মুকুন্দরামের ফুল্লরা ও আমাদের গ্রাম-নগরের শীত

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:৫২ | প্রকাশিত : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:৩০

ঢাকা কিংবা সারাদেশে যারা অসহ্য ও নোংরা গরমে হাঁসফাঁস করছিলেন, তাদের মনে এখন নতুন ভালোলাগা। খুব কম জোরে ফ্যান ছেড়ে রাখলেও রাতের শুরুতেই একটা ‘এসি এসি’ আবহ তৈরি হচ্ছে ঘরে। যাদের ঘরে ফ্যানও নেই, তারা জানালা খুলে রাখছেন, বাহির থেকে আরামের ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঘুমের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। রাত করে বাসায় ফিরে কর্মজীবী বাবা-মায়েরা অন্যান্যদের শীতের বার্তা দিচ্ছেন। ঢাকার পাবলিক বাসের ভিড় কমে একটু পাতলা হলেই ভাঙা জানালা গলে আরামের বাতাস গায়ে লাগছে। শীত এসে গেছে, তবে এখনো কুয়াশারা এসে ঢাকায় পৌঁছায়নি। যাদের ঘর আছে, তারা শীত নিয়ে নানা ভালোলাগায় আচ্ছন্ন থাকলেও, ঘরহীনদের আবার নতুন সংকট। ফুটপাতে, রিকশায়, পাইপের ভেতর, গাছের নীচের শহরবাসীদের কাছে শীত কোনোভাবেই স্থায়ী ভালোলাগার বিষয় হয়ে আসে না। সাধারণ কাপড়-চোপড় পড়ার সামর্থ্য যাদের নাই, গরম আরামের কাপড় এরা পাবে কই?

সেই কবে মধ্যযুগে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী গ্রামীণ নারী ফুল্লরার মুখ দিয়ে শীতের কষ্ট বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘কার্ত্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ। যগজনে করে শীত- নিবারণ বাস নিযুক্ত করিল বিধি সভার কাপড়। অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড়। শুন দুঃখের কাহিনী শুন দুঃখের কাহিনী। পুরান দোপাটা গায়ে দিতে করে পানি...উড়িতে সকল অঙ্গে বরিষয়ে ধূলা। মাঘে কুজ্ঝটিকা প্রভু মৃগয়াতে জায়। আন্ধারে লুকায় মৃগ দেখিতে না পায়)।

মুকুন্দরাম বলেছেন, ‘অভাগী ফুল্লরা পড়ে হরিণের ছড়’! ঢাকার কফি শপে বসে থেকে ফুল্লরাদের শীত বোঝা সহজ নয়। তবে হয়তো কফি শপ থেকে বের হলেই ফুটপাতের দেয়াল ঘেঁষে শহুরে ফুল্লরাদের দেখতে পাওয়া যায়। আমরা যেমন শীত আসলে শুধু নতুন কাপড়ই কিনি না, ম্যাচিং করে মাফলার-চাদর কিনি, এই শহুরে ফুল্লরাদের কাছে এমন কিছু চিন্তা করা দুঃসাহসের চেয়েও যেন বেশি কিছু। আমাদের মত কিছু মানুষ আবার আশ্চর্যজনক মানবিক। এদেরই কিনে দেয়া নতুন কাপড় কিংবা একাধিক গরম থেকে দিয়ে দেয়া কোনো একটা পরিধান করে অথবা শীতের সাথে যুদ্ধ করে কিংবা জীবন দিয়ে আত্মসমর্পণ করে শহর বা গ্রামে এ যুগের ফুল্লরাদের জীবন কাটে।

গরিবের কষ্টে আমাদের বাংলাদেশের মাঝারি মানের শীতে উপভোগ কমে না। শীত আসলে অবস্থাসম্পন্নদের নানা রোমান্টিসিজম সৃষ্টি হয়। শীত বাড়ে, উপভোগও মাত্রা ছাড়ায়। শীত মানুষকে শুধু কষ্ট বা রোমান্টিসিজমই উপহার দেয়, এ কথা বললে আবার ভুল হবে। শীত বাংলাদেশে অনেক গ্রামীণ এবং শহুরে ফুল্লরাকে কাজের সংস্থান দেয়। এখনতো মানুষ গ্রামেও পিঠা বানায় না। আকাশসীমা দিয়ে স্টার জলসা ঢুকে দেশের মা-ভাবীদের পিঠা বানানোর সামর্থ্যও কেড়ে নিয়েছে। আগে মা-ভাবী-চাচীরা রাত জেগে পিঠা বানাতেন। হরেক রকম পিঠা। পিঠা-সংস্কৃতির স্মৃতি বেশি দিনের পুরনো নয়। কিন্তু অনেক দিন না খেয়ে এখন আমাদের সে পিঠাসমগ্রের নামও মনে আসে না।

গ্রামে হোক, শহরে হোক, শীতের পিঠা খেতে গেলে এখন আলোক সজ্জিত পিঠাঘর কিংবা নিয়ন বাতির চুরি করা আলোয় আবছা অস্তিত্বের ফুটপাতের খালার দোকানই ভরসা। তাও আবার দুইরকম পিঠাই বেশি সহজলভ্য- চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা। ভাপা পিঠায় মিশে থাকে আবার হিসেবী দোকানীর ব্যবসায়ী চালাকি। গুঁড় দেয়, তো দেয় না, নারকেল দেয়, তো দেয় না। এর চেয়ে বরং চিতই পিঠাই বেশি লাভজনক ক্রেতার জন্য। শুঁটকীর ভর্তা, সরিষা বাটা দিয়ে গরম গরম চিতই পিঠা খেলে কখনো ক্রেতা হিসেবে ঠকেছেন বলে অনুভূতি আসবে না। ফুটপাতে পিঠা খাওয়ার নিশ্চয় দারুন সব অনুভূতি আছে। না হলে কোটি টাকার গাড়ী হাঁকিয়ে বেড়ানো লোকজনও গাড়ী দাঁড় করিয়ে পিঠা খেতে ব্যস্ত হয়ে যান।

এবার প্রায় একই সাথে ঢাকা ও গ্রামের মানুষ শীতের আগমন টের পেয়েছে। অথচ কদিন আগেই গরমে গ্রাম-শহর একাকার হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার নানা পার্কে কিংবা একটু রাতের বেলায় খোলা রিকশায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলোতে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। আর গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে শীতের অস্তিত্ব একটু প্রকটভাবেই অনুভূত হয়ে থাকে। বেপরোয়া নগরায়নের দানবীয় বিকাশেও আবহমান বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চরিত্র এখনো অনেকাংশে জীবন নিয়ে বেঁচে আছে। খেজুরের রসের পিঠা, খেজুর গাছ থেকে রস নিয়ে খাওয়ার রসালো ও আরামদায়ক সংস্কৃতি এখনো পরিলক্ষিত হয়। গ্রাম-কেন্দ্রিক বাংলাদেশের প্রভাব আমাদের শহুরে জীবনেও প্রভাব রেখে চলেছে অদ্যাবধি। আমার আপনার জীবনে হয়ত ঘটে না, কিন্তু কোনো না কোনো মা হয়ত হল-হোস্টেলে বা মেসে থাকা ছেলে-মেয়ের জন্য খেজুরের রসের পিঠা, তালের পিঠা, তেলের পিঠা বানিয়ে ঢাকাগামী বাসে, লঞ্চে তুলে দিচ্ছে। সে পিঠা খেয়ে তৃপ্তি নিয়ে, ভালোবাসার চোখের জলে ভিজে সন্তান হয়ত অনাগত ভবিষ্যৎ পানে বেরিয়ে পড়ছে এই ইট-কাঠের জঙ্গলে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :