বন্ধ হোক নৃশংসতা

রাকিব খান
 | প্রকাশিত : ০৪ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৩৬

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা বিবেকবান মানুষকে ছুঁয়ে গেছে। বিবেকবান এই অর্থে কারণ আমাদের বেশিরভাগের অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে। কোন কিছুতেই এই শ্রেণির কিছু যায় আসে না। নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া ঝেড়ে কাশতেও তাদের বুক কাঁপে, শ্বাসকষ্টও বাড়ে বোধ হয়। শারীরিক আরও নানা জটিলতা এড়াতে চোখ বন্ধ রাখার নান্দনিক কৌশল তারা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করছে। এক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা পশুর চেয়ে ঢের বেশি।

সমাজে ইতর প্রাণীর নৃশংসতা হরহামেশাই চোখে পড়ে। এখন মানুষের এমন আচরণ দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। এর সবচেয়ে কাছের উদাহরণ হলো হাসপাতালে প্রাপ্য সেবা না পেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীর সড়কে সন্তান প্রসব। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে পরে মৃত্যু হয় সেই নবজাতকের। এক প্রতিক্রিয়ায় এমন ঘটনাকে অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় অপরাধ বলে মন্তব্য করে আদালত। এর রেশ কাটতে না কাটতেই চিকিৎসকের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। এবারের দুটি ঘটনা অবশ্য রাজধানীর বাইরে। প্রথমটি কুমিল্লায়। সেখানে মায়ের পেটে সন্তান রেখেই সেলাই করে দেন চিকিৎসক শেখ হোসনে আরা। শুধু তাই নয় গর্ভে থাকা সন্তানকে টিউমার বলেও মত দেন তিনি। দেয়া হয় রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থাপত্রও। এর প্রায় একমাস পর ঢাকা মেডিকেলে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মৃত অবস্থায় বের করা হয় গর্ভের সন্তান। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান মা খাদিজা আক্তার। আর বগুড়ায় প্রত্যাশিত চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন এক বৃদ্ধা। স্বজনদের ভাষ্য অসৌজন্যমূলক আচরণের অজুহাতে হাসপাতালের আইসিইউ থেকে রোগীকে বের করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। মারধর করা হয় তার আত্মীয়দের। বাড়িতে নেয়ার পথেই মৃত্যু হয় মাহিয়া বেওয়ার। অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

রাজশাহীর একটি ঘটনার বীভৎসতা আমাদেরকে শিহরিত করে। বছর খানেক আগে সেখানকার নাইস হোটেলের একটি কক্ষ থেকে তরুণ-তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেসময় এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। দ্বিতীয় দফায় তদন্তে নেমে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন নিশ্চিত করে এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যা। বন্ধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয় তার প্রেমিকাকে। অপরাধ আড়াল করতে নির্যাতনের পর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় আক্রান্ত নারীরও। প্রযুক্তির সহায়তায় এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এক্ষেত্রে ধন্যবাদের দাবিদার পিবিআই। আলোচিত এসব ঘটনা ছাড়াও কমবেশি প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। সড়কে আমরা মৃত্যুর মিছিল দেখছি। কাজে গিয়ে প্রায়ই প্রাণ হারাচ্ছে শ্রমিক। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারা পড়ছে দলের কর্মী। অনাকাঙ্খিত এসব মৃত্যু আমরা যেন মেনেই নিয়েছি।

কিন্তু কেন মূল্যহীন হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। কেন এতো অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা কিংবা নারকীয়তা। অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য নগরায়নসহ নানা কারণে সমাজের নানা স্তরে বেড়েছে বঞ্ছনা আর বৈষম্যের মাত্রা। তাই যে কোন উপায়ে অর্থ আয়ের মানসিক দুরাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দোষ করেও ক্ষমা পেয়ে যাওয়া কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার উদাহরণ আমাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতির প্রভাবসহ নানা কারণে আইন হাতে তুলে নিচ্ছে অনেকে।

মনোবিদরা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চান একটু অন্যভাবে। তাদের মতে নৈতিক শিক্ষার অভাবে জটিল হয়ে উঠেছে আমাদের মানসিকতা। কোন কিছুতেই আমরা এখন আর সন্তুষ্ট হতে পারছি না। নতুন নতুন চাহিদা পূরণে আমরা বেপরোয়া হয়ে উঠছি। জবাবদিহিতার সংকট সেই সমস্যাকে আর ঘনীভূত করেছে।

তাহলে সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় কী? সমাজ বিশ্লেষকদের ভাষ্য শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা-সান্নিধ্যের কোন বিকল্প নেই। পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু পরবর্তীতে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষণ্নতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু। তাই সন্তান প্রতিপালনে যত্নবান হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতি গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবারই। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। কেননা জাতির ভিত গঠন হয় এই স্তরেই। এটি নড়োবড়ো হলে মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারণাটি অঙ্কুরেই নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে প্রাইমারি স্কুলের সব শ্রেণির শিশুকে মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, নৈতিকতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ,পরিবেশ-প্রতিবেশ ইত্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞানদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

আর শিক্ষকদের যোগ্যতা, দক্ষতা, বেতন ও ভাতা যেন অন্য সব ক্যাডার সমতুল্য হয়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া অপসংস্কৃতির বিস্তার রোধ ও মূল্যবোধের বিকাশে গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই কেবল নির্বিঘ্ন হবে সোনার বাংলার অগ্রযাত্রা।

লেখক: সাংবাদিক, যমুনা টেলিভিশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :