার জন্য প্রতিদিন বন থেকে গাছ কাটা হলে অল্পদিনেই ফাঁকা হয়ে যাবে বন। স্থানীয় প্রশাসনও এখানে নিরুপায়। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে লাগানো গাছেও হাত দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ময়নাঘোনার স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল এই সময়কে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে বাড়িঘরের আশপাশের গাছপালাও পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। ’

বন উজাড় হচ্ছে, পাহাড় ধসের শঙ্কা? এবার রোহিঙ্গা ঢলের কারণে কক্সবাজার জেলার এলাকাগুলোয় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে ৫০ থেকে ১০০ বছর লাগবে বলে মনে করেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। তিনি বলেন, ‘পাহাড়, বন- সব মিলিয়ে পরিবেশের সুরক্ষা করতে যত দ্রুত সম্ভব সম্মানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরাতে হবে। নয়তো বিভিন্ন দেশ মিলে ভাগ করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে তাদের সবাইকে রাখা অসম্ভব। কক্সবাজারের রিজার্ভ ফরেস্ট, পাহাড়ি অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন রাখা ঠিক হবে না।’

টেকনাফের হোয়াইক্যং বাজার থেকে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে ডানে। একসময় এই বাজারে দিনে এক শ মানুষের আনাগোনা না হলেও এখন লাখো মানুষের পথ এটি। এই পথ চলে গেছে উনছিপ্রাং, পুঠিবুনিয়া, রাইখম্যং ও চাকমাপাড়ায়। মূল রাস্তা থেকে উনছিপ্রাং যেতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় দুই কিলোমিটার পথ। ব্যক্তিগত পরিবহন না থাকলে পায়ে হেঁটেই যেতে হয় রোহিঙ্গাদের ডেরায়। আশপাশে গাছের কোনো বালাই নেই। গোড়াসহ তুলে ফেলা হয়েছে। ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে এখনো বিস্তীর্ণ বনভূমি আছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, এসব বন বাইরে থেকে ঘন মনে হলেও ভেতরে গাছ কেটে খালি করে ফেলা হচ্ছে। উনছিপ্রাং, রাইখম্যং ক্যাম্পে ঠাঁই পাওয়া রোহিঙ্গারা দিনের আলোতে আবার কখনো রাতের অন্ধকারে গাছ কেটে আনছে। সেগুলো দিয়ে চুলা জ¦ালাচ্ছে। আবার বাজারেও বিক্রি করছে চড়া দামে। কিছু বললে এসব রোহিঙ্গা স্থানীয়দের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। উগ্রতাও দেখায়। ভয়ে স্থানীয়রা তাদের কিছু বলে না বলে জানিয়েছেন রফিকুল ইসলাম।

উনছিপ্রাং থেকে কয়েক কিলোমিটার সামনে গেলে নয়াপাড়া মুসুনি। ইউনিয়নের নাম হ্নীলা। এখানেও বেশ কয়েকটি বড় রোহিঙ্গা শিবির করা হয়েছে। আছে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও। বড় শিবির লেদায়। মুসুনি আর লেদা দুটো এলাকার বনভূমি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে।

লেদায় অস্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের থাকতে দেয়া হয়েছে। এরা পাহাড়ের গাছ কেটে ঘর বেঁধেই শান্ত হয়নি, জ¦ালানির জন্য উজাড় করছে বন। তরতাজা গাছ কেটে লাকড়ি বানাচ্ছে। জ¦ালানি ব্যবহারের পর বাকি লাকড়ি বিক্রি করছে মুসুনি অথবা লেদা বাজারে। কথা হয় রোহিঙ্গা তরুণ কাসির আলমের সঙ্গে। দুই বোঝা জ¦ালানির কাঠ নিয়ে যখন সে লেদা বাজারে পৌঁছে তখন দুপুরের আজান হয়েছে। ‘কোথা থেকে এই লাকড়ি এনেছেন?’ জানতে চাইলে এই তরুণ বলেন, ‘বনোত্তুন কাইস্যি দে’ (বন থেকে কেটেছি)। কেন বন থেকে এভাবে চিকন গাছগুলো কেটে আনলেন? তার স্পষ্ট উত্তর, ‘বেইচবার লাই’ (বিক্রি করার জন্য)। দাম কত? হাতের তিনটা আঙুল মেলে ছেলেটি জানায়, ‘তিনশ টিয়া।’ তিনি জানান, প্রতিদিন এভাবে লাকড়ি বাজারে বিক্রি করেন। দিন শেষে সেই টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন। কোনো কিছু কেনাকাটা করতে হয় না? কাসির আলম জানায়, ত্রাণ থেকে চাল, ডাল, তেল যে পরিমাণ পাচ্ছেন সেগুলোই অনেক। তার পর আর কেনার প্রয়োজন হয় না। তবে কেন প্রতিদিন বনের কাঠ উজাড় করা হচ্ছে? রোহিঙ্গা তরুণের জবাব, ‘টিয়া লাইবো’ (টাকা লাগবে)।

লেদায় ত্রাণ কেন্দ্রে যাওয়ার আগে রাস্তার দুপাশে রোহিঙ্গা শিবির। এখানকার চিত্রটা ভিন্ন। বন বিভাগের জায়গা ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গাতেও ঘর করেছে শরণার্থীরা। লেদা ক্যাম্পের দিকে যাওয়ার আগে হাতের ডানে চোখে পড়লো ‘সফিক মঞ্জিল।’ মালিকের নামটিও লেখা আছে ফলকে। আনোয়ার ইসলাম। চারপাশে দেয়াল তোলা ও একটি ফটক থাকলেও এই মঞ্জিলের ভেতরে কোনো পাকা স্থাপনা নেই। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দম বন্ধ হয়ে এলো। পয়োবর্জ্যরে দুর্গন্ধ। এখানে বসত গড়েছে রোহিঙ্গারা। তিন সারিতে ঘর তোলা হয়েছে। মাঝ দিয়ে গেছে পয়োবর্জ্যরে নালা। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সেখান থেকেই। একটি ঘরের চালে উঠে মেরামত করছিলেন মো. ইসমাইল। বয়স ২৫ বছর। তিনিও মাসখানেক আগে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। ইসমাইল জানান, ত্রাণের বাঁশ, পলিথিন দিয়ে ঘর তারা নিজেরাই বেঁধেছেন। তবে জায়গার জন্য প্রতিমাসে এক হাজার টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। শামসু আলম নামে ৫৫ বছরের এক প্রবীণ জানালেন, ৬০টি ঘর আছে এখানে। ঘরের পেছনের দিকটায় ডোবা। ডোবা লাগোয়া শৌচাগার থেকে উপচে পড়ছে মানুষের মল। সেই মল ভাসছে পানিতে।

সফিক মঞ্জিল পার হয়ে হাতের বাঁয়ে ফসলের খেত। তার পাশে আরো একটি দেয়াল ঘেরা জায়গায় রোহিঙ্গা বসতি। সেই দেয়াল ঘেরা জায়গা থেকে মোটা পাইপ দিয়ে পয়োবর্জ্য নামছে ধানের খেতে। একপাশের ধান মরে গেছে বিষাক্ত পানিতে। তারপরের পথটি টিলার মতো উঁচুতে উঠেছে। এই পথে উঠতেই দেখা গেল এক ব্যক্তি লাঠি হাতে কাকে যেন শাসাচ্ছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মুসুনি বন বিটের কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমান।’ লাঠি হাতে কী করছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আর কী করবো ভাই, এদের (রোহিঙ্গা) কারণে বনের গাছ একটাও রাখা যাবে না। সুযোগ পেলেই বনের গাছ কেটে আনে। লাকড়ি বানায়। বাজারে বেচে।’

হ্নীলা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে পড়েছে লেদা খাল। খাল শুকিয়ে এখন নালা। সেই নালা দিয়ে যাচ্ছে মানুষের বর্জ্য। লেদা পার হয়ে নয়াপাড়া মুসুনি এলাকায়। মূল সড়ক ঘেঁষে সমতল জায়গাতেই হয়েছে রোহিঙ্গাদের ডেরা। এখানে সরকারি জমির বাইরে বেসরকারি মালিকানার জমিতেও বস্তি তৈরি হয়েছে। মুসুনি কালভার্টের পুবে ফসলের খেত। সেখানে সবুজ আছে আগোরি ২৩ নম্বর ধান। তিন মাসে ঘরে তোলা যায় ফসল। কালভার্টের নিচ দিয়ে এই ফসলের খেতে যাচ্ছে পয়োবর্জ্যরে পানি। হালিম মিয়া নামে এক দোকানি কালভার্টের পশ্চিম পাশে দোকান করেছেন। তিনি রাস্তার ওপাশ থেকে বলে উঠলেন, ‘ও ভাই আঁরার চইলপাত সব নষ্ট করি দিইয়্যে। বে¹ুন অ্যাঁর জমি। এহন রোহিঙ্গারা ঢুকিয়েরে সব দখল লইয়্যে।’

দশ গজ সামনেই ত্রাণকেন্দ্র। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলছে এসব ত্রাণকেন্দ্র। কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ত্রাণকেন্দ্রটি রাস্তার পুব দিকে। পশ্চিমের সমতল জায়গায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য রোহিঙ্গা ডেরা।

বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘরের কোণে বসে ছিলেন নুরুল আমিন। মংডুর মংনমায় তার বাড়ি ছিল। মুদিখানার ব্যবসা করতেন। এখানে বেকার। কাজ করতে চান? জবাবে বলেন, ‘কী করবো? এখানে কাজ নাই।’ তার পাশে এসে বাংলার দয়ের মতো বসলেন কবির আহমেদ। বললেন, তিনি বুচিদংয়ে থাকতেন। মাছ বিক্রি করতেন। মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নিলে যাবেন? জবাবে বললেন, ‘ক্যানে যাইয়্যু? মগেরা আঁরারে মারি ফেলাইবো। ধরোমরো করি নিলে, শক্ত করি নিলে যাইয়্যুম। আঁরারে শান্তি দিলে তই যাইয়্যুম।’

(ঢাকাটাইমস/ ২৫ অক্টোবর/ এইচএফ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :