উৎপলরা ফিরে আসুক

রাকিব খান
| আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১১ | প্রকাশিত : ২৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:০৯

এই নগরের পদ্ম (উৎপল) তিনি। শোভা ছড়াতেন অবিরাম। ছুটে চলতেন শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ডুব দিতেন ভার্চ্যুয়াল জগতে। ব্রাজিল ফুটবলের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। সুযোগ পেলেই তাই আর্জেন্টিনার সমালোচনায় তুখোড় হয়ে উঠতেন। ক্রিকেট নিয়েও কম যান না তিনি। মুশফিকরা খারাপ করলে কষ্ট পেতেন। ভাল করলে আহ্লাদে ফেটে পড়তেন। বন্ধু মহলে মিশুক হিসেবে আলাদা কদর আছে তার। মাঝেমধ্যেই গান গাইতেন। জগজিৎ সিংয়ের গান তাকে বেশ টানতো বোধহয়। তার স্মরণে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। কমবেশি সিনেমা দেখতেন। নানা উৎসব-পার্বনে হলে যেতেন। দুঃখবিলাসী কবি হেলাল হাফিজের কবিতা পছন্দ করতেন। চলমান নানা ইস্যু নিয়ে কমেন্ট করতেন। এসবের বাইরে আলাদা একটা পরিচয় ছিল তার। কলম সৈনিক তিনি। লেখা ছিল তার নেশা। এ জগতের অঘোষিত রাজা ছিলেন তিনি। একটা অনলাইন পোর্টালে শ্রম দিতেন। সমাজ-রাজনীতির ভাল-মন্দ সব রূপই বিমূর্ত হয়ে উঠতো তার হাত ধরে।

প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই তরুণের সাথে আমার কখনো দেখা বা কথা হয়নি। ফেসবুকেও তার সাথে যোগাযোগ নেই। তবে আমার বন্ধু মহলের অনেকের সাথে তার সম্পর্ক আছে। একদিন হঠাৎ মানুষটার উধাও হয়ে যাওয়ার খবর নজরে আসে। জানতে পারি নিরুপায় হয়ে পুলিশের দারস্থ হয়েছে তার পরিবার ও সহকর্মীরা। আলাদা জিডি করার পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও অনলাইন পোর্টাল সংবাদটি ছাপায়। শুরুতে মনে হয়েছিল কোথাও ডুব দিয়েছে সে। কিংবা অভিমান করে আড়ালে চলে গেছে। এসব ভেবে এই ইস্যুটি থেকে নিজেকে এক রকম দূরেই রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আজকালের মধ্যে সুরাহা হবে। কিন্তু কেউই তার খোঁজ দিতে পারছে না। দিন যত গড়াচ্ছে দুঃশ্চিন্তা ডালপালা ছড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সন্ধানের দাবি এখন ভাইরাল। আমি নানা কারণেই তার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি। এর মধ্যে প্রধান হলো মানুষটার সঙ্গে আমার পেশাগত মিল। অর্থাৎ আমাদের গোষ্ঠীর অভিন্নতা।

উৎপল দাস ৭-৮ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন। গেল ১০ অক্টোবর মতিঝিলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন তিনি। এর প্রায় দু'সপ্তাহ পর বিষয়টি সবার সামনে আসে। পেশাগত কারণে উৎপল চাপে ছিল কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সিনিয়র এক সাংবাদিকের ভাষ্য, সম্প্রতি উৎপলের কয়েকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস সাংঘর্ষিক ছিল৷ বন্ধুদের অনুরোধে যার কয়েকটি মুছেও ফেলেন তিনি। তার অন্তর্ধানের পেছনে এ বিষয়টির কতখানি প্রভাব আছে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় মশগুল অনেকে। আবার মুক্তিপণের দাবিতে তাকে অপহরণ করা হয়েছে কিনা তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে।

সম্প্রতি এই ভাবনা উসকে দেয় উৎপলের বন্ধ মোবাইল থেকে আসা ফোন। ৯-১০ মিনিটের আলাপচারিতায় তার বাবা চিত্ত দাসের কাছ থেকে লাখ টাকা দাবি করা হয়। সেসময় উৎপলের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে তেমন কিছুই বলেনি অপরপ্রান্ত। পুলিশ অবশ্য নিশ্চিত করেছে মুক্তিপণের কলটি উৎপলের ফোন থেকে আসেনি। এক্ষেত্রে স্পুফিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতে পারে। যার মাধ্যমে উৎপলের নাম্বার তার বাবার ফোনে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এ ঘটনার নেপথ্যের কুশলীরা প্রযুক্তি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। একটি জাতীয় দৈনিকের দাবি, কলটি বিশেষভাবে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করছে।

উৎপলের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার থানাহাটি এলাকায়। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সে৷ শৈশব-কৌশর থেকেই একটু চঞ্চল প্রকৃতির। নটেরডেম কলেজে পড়াশোনা। তার বাবা চিত্ত দাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক৷ এখন তিনি স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনের প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত আছেন। আর মা বিমলা রানী গৃহিনী। নিখোঁজ হওয়ার আগে মায়ের সাথে কথা হয় উৎপলের। রাতে আবারও ফোন দিতে চেয়েছিল সে। ছোট ছেলের সেদিনের কথাগুলি এখন ক্ষণে ক্ষণে সিক্ত করে তুলছে মায়ের চোখ। তাকে ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ জানানো ছাড়া এই মুহূর্তে কোন ভাষা নেই কারও। উৎপলের পরিবার এটা নিশ্চিত করেছে তাদের সাথে কারো কোন বিরোধ বা শত্রুতা নেই। তাই কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছে বা তুলে নিয়েছে এ বিষয়টি সন্দেহাতীত। তবে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খোঁজ না পেয়ে তার প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।

আশার কথা হলো উৎপলের উধাও হয়ে যাওয়ার খবর সরকারের উপরের মহলের নজরে এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার অন্তর্ধানের বিষয়ে আলোচনা করার আশ্বাসও মিলেছে। এ ঘটনায় দেরিতে হলেও সরব হয়ে উঠেছে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। তার সন্ধানের দাবি ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুলকে অকালে হারিয়েছি আমরা। বছরের শুরুর সেই শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি তার পরিবার ও সংবাদ কর্মীরা। এরমধ্যেই নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে উৎপলের নিখোঁজ হওয়ার খবর। কিন্তু আর একজন সংবাদ কর্মীকেও আমরা অকালে হারাতে চাই না। আমরা চাই উধাও বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান। উৎপল আমাদের মাঝে অক্ষত ফিরে আসুক। তার পদচারণায় আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক সংবাদ মাধ্যম। লেখার নেশায় বুদ হয়ে থাকুক বন্ধুবর উৎপল দাস।

লেখক: সাংবাদিক, যমুনা টেলিভিশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :