খালেদা জিয়ার উখিয়া সফর ও নতুন-পুরনো নৈরাজ্য-আতঙ্ক

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০১ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৫৩

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের যে কোনো বড় সংকটে রাষ্ট্রের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিবেন, এমন প্রত্যাশা করাই দেশবাসীর জন্য স্বাভাবিক। ছেলের কাছে লন্ডনে প্রায় তিন মাসের অবকাশ যাপনকালে দেশে ভয়াবহ বন্যা কিংবা রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি দেশবাসীর। তবে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা-প্লাবিত উখিয়ায় গেলেন এবং বললেন, শীতের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। খালেদা জিয়া নিঃসন্দেহে ভালো বলেছেন। তবে ভালো বলার উল্টা পিঠেই আবার রয়েছে রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও হিংসা-প্রসূত বক্তব্যও। সময়ের সবেচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিশ্বনন্দিত নেতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্যর্থ প্রমাণে খালেদা জিয়া কিছু রুটিন কথাও বলে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার নাকি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছেন!

কে সফল, কে ব্যর্থ, সেটি নিশ্চয় দেশবাসী নিজের বুদ্ধি-খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার উখিয়া সফরকে ছাপিয়ে বড় খবর হয়েছে সফরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অরাজকতা। সফর কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের গাড়িতে হামলা হয়েছে, সাংবাদিকদের পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। রহস্যময় বিষয় হল, খালেদা জিয়া কিংবা অন্য কোনো বিএনপি নেতার উপর কোনো হামলা হয়নি। সরকার এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি নিজেই পরিকল্পনা করে সাংবাদিকদের উপর হামলা চালিয়ে বড় ইস্যু সৃষ্টি করতে চেয়েছে। আবার বিএনপির লোকজন ছাত্রলীগের একটি ইউনিয়ন শাখার এক ‘নেতার’ ছবি প্রচার করে বলছে, সে হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে।

ইউটিউবে আমরা আবার একটি অডিও ক্লিপ শুনতে পাচ্ছি, যেখানে বিএনপির চট্টগ্রাম মহানগরী বিএনপির নেতা ডাক্তার শাহাদাৎ হামলার পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে আরেকজনের সাথে কথা বলছেন। শাহাদাৎ সেখানে বলছেন, ছাত্রলীগের নামধারী কয়েকজনকে অর্থ দিয়ে হাত করা হয়েছে, যারা হামলা পরিচালনা করবেন। বিএনপি এর জবাবে বলছে, এটি ষড়যন্ত্র। ছাত্রলীগের নামধারীদের দিয়ে হামলা করানো অসম্ভব বা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। ছাত্রলীগের অনেক ইউনিটে শিবির বা ছাত্রদলের ছেলেরা অনুপ্রবেশ করেছে, এমন অনেক সংবাদ প্রতিবেদন আমরা পড়েছি।

খালেদা জিয়া উখিয়া থেকে ফেরত আসার পথেও আমরা দেখলাম দুটি বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। বাসে আগুন দেয়া কিংবা বাসে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার সাম্প্রতিক সব স্মৃতির জনক বা জননী এই বিএনপি, এ কথা অস্বীকার করার সাহস বা দুঃসাহস কারও থাকা উচিত বলে আমি মনে করিনা। ২০১৩-১৪-১৫ সালে শত শত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে, পেট্রোল বোমা মেরে আহত-নিহত করেছে বিএনপি এবং এর রাজনৈতিক দোসর জামায়াত। ফলে বিএনপিকে বিশ্বাস করা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য একটু কঠিন বৈকি। সাংবাদিকদের পিটিয়ে আহত করা কিংবা বাস পুড়িয়ে ছাই করার ঘটনায় প্রকৃতই কারা জড়িত, সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব এদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমরা শুধু ভুক্তভোগী হিসেবে এই দুর্বৃত্তদের অভিশাপই দিতে পারি। কিন্তু এত রহস্যময়তার মধ্যেও খালেদা জিয়ার উখিয়া সফর নিয়ে কিছু কথা না জিজ্ঞেস করলে, সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট হতে হবে।

খালেদা জিয়া আকাশপথে নাকি সড়কপথে যাবেন, এটি তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার ও সিদ্ধান্ত। তিনি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবেই হোক আর অন্য যে কোনো কারণে হোক, খালেদা জিয়ার ভক্ত বা অনুসারী অনেক আছে দেশে। সৌভাগ্যজনক হোক আর দুর্ভাগ্যজনক হোক, খালেদা জিয়া এদেশের দুই প্রধান দলের একটির প্রধান। তাই তিনি কী চান, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল হিসেবে হয়ত সড়কপথে উখিয়া গেছেন। উখিয়া যাওয়ার পথে বিশাল গাড়ির বহর গেছে তাঁর সাথে।

উখিয়া মানে ঢাকা থেকে অনেক দূর, দেশের এক প্রান্তে যাওয়া। খালেদা জিয়া একের পর এক জেলা পার হবেন, মানুষ রাস্তার দুপাশে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, জিয়া, খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান হবে, ধানের শীষ আবার জাগবে, এমন আশায় হয়ত খালেদা জিয়া সড়কপথে সফর করেছেন।

কিন্তু দেশের সবাই তো খালেদা জিয়ার ভক্ত নন কিংবা বিএনপির সমর্থক নন। যদি খালেদা জিয়া এদেশের জনপ্রিয়তম রাজনীতিবিদ হতেন বা বিএনপি এদেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল হত, তাহলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হত না। তাহলে খালেদা জিয়া একজন জাতীয় নেতা হয়ে ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ অচল করে দিয়ে সড়ক পথে কেন গেলেন? উনি খুব সহজে বিমানে বা হেলিকপ্টারে যেতে পারতেন। দেশের মানুষকে কষ্ট দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা হয়ত বিশেষ কোনো তৃপ্তি পান। ঠিক আছে, খালেদা জিয়া তো আর প্রতিদিন সফর করেন না। তিনি না হয় সড়ক পথেই গেলেন, কিন্তু অসহায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেয়ার নামে খালেদা জিয়ার ভক্ত-অনুসারীরা যেভাবে রঙিন পোশাকে গায়ে হলুদের সাজে, হাতি-ঘোড়া, বাদ্য নিয়ে, নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করলেন তাতে আমাদের নতুন প্রজন্ম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা রাজনীতি নিয়ে কী বার্তা পাবে? রাজনীতি কি তাহলে পুরোটাই অভিনয়?

কে বা কারা সাংবাদিকদের আহত করল, কে বাস পুড়িয়ে দিল, সেটি বের করার দায়িত্ব এদেশের রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের। সাধারণ মানুষ রাজনীতির নামে রাস্তা-ঘাটে কোনো রকমের নৈরাজ্য দেখতে চায় না। গত দুই বছর দেশে হরতাল-অবরোধ-জ্বালাও-পোড়াও নেই। সবাই জানে, এমনকি যারা বিএনপি-ছাত্রদল করেন তারাও স্বীকার করবেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। আমার কথা যাদের মানতে কষ্ট হবে, তারা আরেকটু কষ্ট করে বিশ্বব্যাংকের শরণাপন্ন হলে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাবেন। বিএনপি-জামাতের কাছে অনুরোধ, আপনারা কীভাবে রাজনীতি করবেন, নির্বাচনে অংশ নিবেন, কি নিবেন না, সেটি আপনাদের সাথে সরকারের দরবার। অর্থনীতির ক্ষতি করে, দেশের মানুষের পেটে লাথি দিয়ে আপনারা এমন কিছু করবেন না, যার ফলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :