‘ডুব’ সেলুলয়েডে অনাগত বিপ্লবের দ্বিতীয় খুন

পিনাকী ভট্টাচার্য
 | প্রকাশিত : ০৩ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১২

ডুব সিনেমাটা নিয়ে এতো নেগেটিভ কথা শুনেছি, ভেবেছিলাম দেখবোনা, কিন্তু গতকাল হঠাৎ বন্ধুরা দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করাতে দল বেধে দেখতেই গেলাম।

ডুব সিনেমাটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চার জগতে একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আপনি সিনেমা দেখে সমাজে একটা বদলের হাওয়া বুঝতে পারেন। যারা বুঝতে পারেন তাঁরা সত্তরের দশকে রুপবান সিনেমা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন এই ভুখণ্ডে একটা উত্তুঙ্গু জাতীয়তাবাদী উত্থান হবে। নব্বই দশকে বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমা দেখে বুঝতে পারা গিয়েছিল, দেশে একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব আসন্ন। ডুব তেমনি বলে গেল, একটা বিপ্লব আসছে যা মডার্নিজমকে অতিক্রম করে যাওয়ার সাহস যোগাবে।

আমরা ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডকে নানাভাবেই ধরতে পারি, ব্যাখ্যা করতে পারি যুক্তি দিয়ে। এটাই তো মডার্ন দুনিয়া। যুক্তির খাঁচায় নির্মিত এই মডার্ন দুনিয়ায় তো ভাব কল্পনা সম্পর্কের কোন জায়গা নাই। তাহলে আপনি এই নন ফিজিক্যাল ফেনোমেননকে ধরবেন কী দিয়ে? তার উপরে ফিল্মে? সেই দুর্ধর্ষ কাজটা করেছেন ফারুকি ডুব সিনেমায়। দুর্দান্ত শটে আর অপুর্ব সিনেমাটোগ্রাফিতে। এইটা বাঙলা সিনেমাতে আগে কেউ করার দুঃসাহস দেখায়নি। এইটা সিনেমার প্রথম মুন্সিয়ানা।

ডুব দেখতে হলে হুমায়ুন আহমেদের জীবন আর তাঁর সংকটের খোঁজ রাখার দরকার নাই। তবে আলোচনায় অবশ্যই আসতে পারে। যেমন, হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ে আইনত সিদ্ধ, ধর্মমতেও সিদ্ধ, এমনকি লিবারেল দুনিয়ার ভ্যালুজেও সিদ্ধ। কিন্তু আমাদের মিডল ক্লাস এই বিয়েকে মেনে নিতে পারলোনা কেন? কালচারালি আমাদের মনোজগতের ভিতরে আধুনিকতা কী রূপ নিয়ে বাস করে সেইটা জানাবুঝার জন্য হুমায়ুন আহমেদের এই কেইস ইউনিক। ফারুকি আধুনিক হয়ে আমাদের মিডল ক্লাসের গড়ে ওঠার এই গ্যাপটা দেখিয়েছেন; তাঁর সাথে সিনেমার দারুণ ভাষায় দেখিয়েছেন এই মিডল ক্লাস ভ্যালুজ কি পরিমাণে শক্তিশালী হয়ে তাঁর অপছন্দের প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে পারে। এইটা সিনেমার দ্বিতীয় মুন্সিয়ানা।

ইন্সটিটিউশন হিসেবে ম্যারেজ বা বিয়ে আমাদের মানবিক সম্পর্ক চর্চায় যে কখনো কখনো বাধা হয়ে দাড়াতে পারে। এবং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এই আইনি আর সামাজিক সম্পর্কের অবসান মানবিক সম্পর্কের বাধা যে দূর করে দিতে পারে সেটা ফুটিয়ে তোলাটা সিনেমার তৃতীয় মুন্সিয়ানা।

মেয়ের কাছে বাবাই তাঁর ফার্স্ট হিরো। সব মেয়েই তাঁর বাবার মতো প্রেমিক চায়। সেই বাবাকে বিয়ের মতো একটা আইনি ও সামাজিক চুক্তির কারণেই নিজের বান্ধবীর কাছে হারিয়ে ফেলাটা একটা মেয়ের জন্য ভয়াবহ মানসিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। মেয়েটা তাঁর বাঁচার প্রণোদনাই হারিয়ে ফেলতে পারে। এই সুপার কমপ্লেক্স মেন্টাল কনফ্লিক্টের চিত্রায়ন ফারুকি দারুণভাবেই করেছেন। এটা সিনেমার চতুর্থ মুন্সিয়ানা।

ডুব সিনেমা দেখে তারকোভস্কির ছায়া পাই। তারকোভস্কি বলেছিলেন, "আর্ট ইন্টেলেকচুয়াল কাজ বটে, তবে সিনেমা আরো বেশী কিছু, সিনেমা আমার কাছে, হৃদয়ের উপরে আবেগের কারুকাজ করার মাধ্যম"। মানুষের সম্পর্কের নানামুখী বিচিত্র টানাপোড়নের দৃশ্য হৃদয়ের উপরে যে “ইমোশন্যাল এক্ট” বা আবেগের কারুকাজ করতে পেরেছে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। লং শট, অল্প কাট, মোটিফের ব্যবহার, বৃষ্টি, রিফলেকশন, সময়ের ধারণা দেয়া এক কথায় অপুর্ব।

শুধু কি মানুষের সাথে সম্পর্ক বিচার? ফারুকি মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্কেও একটা নতুন দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করেন। তারকোভস্কি বলেছিলেন, মানুষ আর প্রকৃতির কম্পোজিশনে ব্যক্তিকে সমগ্র পৃথিবীর সাথে একাত্ম করে দেখানো সম্ভব। ফারুকি এই সিনেমায় সেটা করতে পেরেছেন।

এই মুন্সিয়ানাগুলো আপনাকে একে একে আবিষ্কার করতে হবে সিনেমাটা দেখেই।

তবে আরবান মিডিল ক্লাস এই সিনেমা দেখে বিরক্ত কেন? বাংলাদেশের আরবান স্যেকুলার সমাজ বৃদ্ধ হয়েছে, মাঝে মাঝে বিরক্তিকর খক খক কাশি দেয়া ছাড়া আর এদের দেবার কিছু নাই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোন স্বাস্থ্যবান শিশুর আগমনে তাঁরা হিরোদ, পিলেত বা কংসরাজের মতো আতঙ্কগ্রস্ত হবেন বৈকি। মডার্নিজম না বুইঝ্যাই যারা মডার্ন হইবার ভেক ধরেন তাঁদের কাছে মডার্নিজমের ক্রিটিক অদ্ভুত লাগারই কথা। সিনেমার এই ভাষা তাঁর অচেনা লাগারই কথা। এদের পথেরপাঁচালি দেখেও আসলে বিরক্ত লাগে, লজ্জায় বলতে পারেনা।

‘দি ডিফিট অব জার্মান আর্মি এট মস্কো’ সিনেমার শুটিং এর সময় বরফে আর তুষার ঝড়ে ক্যামেরার মোটর বন্ধ হয়ে যেত। তখন সিনেমার ক্রুয়েরা নিজের শরীরের উত্তাপ দিয়ে ক্যামেরা চালু রাখতেন। ডুব সিনেমায় আপনি সেই মানবিক উষ্ণতা পাবেন, মনে হবে সেলুলয়েডের শরীর বেয়ে মাঝে মাঝে উদ্গত কান্না, অনন্ত বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। এই অনুভব বাঙলা সিনেমার দর্শকেরা সম্ভবত সেলুলয়েডে প্রথম পেলেন।

সিনেমাটা দেখুন, না দেখলে বুঝবেন না অন্তরের কোন আগুনে জ্বলে এই সময়ের সেলুলয়েড এক নতুন সময়ের আগমনী বার্তা ঘোষণা করেছিল।

(‘ডুব’ কে দ্বিতীয় খুন বলাতে কেউ কেউ জানতে চাইতে পারেন ‘প্রথম খুন’ কোনটা ছিল? প্রথম খুন ছিল নাটকপাড়ার "রিজওয়ান") লেখক: অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :