৯২ বছর বয়সে জিমন্যাস্ট!

তাজরিন জাহান তারিন, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১৬

চিন্তা করুনতো ৯২ বছর বয়সে জিমন্যাস্টিকসের পোলে লাফ ঝাপ দিয়ে বেড়াচ্ছেন এক নারী! অকল্পনীয় না? অথচ ঘটনাটা সত্যি। ৯২ বছর বয়সী জোয়ানা কোয়াস ১.৬ মিটার উচু দুটি সমান্তরাল দন্ডের উপর অনায়াসে জিমন্যাস্টিক্সের কলা-কৌশল দেখাচ্ছেন! পাঁচ সেকেন্ডের জন্য জোয়ানা কোয়াস কব্জির উপর ভর করে তার সম্পূর্ণ শরীরকে সমান্তরাল বারে সমান্তরাল ভাবে ধরে আছেন! তার বয়সী অন্য কেউতো দূরের কথা, এ বয়সের চার ভাগের একভাগ বয়সীদের জন্যও ভীষন রকমের কষ্টসাধ্য! অথচ সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে স্যান্ড বলরুমে উপস্থিত শত শত দর্শকের সামনে নিজের জিমন্যস্টিক্সের নৈপুন্য দেখান জোয়ানা। এমন একটা অনুপ্রেরণা দেবারমতন ঘটনা ইন্টারনেটে উঠে আসা মাত্রই ভাইরাল হয়ে যায়। জোয়ানার সাহস মুহুর্তেই সবার নজর কেড়ে নিয়েছে। উচ্ছ্বসিত মানুষের প্রশংসায় সারা দুনিয়ায় পৌছে গেছে জোয়ানা কোয়াসের নাম।

জার্মানির স্যাক্সনি শহরে জোয়ানা কোয়াসের জন্ম। তরুন বয়সে জিমন্যাস্টিক্সের সাথে জড়ান নিজেকে। স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি জিমন্যাস্টিকসের প্রেমে পড়ে যান। ক্লাসের ফাকে ফাকে সেখানে তাকে প্রায়ই জিমন্যাস্টিক্সের সমান্তরাল পোল বারে ওঠানামা করে স্ট্যান্ট করতে দেখা যেত। মাত্র ১০ বছর বয়সে জোয়ানা প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। জিমন্যাস্টিক্স নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন যখন জোয়ানা, ঠিক তখনই দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের ডামাডোলের সেই সময়ে প্রিয় জিমন্যাস্টিক্সের সাথে তার প্রেমের সম্পর্কে বিরতি এসে যায়। তখন সবাইকেই কোন না কোন ভাবে দেশের জন্য কাজ করতে তালিকাভুক্ত করা হয়। অন্যান্য কাজের সাথে জোয়ানা কোয়াস পরিবারের সাথে চাষাবাদে যুক্ত হয়ে পড়েন।

যুদ্ধ শেষ হয় ঠিকই, কিন্তু জোয়ানা কোয়াসের জিমন্যাস্টিকসে ফেরা হয়না চট করেই। কেননা পরাজিত জার্মানির যে অংশে তিনি থাকতেন, সেই পূর্ব জার্মানিতে জিমন্যাস্টিকস নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। দেশটিতে তখন একক খেলার চেয়ে দলীয় খেলার দিকে মনোনিবেশ করেছিল জার্মান সরকার। তাই জিমন্যাস্টিক্স ছেড়ে জোয়ানা কোয়াস হ্যান্ডবল খেলতে শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব জার্মান চ্যাম্পিয়নশিপের বিজয়ী হওয়া হ্যান্ডবল দলের সদস্যও ছিলেন জোয়ানা কোয়াস। কিন্তু এই সাফল্য তাকে ধরে রাখতে পারেনি হ্যান্ডবলে। জোয়ানার মন তখনও পড়ে ছিলো জিমন্যাস্টিক্সে।

একসময় পূর্ব জার্মানি উদার হতে শুরু করলো। জিমন্যাস্টিক্স সহ আরো বহু খেলার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলো। জোয়ানাও আবার শুরু করলেন জিমন্যাস্টিক্স। এদিকে আবার জোয়ানার যৌবন সমাগত। পরিবারের সবাই সংসার শুরু করার তাড়া দিচ্ছে। তিনি বিয়ে করলেন। স্বামী খুবই উদার মানুষ। জোয়ানার সাথী হয়ে সব সময় জিমন্যাস্টিক্সে উৎসাহ দেন। অলিম্পিকে অংশ নেয়ার একটা সুযোগও তৈরি হলো জোয়ানার। কিন্তু বাধ সাধলো একদিন সকালের অসুস্থতা। বমি হলো কয়েক দফা। জোয়ানা গেলেন ডাক্তারের কাছে। জানতে পারলেন তিনি মা হতে চলেছেন। তখন জোয়ানার সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিলো। গর্ভপাত ঘটিয়ে অলিম্পিকে যাওয়া, অথবা প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়া। জোয়ানা মা হবার সিদ্ধান্তই নিলেন। জিমন্যাস্ট হিসেবে অলিম্পিকে অংশ নেবার সুযোগ হাত ছাড়া গেলো তার।

আবার যখন সুযোগ এলো তখন তার পেটে দ্বিতীয় সন্তান। এবারও সন্তান জন্ম দিয়ে মা হবারই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। জিমন্যাস্টিক্সে অলিম্পিক সোনা জেতবার স্বপ্নটা রয়ে গেলো বুকের মধ্যেই।

এরপর বয়স বাড়তে থাকলো জোয়ানার। কোল জুড়ে এলো আরো এক সন্তান। তিন সন্তান আর সংসার সামলে জোয়ানার আর অলিম্পিকে সোনা জয়ী জিমন্যাস্ট হওয়া হলো না। কিন্তু জিমন্যাস্টিক্সের সাথে সম্পর্কটা একেবারে ছিন্ন করলেন না। তরুণ এথলেটদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলনে জোয়ানা।

১৯৮২ সালে তিনি যখন ৫৭ বছর বয়সে ছোট বেলার দুই বন্ধুর সাথে দেখা হলো। তারা স্কুলে তার জিমন্যাস্টিকসের সঙ্গী ছিলেন। সাহস করে এই তিন জন একসাথে হয়ে পেশাগতভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে জিমন্যাস্টিকসের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ শুরু করলেন। কিন্তু জোয়ানার এমনই দূর্ভাগ্য, তার বন্ধু দুজন একই বছর মারা গেলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে বছর তার দুই বন্ধু মারা গেলেন, সে বছর তিনি একটি আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা জিতলেন। এখন অবধি জার্মান চ্যাম্পিওনশিপের ১১ টি মেডেল নিজের গলায় ঝুলিয়েছেন জোয়ানা।

সম্প্রতি ‘৮ম ইন্টারন্যাশনাল এজিং এশিয়া ইনোভেশন’ ফোরামের একটি কনফারেন্সে কথা বলার জন্য আসেন জোয়ানা। সেখানে তিনি বর্তমান প্রযুক্তি এবং বৃদ্ধ বয়সে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উত্তম উপায় গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। বয়স যদিও ৯২, তারপরও সাহস করে চড়ে গেলেন জিমন্যাস্টিক্স বারে। এই বুড়ো হাড় নিয়েই ডিনার শো তে সমান্তরাল বার ছাড়াও তিনি ডিগবাজী, হেডস্ট্যান্ট এবং কার্টহুইলের মতন জটিল এবং কঠিন কসরৎ করে দেখান তিনি। আর যায় কোথায়! দর্শকরা সেই ভিডিও ইউটিউবে তুলে দেন। সাথে সাথে সারা দুনিয়ার মানুষের নজরে পড়ে যান ৯২ বছর বয়সী এই জিমন্যাস্ট।

জোয়ানা কোয়াস বলেন “যদি আপনি ফিট হন, তাহলে জীবনকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন”

তার একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার সবচেয়ে গর্বিত মুহূর্তটি ছিল যখন আমি ৮৪ বছর বয়সী ছিলাম এবং চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগিতায় আমার বয়সী কেউ ছিল না। তাই কর্তৃপক্ষ আমাকে ৭০-৭৫ বৎসর বয়সে অন্যদের সাথে রাখে এবং আমি তখনও এক পয়েন্ট ব্যবধানে জিতেছি।”

২০১৩ সালে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তিনি বিশ্বের সেরা বয়স্ক জিমন্যাস্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিকস হল অফ ফেমে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুই বছর আগে, তিনি ব্রিটেনের রানী ২য় এলিজাবেথকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটি প্লেন থেকে লাফ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, “জিমন্যাস্টিকসের চেয়ে প্লেন থেকে লাফ দেয়া সহজ। কারণ এর জন্য আপনাকে জিমন্যাস্টিকসের মতো আলাদা কিছু করতে হবে না”।

খেলাধুলাপ্রিয়, সাদা চুলের এই বৃদ্ধা এখনো প্রায় প্রতিদিন এক ঘন্টা করে হলেও প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়াও হাইকিং, সাঁতার এবং নৃত্যতেও তার যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আগামী মাসে, তিনি আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিকস উৎসবের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে বার্লিনে যাবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন সাধারনত একজন জিমন্যাস্ট কয়েক দশক ধরে এই খেলাধুলা চালিয়ে যেতে পারেন না। কারণ বয়সের সাথে সাথে মানুষের লিগামেন্টগুলো শক্ত হয়ে যায়। এই ধরণের খেলাধুলার সাথে যুক্ত থাকতে হলে শক্তি শঞ্চয়ের জন্য শরীরের গ্রন্থিগুলোকে নমনীয় হতে হয় যার অনমনীয়তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু মিসেস কোয়াসকে এইধরণের ভীতিমুলক কথা বললে তিনি উতসাহ নিয়ে এর বিপরীত পক্ষে যুক্তি দেন। তিনি বলেন, “আমি অচল হয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়েই এখনো জিমন্যাস্টিকসের সাথে যুক্ত আছি। আমার মনে হয় এটি একটি ভালো প্রতিরোধমূলক হাতিয়ার। এই সময়ে আমি একবারই অসুস্থ হয়েছিলাম। আর সেটা হলে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত অবস্থায় এয়ার কন্ডিশনের অতিরিক্ত ঠান্ডায় আমার একবার ঠান্ডা লেগেছিল।”এই বয়সেও তিনি কোন সাপ্লিমেন্ট নিউট্রিশন গ্রহণ করেন না। এর পরিবর্তে তিনি দৈনিক ৬ ঘণ্টা ঘুমান এবং প্রচুর ফল ও সবজি খান।

সিঙ্গাপুরে তার স্বল্পসময়ে তিনি হৌগং এ অবস্থিত দুটি বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানকার বৃদ্ধদেরকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। প্রতিনিয়ত ব্যয়াম করার উপদেশ দেন। কারণ জীবনে যতক্ষন গতি থাকে, ততক্ষনই জীবন থাকে।

অবসরের প্রশ্ন করতেই তিনি জানান, “আমার চেহারা বৃদ্ধ হয়েছে, কিন্তু মন এখনো তরুণ। সম্ভবত সেদিনই আমি জিমন্যাস্টিকস থেকে অবসর নেব, যেদিন আমি মারা যাব।”

ঢাকাটাইমস/২৭ অক্টোবর/টিজেটি/কেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :