বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: এক মহাকাব্যের স্বীকৃতি

আফরিন জাহান
 | প্রকাশিত : ০১ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৪২

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত অঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে ভাষণ এ অঞ্চলের বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে এক করে ফেলেছিল এক নিমিষেই। আর তা হল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তখনকার রেসকোর্স্) দেয়া বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

যে মানুষটি ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ৭১ পর্যন্ত সময়ের ধাপে ধাপে মহাজাগরণের সেই ডাকটি দেয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে, আর দেশের মানুষ যার ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে সামিল হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অমর সেই ভাষণটি ক্যালেন্ডারের একটি তারিখকে মহাকালের দেয়ালে অমর চিহ্ন এঁকে দিয়ে অনন্তকালের জন্য ভাস্বর করে দিল। নিঃসন্দেহে সেটি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রেরণাদায়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গত ৩০ অক্টোবর সোমবার প্যারিসের ইউনেস্কো সদরদপ্তরে সংস্থাটির মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী তথ্যচিত্রের তালিকা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (ওয়ার্ল্ডস ডক্যুমেন্টরি হেরিটেজ) অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণসহ আন্তর্জাতিক দলিলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত এসব ঐতিহ্যের সংখ্যা এখন দাঁড়ালো ৪২৭টিতে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ৭ মার্চের সেই ভাষণটির রসদকে পুঁজি করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ্ নয় মাস লড়াই করেছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ। এ এমনই এক কবিতা যার সুধা গ্রাস করেছিল সমগ্র বাঙালি জাতিকে।

পুনর্জাগরণের অর্থই হচ্ছে ইতোপূর্বে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী এক জাগরণ বা রেঁনেসায় অংশ নিয়েছিল। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ এবং সবশেষে ১৯৭১– এই ২৩ বছর ধরেই তিল তিল করে রচিত সংগ্রামের পথ বেয়ে মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। যাতে সবচেয়ে ধারাবাহিক, সবচেয়ে দূরদর্শি এবং সবচেয়ে সাহসী নেতৃত্ব এসেছে একেবারে দেশজ, খাঁটি এবং সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা তুলনামূলকভাবে বয়সে তরুণ এক বিপ্লবী নেতার কাছ থেকে আর তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সেই সময়টি আসলে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত সংগ্রাম। কখনও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কখনও ছাত্রদের বিজ্ঞানভিত্তিক, সার্বজনীন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, কখনও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা স্বায়ত্বশাসন আদায়ের জন্য সংগ্রাম। কখনও বা সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, কখনও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম এবং এই পুরো সময়জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উপযোগী সুস্থ-সবল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম– এ সব রক্তঝরা বেগবান আন্দোলন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এক মহাজাগরণের– যার ঢেউ শীর্ষ বিন্দু ছুঁয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চ মাসে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ওই দাবানলের, যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগিরা। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির ও স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। লেখক জন রীড তার বিশ্বখ্যাত “টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড” বইয়ে তাই বলেছেন– যে কয়েকটি দিনে রাশিয়ায় লেলিনের নেতৃ্ত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যদিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে ওই ১৮ দিন। তাই বঙ্গবন্ধুর নিন্দুকেরাও বলবেন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রের নিপীড়িত, বঞ্চিত ও নির্যতিত জনগণের চিত্র ফুটে উঠেছে। সমগ্র বিশ্বে এই ভাষণ প্রশংসিত হয়েছে।

আমি বঙ্গবন্ধুর কথা শুনি আর ভাবি বঙ্গবন্ধু কি কেবলি একটি নাম কিংবা তার বক্তব্যগুলো কি কেবলি ভাষন? মোটেই না। বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্ঠান, মুক্তির বীজ থেকে জন্ম নেয়া স্বাধীনতার এক বটবৃক্ষ আর তার প্রতিটি ভাষণ একেকটি কবিতা। ৭ মার্চের ভাষণ সেই কবিতার পান্ডুলিপি থেকে বের হওয়া একটা মহাকাব্য। মুক্তিকামী মানুষের জন্য এমন মহাকাব্য আর ক’জন লিখতে পারে, নাকি লেখা সম্ভব? তাইতো এখনো আমি শিহরিত হই। আমার বুকে, অনুভূতিতে যুদ্ধের দামামা বাজে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলে। কন্ঠের কি ইন্দ্রজাল তিনি সৃষ্টি করেছেন ভাবা যায়? আজতো তাই এই ভাষণ অমলিন এবং চির তরুণ।

আফরিন জাহান

সাংবাদিক ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :