নাগরিকের চোখে আন্তঃক্যাডার প্রশাসনিক বাস্তবতা

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ৩০ অক্টোবর ২০১৭, ২২:২৪

বাংলাদেশের জনপরিসরে এক গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় আলোচনা-সমালোচনার টপিক হলো আমলাতন্ত্র। প্রায় ২০০ বছরের শোষণকালে আমাদের ব্রিটিশ ‘প্রভুরা’ এ অঞ্চলের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও মানুষের মনোজগতে এক প্রশাসন-বৃক্ষ রোপণ করে যেতে পেরেছে, যার ডালপালা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। জাতি ও রাষ্ট্রগঠনে একটি জনমুখী আমলাতন্ত্র অত্যাবশ্যক হলেও উন্নয়নের পথে অন্যতম বড় বাধা হিসেবেও অনেকে ‘আমলাতান্ত্রিক’ দৌরাত্মকে দায়ী করে থাকেন। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রবাহে আমলা ও আমলাতন্ত্র, উভয় সত্তাই জনগণের আদালতে, কখনো কখনো আইনের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে।

আবার আইনের আদালতের কর্তাব্যক্তিদের সাথেও আমরা দেখছি আমলাদের বিশেষ বিপরীতার্থক সম্পর্কের অবতারনা ঘটছে। বিচার ও নির্বাহী বিভাগের এক অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বৈরথ দেশের মানুষ ক্ষণে ক্ষণে লক্ষ্য করে বিস্মিত ও আতঙ্কিত হয়েছে। অথচ মানুষ আশা করে জনগণের কর ও খাজনার টাকায় যাদের বেতন-গাড়ি ও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়, তারা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে?

সরকারি কর্ম কমিশনের ‘নিশ্ছিদ্র’ রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ার কঠিন সব ধাপ পার হয়ে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে এদেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েদের একাংশ নানা সরকারি দপ্তরে যোগদান করে। নানা পর্যায়ে বিসিএস অফিসার, নন-ক্যাডার ‘কর্মকর্তা’ এবং নানা ক্লাসের ‘কর্মচারী’র বহর নিয়ে কাজ করে দেশের আমলাতন্ত্র। আইডিয়েল অর্থে যদিও শীর্ষতম পদে সমাসীন কর্তা বা কর্ত্রীও নিজেকে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ বলে পরিচয় দিতে ‘ভালোবাসেন’। কিন্তু অবকাঠামো, আর্থিক ও দাপ্তরিকভাবে বৈধ নানা সুবিধার বহর দেখে কখনো কখনো ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ কথাটা একটা নিছক শখ করে বলা উপমা বলে ভ্রম হয়।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সাবেক সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস অব পাকিস্তান থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা উপনিবেশিক শাসনামলের ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী নিয়ন্ত্রিত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের উত্তরসূরি ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে সিভিল সার্ভিস অধ্যাদেশের দ্বারা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস হিসেবে পরিচিতি হয়। এর মূলনীতি ও পরিচালনা পরিষদ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত হয়। প্রফেশনাল ও সাধারণ ক্যাডার মিলিয়ে মোট সংখ্যা হলো ২৮টি।

বাংলাদেশ ইতিহাসের উত্তরাধিকার হিসেবে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের এই বাস্তবতা অংশটি প্রাপ্ত হয়েছে। ভারত বর্ষের স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পদ্ধতিগতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়াসে ব্রিটিশরা ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এর জন্ম দেয়। আইসিএসের উচ্চপদস্থ বেশিরভাগ কর্মকর্তাই ব্রিটিশ ছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসকদের সাথে তুলনামূলক সুসম্পর্ক থাকায় হিন্দু ইংরেজি শিক্ষিত লোকজনও ব্রিটিশ সিভিল প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

ব্রিটিশ শাসকদের কূটকৌশলে, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধনিক শ্রেণির ধর্ম-ভিত্তিক মেকী জাতীয়তাবাদের স্লোগানে অসাম্প্রদায়িক শক্তির অসহায় বাস্তবতায় উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গেলে ‘আইসিএস’ এবং ‘পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপেরিয়র সার্ভিসেস' নাম নিয়ে সিভিল প্রশাসন দুটি পৃথক রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ হয়। তদুপরি পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাব প্রদেশের রাজনীতিবিদ ও ধনিক শ্রেণির আধিপত্যবাদী আচরণে সিভিল সার্ভিস পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য এক প্রহসনে পরিণত হয়। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরাবরই পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। মূলত বাঙালি জাতির লড়াই ছিল পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের দৌরাত্মের বিরুদ্ধেই যার চূড়ান্ত রূপ ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের সেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশাল বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি সম্ভব ছিল না, যেমন ছিল না পূর্ববর্তী ব্রিটিশ আমলে। তাইতো স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের মহান প্রক্রিয়ায় গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু, অতঃপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কিন্তু যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে জাতির পিতা রাষ্ট্র স্বাধীন করেছিলেন তার কতটুকু আমরা নতুন প্রজন্ম পূরণ করতে পারছি? স্বাধীন দেশে আমরাই পুলিশ, আমরাই ম্যাজিস্ট্রেট, আমরাই ডাক্তার, আমরাই জজ-ব্যারিস্টার। একই বাংলামায়ের গর্ভে জন্ম নিয়ে, একই আলো-বাতাসে বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের মত বিদ্যাপীঠে ‘শিক্ষা’ নিয়ে বড় কর্তা-কর্ত্রী হয়ে, ‘সুনিশ্চিত’ জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা পেয়েও কেন নানা ক্ষেত্রের প্রশাসকরা একটা সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছেন না?

কলেজের শিক্ষক কেন ম্যাজিস্ট্রেটের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিজের চাকরি বাঁচাবেন? ইউএনও কেন শিশুদের দিয়ে জাতির পিতার স্কেচ আঁকাতে গিয়ে রাজনীতিবিদ ও সিনিয়র আমলার সম্মিলিত রোষানলে পড়ে চোখে সর্ষেফুল দেখবে? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কেন রোগীর স্বজনকে পিটিয়ে খেদানোর অভিযোগ উঠবে? একই বিসিএসে জয়েন করে ডাক্তার ও শিক্ষকদের কেন পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা ফরেন ক্যাডারদের মতো নিয়মিত পদোন্নতি হবে না? একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে পোস্টিং দিয়ে ডাক্তারদের কেন মিনিমাম সুবিধাও দেবে না রাষ্ট্র? রোগীর আত্মীয় স্বজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা কেন ডাক্তারদের পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়ার সুযোগ পাবে?

সমস্যা কোথায়? সমস্যা কি তাহলে সিস্টেম নিজেই? যদি সিস্টেমে গলদ থাকে, তাহলে সেখানে পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একই বিসিএসে জয়েন করে জাতির মেধাবী সন্তান সরকারি ডাক্তারদের পদোন্নতি হয় না। অথচ পুলিশ, প্রশাসন কিংবা ফরেন ক্যাডারের অফিসারদের পদোন্নতি হয় নিয়মিত। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের ডাক্তারদের একেবারে গ্রাম পর্যায়ে পোস্টিং হয়। ডাক্তাররাই একমাত্র প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যারা মানুষকে সরাসরি সেবা দিচ্ছেন। জনগণ ও ডাক্তারের মাঝামাঝি কর্মচারীর বহর থাকে না। ডাক্তার হিসেবে এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মানুষকে সরাসরি সেবা দেন। কিন্তু গ্রামে কী অবস্থা ও অবস্থানে ডাক্তাররা কাজ করেন, তা একটু নিজ চোখে দেখে আসার জন্য প্রতাপশালী কর্মকর্তাদের দেখে আসার অনুরোধ রাখলাম।

একজন জেলা প্রশাসককে রাষ্ট্র ও সমাজ যে সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দেয়, একজন সিভিল সার্জন কিংবা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কিংব জেলা কৃষি কর্মকর্তাকে কি একইরকম সম্মান কিংবা সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়? অথচ বাংলাদেশের চলমান অগ্রযাত্রায় এই কৃষি ও মৎস্য কর্মকর্তাদের অবদান অসাধারণ। ১৯৭১ এ দেশের লোকসংখ্যা ছিল সাত কোটি, আর এখন ১৬ কোটির উপর, তদুপরি কমেছে কৃষি জমি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মুখে খাবার তুলে দিতে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন এদেশের কৃষি ও মৎস্য কর্মকর্তারা। যে সেবা এরা রাষ্ট্রকে দেন, তার তুলনায় রাষ্ট্র কি উনাদের প্রতি যথাযথ যত্ন নিচ্ছে? এভাবে বিসিএসের ২৮টি ক্যাডারের সবার ভিন্ন ভিন্ন কর্মক্ষেত্র ও স্ব স্ব অবদান রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি ক্যাডার কি তার মত করে কাজ করতে পারছে? সবাইকি সমান মর্যাদা ভোগ করছে?

যাইহোক, আন্তঃক্যাডার সার্ভিসের তুলনামূলক বিতর্কে না যাওয়াই সমীচীন। এতে করে বিশেষ কোনো ক্যাডারের মর্যাদাহানী হতে পারে। লেখার উদ্দেশ্য মোটেও তা নয়। এদেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েদের একাংশ কঠিন সব ধাপ পেরিয়ে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে আসেন। এদের সবাই শুধু দেশমাতৃকার সেবার উদ্দেশ্য থেকে এই বিসিএস অফিসার হওন, এ কথা বললে আবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। মূলত সরকারি ও সামাজিক মর্যাদা, নিশ্চিত জীবন ও চাকরি জীবন শেষে মোটা অংকের নিশ্চিত নগদের আকর্ষণে সাবধানী ছেলে-মেয়েদের অনেকে নিজের ইচ্ছায় কিংবা বড়দের চাপে ক্যাডার সার্ভিসে আসেন। কিন্তু রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্যাডারেই সবাই যেতে চায়। রাষ্ট্রের উচিত ছিল, সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য যৌক্তিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা। প্রতিটি ক্যাডার সার্ভিস স্ব স্ব ক্ষেত্রের অফিসারদের দ্বারা কাজ করে দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য কাজ করবে, এমনটা প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক।

সব ক্যাডার সার্ভিসেরই নিজস্ব কর্মক্ষেত্র রয়েছে। সবাই পরিশ্রম করেন, মেধা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে সেবা দেন। ডাক্তার যেমন জাতির স্বাস্থ্য ঠিক রাখেন, পুলিশ তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বিধান করেন, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তেমনি আইনি বিধি-বিধান প্রয়োগ করে সামাজিক ও প্রশাসনিক স্থিতি বজায় রাখেন। কে কার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কে কার চেয়ে বড়-ছোট সে বিতর্কে না গিয়ে বরং রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কাছে দাবি জানাই, সকল ক্যাডারের জন্য স্বকীয়তা বজায় রেখে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করুন। শুধু নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা, অন্য ক্যাডারদের সুযোগ-সুবিধার দিকে ফিরেও না তাকানোর প্রশাসনিক অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণে তাই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনা করবে সরকার। তাই সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যদি শতভাগ ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলেই কেবল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। সরকারের বিভাগগুলো ইতিবাচকভাবে কার্যকর থাকলেই কেবল বাদবাকি জনগণ সঠিক কর্ম-পরিবেশ পাবে।

লেখক: শিক্ষক সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :