ডুব, বিনোদিনী এবং...

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ২০:৫৩ | প্রকাশিত : ৩১ অক্টোবর ২০১৭, ২০:২২

সবাই যখন ‘ডুবে’ আছেন, আমি তখন ভেসে থাকার চেষ্টা করলাম। বলাকা সিনেওয়ার্ল্ডে ‘ডুব’ সিনেমার টিকিট কিনে বুক পকেটে রাখলাম। শো শুরু হতে তখনও অনেক বাকি। হলের সামনে থেকে দশ টাকার ছোলা বুট ভাজা কিনে খেতে খেতে এলাম শিল্পকলা একাডেমিতে। কারণ কী? নিজেও বুঝতে পারলাম না। এ ধরনের পাগলামি আমি প্রায়ই করি। অনেক আগ্রহ নিয়ে কিছু শুরু করেছি, কিছুক্ষণ পর মনে হলো ভালো লাগছে না, থেমে যাই। রবিবার সন্ধ্যার ঘটনাটি প্রায় এরকমই। আমার এই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে আমি মোটেও বিচলিত হই না। এটা আমার স্বভাবে নেই।

দশ টাকায় এতটা ছোলা বুট ভাজা পাওয়া যায় জানা ছিল না। নীলক্ষেত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে দোয়েল চত্বর দিয়ে শিল্পকলার সামনে পৌঁছা পর্যন্ত প্যাকেটটি খালি হয়নি। সন্ধ্যায় মঞ্চের খোঁজ নিলাম। জানা গেল, একই সময়ে দুটো নাটক মঞ্চে উঠবে। একটি ‘চিত্রাঙ্গদা’। অন্যটি মঞ্চকুসুম শিমূল ইউসূফের একক অভিনীত ‘বিনোদিনী।’ শিল্পকলার পরীক্ষণ থিয়েটারে দ্বিতীয় পরীক্ষায় বসলাম ‘বিনোদিনী’কে সামনে নিয়ে। পরীক্ষা বলার কারণ আছে। মঞ্চ নাটকে সবসময় ধৈর্য রাখতে পারি না। কিছুক্ষণ পর উঠে যাই, যাই শুরু হয়। তারপর মঞ্চের আলোটা ম্রিয়মান হয়ে এলে দরজা খুঁজি। সে অর্থে ‘বিনোদিনী’ ছিল আমার দ্বিতীয় পরীক্ষা। পরীক্ষণ হলে প্রথম পরীক্ষাটাও খুব বেশি দিন আগে দিইনি। সফলতার সঙ্গে পুরোটা সময় বসে ‘রিজওয়ান’ শেষ করেছিলাম। রবিবার ‘বিনোদিনী’ দেখার পর মনে হয়েছে, আরও দুবার পুরো শোটা এক বসায় দেখতে পারবো।

অনেকের মুখে ‘বিনোদিনী’র কথা শুনেছি। নাটকটির কথা বলতে গিয়ে অসীম ভালোলাগা ছড়িয়ে ছিল তাদের চোখেমুখে। কাল নাটকটি দেখার পর মনে হয়েছে, দর্শকরা এ যাবৎ যা বলেছেন—‘বিনোদিনী’ এসব ছাড়িয়ে বহু আগেই উঁচুতে জায়গা করে নিয়েছে। যেখানটায় ছুঁতে হলে আরও কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। অনন্য উচ্চতায় শিমুল ইউসুফ। এক বছরের বেশি সময় অসুস্থ ছিলেন। মঞ্চে উঠতে পারেনি। বিশ্রামে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু কদিন আর? মঞ্চে যার প্রাণ তিনি কি পারেন দূরে থাকতে? ১২৪ তম প্রদর্শনী নিয়ে রবিবার উঠেছিলেন সাজানো-গোছানো মঞ্চে।

তারপর শুধুই মুগ্ধতা। রেললাইনের মতো সমান্তরাল পথে সময়টা এগিয়ে গেল। কোনো শব্দ না করে। নিভে যাওয়া আলো জ¦লে ওঠার আগ পর্যন্ত আমি যেন মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে বসে ছিলাম ‘বিনোদিনী’র পাশে। প্রথম যিনি মঞ্চে উঠেছিলেন ১৮৭৪ সালে। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার দিয়ে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ‘শত্রুসংহার’ নাটকে দ্রৌপদীর সখী ছিলেন তিনি। তারপর গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ন্যাশনাল এবং শেষে স্টার থিয়েটার। ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত ১২ বছরের মঞ্চজীবন। ৮০টির মতো নাটকে ৯০টির বেশি ভূমিকায় কাজ করেছেন তিনি। বাংলার মঞ্চ নাটকের প্রথম সফল শিল্পী বলা হয় তাঁকে।

অসীম প্রতিভার মানুষটিকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন আমাদের মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফ। পুরো ৮৫ মিনিটের প্রদর্শনীর কোথাও মনে হয়নি, তিনি আমাদের সেই চেনা শিমুল ইউসুফ। মনে হচ্ছিল, কালের গঙ্গা-যমুনা সাঁতরে উঠে এসেছেন শ্রীমতি বিনোদিনী দাসী। যিনি জীবনের মুহূর্তগুলোকে শব্দের তুলিতে আঁকতে বসলেন একটু আগে। তারপর একটার পর একটা ঘটনা বলে গেছেন, থিয়েটার হলের আমন্ত্রিতদের। শিমুল ইউসুফের অভিনয় শুরুর আগে মঞ্চে এসেছিলেন নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বললেন, বিনোদিনীকে দর্শকের সামনে তুলে ধরলেন গোছানো কথায়। অকৃত্রিম ভালোবাসা কাজ করছিল তার মধ্যে, সময়ের ব্যবধানে আড়ালে চলে যাওয়া মানুষটির জন্য। সহজেই বোঝা যাচ্ছিল।

চাদর জড়িয়ে অভিনয় মঞ্চে এলেন শিমুল ইউসুফ। তারপর নিজেকে নানাভাবে মেলে ধরেছেন দর্শকের সামনে। পুরো থিয়েটারে তখন পিনপতন নীরবতা। শেষ পর্যন্ত তা-ই ছিল। শুরুতেই হৃদয় ভাঙা আর্তনাদ ‘ভালোবাসায় ভাগ্য ফেরে না গো, ভালোবাসায় ভাগ্য ফেরে না।’

একজন মানুষ আর কত তার রূপ! মুহূর্তে নিজেকে বদলে ফেলছিলেন সংলাপের প্রয়োজনে। চরিত্রের প্রয়োজনে। এতটা নিখুঁত কাজ দেখা হয়নি কতদিন। আবার কবে দেখা হবে তাও ঠিক নেই। আমি এখন সহসাই বলতে পারি, একক অভিনয়ের আকাশে শিমুল ইউসুফ এক ধ্রুব তারা হয়ে আছেন। নাবিকের দিক ঠিক করতে এই তারার পথ ধরেই এগোতে হবে।

বিনোদিনী দাসী খুব ভালো কবিতা লিখতেন। নাসির উদ্দিন ইউসুফ শুরুতে বলছিলেন সে কথা। ‘আমি এই নাটকটি নিয়ে যখন কাজ করছি তখন কলকাতার শান্তি নিকেতনসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছে। একটা অজানা বিষয় জানা হয়েছিল তখন। বিনোদিনী দাসী ভালো কবিতা লিখতেন। তার ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’ ও ‘আমার কথা’ আত্মজীবনীর পরতে পরতে কবিতার বুনন দিয়েছে নকশির মতো। সেই কবিতাগুলো নাটকে গান হয়ে দর্শকের সামনে আনা হয়েছে। বিনোদিনী দাসী যে ভালো কবিতা লিখতেন এ দর্শকশ্রোতাকে স্বীকার করতে হবে। পাশাপাশি প্রশংসা পাবে শিমুল ইউসুফের বহুমুখী প্রতিভা। একজন মঞ্চাভিনেতাকে কতটা যোগ্য হতে হয়, আমাদের মঞ্চকুসুম সেই প্রমাণ রেখেছেন পায়ে পায়ে। সংলাপে সংলাপে।

দৃশ্যায়ন আর সংলাপের প্রয়োজনে গাওয়া হচ্ছিল গানগুলো। মঞ্চের ঠিক পেছনের আলো-ছায়ায় বসে থাকা বাদ্যযন্ত্রগুলো তাল তুলছিল কণ্ঠের তালে তালে। কী অসাধারণ বর্ণনা! কী অসাধারণ গলা। ‘যেভাবে হোক দিন কেটে যায়।’ কী অসাধারণ দর্শন!

বিনোদিনী দাসীর জীবন ঘটনাবহুল যাত্রা। বাঁকে বাঁকে কত সব মানুষের আনাগোনা। ভালো লাগা, মন্দ লাগা। একজন মঞ্চাভিনেতার জীবন বোধ ফুঁটে উঠেছে সাবলীল বর্ণনা তরঙ্গে। মঞ্চের বাইরের জীবন কতটা বন্দুর, কতটা স্বার্থের প্রলেপের মোড়ানো তাও বোঝা যায় বিনোদিনীর জীবন থেকে। প্রেম, ভালোবাসা, ক্রোধ, ঘৃণা কী নেই সে জীবনে? মন ভাঙার আর্তনাদ, অতৃপ্ত ভালোবাসা, সবই ছিল। ‘তোমার মাঝেতে থেকে/তোমারে হারাই/ বলি বলি করি তবু/ বলিতে না পাই/ প্রাণ ভরে গায়ে মেখে/ আরও যেনো চাই...।’

আজ থেকে প্রায় একশ কুড়ি পঁচিশ বছর আগে একজন রক্ষিতা কতটা লোভের ঊর্ধ্বে পাড়ে সেই উদাহরণ রেখে গেছেন বিনোদিনী। থিয়েটার ছেড়ে দিতে অর্থের লোভ দেখানো হয়েছিল তাকে। কিন্তু এতটুকু টলাতে পারেনি শিল্পের সাধনা থেকে। তাঁর আত্মবয়ান ‘আমি থিয়েটার ভালবাসিতাম, সেই নিমিত্তে ঘৃণিতা বারনারী হইয়াও অর্দ্ধ লক্ষ টাকার প্রলোভন তখনই ত্যাগ করিয়াছিলাম।’

মঞ্চের সফলতার পেছনেও না পাওয়ার অনেক অতৃপ্তি ছিল বিনোদিনীর জীবনে। বঞ্চিত হয়েছে পদে পদে। সমাজের স্বার্থপর মানুষের কারণে আঘাত পেয়েছেন। তবু ভেঙে পড়েননি। অসুস্থতার কারণে মঞ্চ থেকে ছুটি গিয়েছিলেন মাস খানেকের জন্য। ফিরে এসে মাইনা (বেতন) পাননি। ক্ষোভে ফিরে এসেছিলেন মঞ্চ থেকে। পরে সবার ভালোর কথা চিন্তা করে ফিরেছেন। কিন্তু বিনিময়ে যে প্রতিদান তিনি পেয়েছেন তা দারুণভাবে ব্যথিত করেছে তাকে। আর না, অভিনয়ের খাতায় দাড়ি টেনে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন। পারেননি। বন্ধুবর, সহকর্মী আর মঞ্চের মায়ায় আবার ফিরেছেন। এবার নিজেই হাতে নিলেন মঞ্চ গড়ার কাজ। মঞ্চের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন। জমি নিলেন। বলা হল, বিনোদিনীর এই প্রতিদান বিফলে যাবে না। মঞ্চের নামে থাকবে তার চিহ্ন। বিনোদিনীর নামে হবে নতুন থিয়েটার। থিয়েটার হয়েছিল। তবে বিনোদিনীর নামে নয়, নাম রাখা হল ‘স্টার থিয়েটার’। তিনি বুঝলেন সবাই তাকে ব্যবহার করে আখের গুছিয়ে নিয়েছে। শেষে থিয়েটারের মালিকানায় বিনোদিনীকে রাখার আলোচনা হলো। কিন্তু নারী বলে সেই প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হলেন। ক্ষোভে-দুঃখে একসময় মঞ্চয়ের মায়া কাটালেন বিনোদিনী। তারপর তাকে নিদারুণ যন্ত্রণায় দিন কাটাতে হয়েছে। সে আরেক অতৃপ্ত অধ্যায়।

বিনোদিনীর একটি মেয়ে ছিল। শকুন্তলা। মেয়েটি বাল্যবয়সেই পৃথিবীর মায়া কাটায়। একজন মায়ের জন্য তা কতটা বেদনার, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজের মতো মেয়েটিরও বাবার পরিচয় বলে যেতে পারেননি তিনি। মেয়েটিকে হারিয়ে লিখলেন।’

‘জননী আমার/ সংসারে সুখ যতো/ তোমাতে আছিল ততো/ তুমি ফেলে চলে গেছে/ অমরও ভুবনে/ তব স্মৃতি লয়ে আছি সংসার কাননে।’

ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এতটুকু আশ্রয় খুঁজেছিলেন তিনি। পেয়েও ছিলেন। কিন্তু সুখ বেশিদিন সয়নি কপালে। আশ্রয়দাতা সেই দেবতাতুল্য মানুষকে হারিয়ে লিখেছেন—

‘হে অনাবিল আশ্রয় তরু/ স্বর্গের দেবতা তুমি/ দেবতা হও আর মানুষই হও/ মুখে যা বলা যায় কার্যে করা বড়ই দুস্কর।’তারপর সেই হৃদয় ভাঙার গান। যে গানে চূর্ণ হয়ে আছে একজন আশ্রয়হীন মানুষের করুণ কান্না। ‘ভালোবাসায় ভাগ্য ফেরে না গো, ভালোবাসায় ভাগ্য ফেরে না। ওই দেখো আমার চিতাভষ্মগুলো দূরে দূরে চলিয়া যাইতেছে। ওগো! আমার শেষও নাই, আরাম্ভও নাই গো!... এই আমার পরিচয়।’

ভেজা চোখে মঞ্চের আলো তখন কুয়াশার মতো লাগছিল। ধীরে ধীরে ধূসর অনুভূতির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিলেন বিনোদিনী। খুব করে মন চাইছিল, এখানেই যেন শেষ না হয়। এভাবে যেন শেষ না হয়। কিন্তু নিয়তির কাছে যে সবাই পরাজিত! যেতে যেতে শোনা গেলো সম্মিলিত আহ্বান। ‘যাহা সত্য, তাহা সুন্দর/ তাকেই বেসো ভালো।’

লেখক: সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :