হুমায়ূন বেঁচে থাকলে ‘ডুব’ দেখতেন?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৪৮

‘ডুব’ নিয়ে আমার ভাবনাটা ভিন্ন। আমি ভাবছি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে কী বলতেন? মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিশ্চিয়ই তাকে প্রেক্ষাগৃহে নিমন্ত্রণ করতেন। ডুব দেখতে। আচ্ছা, হুমায়ূন আহমেদ কি সত্যিই প্রেক্ষাগৃহে যেতেন? ধরে নিলাম হুমায়ূন আহমেদ প্রেক্ষাগৃহে গেলেন। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন তার পাশে। দুজনের কোলে দুই পুত্র—নিষাদ ও নিনিত। দুই ঘণ্টা বসে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে নিষাদ বিরক্ত হয়ে বলত, ‘বাবা, বাসায় যাব কখন?’ নিনিত হয়তো কোল থেকে পিছলে নেমে যেত। তাকে ধরে রাখতে আরেক দিকদারি।

ধরে নিলাম দুই পুত্রকে সামলে হুমায়ূন দম্পতি সিনেমাটা শেষ করেই হল থেকে বেরোতেন। তড়িঘড়ি করে গাড়িতে ওঠার আগে সাংবাদিকরা জানতে চাইতেন, ‘ডুব কেমন লাগল, স্যার?’

হুমায়ূন আহমেদ কী বলতেন এই আন্দাজ করা কঠিন। তিনি হয়তো উঁচু দরের কোনো রসিকতা করে বসতেন। আবার চুপ থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী শাওনের প্রতিক্রিয়া জানার সাহস সাংবাদিকরা দেখালেও আদতে কী ঘটত?

আমি জানি, আমার এসব কৌতূহল অনুর্বর মস্তিষ্কের কাল্পনিক ভাবনা। একেবারেই সস্তা দরের কথাবার্তা। আমি তা মানছি। তবে এই সস্তা দরের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অধিকার একজন দর্শক হিসেবে আমার থাকাটা বাঞ্ছিত বলে মনে করছি। কারণ, ‘ডুব’ দেখতে আমার মুদ্রাত্যাগ করতে হয়েছে। আমি সেই ক্ষতি মেনে নিয়েছি। অল্প আয়ুর জীবন। সময় খুবই কম। এই কম সময়ের মধ্য থেকে সময় বের করতে হয়েছে ‘ডুবে’র জন্য। সারাদিন বিভিন্ন ধরনের কাজ আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। করোটিকে কী পরিমাণ চাপ সামলাতে হয়, তা সহজেই বোঝা যায়। তার ওপর ‘ডুব’ নতুন চাপ তৈরি করেছে। তাও মেনেছি সহজে। তাহলে ‘ডুব’ নিয়ে আমার ভাবনা বলুন আর প্রশ্নই বলুন, কেন অবান্তর হবে?

যেহেতু এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো সময়-সুযোগ কোনোটাই ‘ডুব’ সংশ্লিষ্টদের নেই, তাই নিজে থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।

অকপটে বলতে পারি, হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এমন একটি সিনেমা বানানোর ‘শখপূরণ’ কোনো নির্মাতারই হতো না। কেউ কেউ বলবেন, কে বলেছে হতো না? নির্মাতার স্বাধীনতা আছে। তিনি যা খুশি বানাতে পারেন। না, নির্মাতার স্বাধীনতা আছে বলে, যা খুশি বানাতে পারেন না। পারেন না বলেই হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে কেউ এ ধরনের শর্ট ফিল্ম বানানোর সাহস দেখায়নি। ফিল্ম (আসলেই কি ফিল্ম হয়েছে!) তো দূরে থাক। হুমায়ূন আহমেদের লেখা, নির্মাণের প্রতি আমার প্রীতি আছে বলে বলছি না, একজন মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এভাবে বাণিজ্য করার অধিকার কেউ সংরক্ষণ করে না।

‘ডুব’ নিয়ে এতটাই আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে যে, একজন দর্শক প্রেক্ষাগৃহে না গিয়েও হরবর করে কাহিনি বলতে পারবেন। সংলাপও বলতে পারবেন চেষ্টা করলে। সবই লেখা হয়েছে। বলা হয়েছে। ‘খোকা’ টাইপের দর্শককেও আমি বলতে শুনিছি, ‘হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে ছবি বানাইছে ফারুকী ভাই। কিন্তু এইটা কিছু হইল?’

কী হলো আর না হলো, এই বিশ্লেষণের দায়িত্ব ফিল্মবিদের হলেও দর্শক হিসেবে আপনি সাধারণের মত উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই নির্মাতার চেয়েও যারা হুমায়ূনকে বেশি জানেন, বেশি পড়েছেন তাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। একজন হুমায়ূন পাঠক হুমায়ূন সম্পর্কে সব জানেন না। কিন্তু অনেক জানেন। যতটুকু জানলে একজন লেখকের ব্যক্তিজীবন আঁচ করা যায়, ততটুকুই।

‘ডুব’ সিনেমায় নির্মাতা ফারুকী কী চেয়েছেন? আমার মনে হয়েছে, তিনি বাজার অর্থনীতিতে হুমায়ূন আহমেদকে পুঁজি করেছেন। এই পুঁজিতে ব্যবসা ভালো হওয়ার সুযোগ আছে। তাই কায়দা করে ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই ‘হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক’ বলে ধুপকাঠির ধোঁয়া দিয়েছেন। আমার মায়ের কথাই ধরা যাক। তিনি যে খুব বেশি দেশি চলচ্চিত্রের খবর রাখেন তা না। তবে ‘ডুব’ বের হওয়ার পর আমাকে একদিন বললেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নাকি বানিয়েছে? টিকিটের ব্যবস্থা করিস। দেখব।’

আমি তাকে বললাম, ‘কে বলল হুমায়ুনের বায়োপিক?’ মা জবাব দিলেন, ‘পত্রিকায় পড়লাম।’

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের বাণিজ্যিক ব্যবহারটা কীভাবে হয়েছে। একজন অনিয়মিত বাংলা সিনেমার দর্শকের কাছেও তথ্য আছে, ‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে করা।

পরিচালক সরয়ার ফারুকী, তার স্ত্রী তিশাকে গণমাধ্যমের বিভিন্ন আলোচনায় আমি বলতে শুনেছি, এটি হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে করা হয়নি। তবে তার জীবন থেকে কাহিনি বাছাইয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রতি তার ভালোবাসাও প্রকাশ করেছেন। স্মৃতিকাতর হয়েছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এক করে যে ‘ডুব’ তিনি বানিয়েছেন, তাতে আদৌ কী ধরনের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে তা আমার মাথায় আসছে না।

‘ডুব’ সিনেমার চিত্রায়ণ কিংবা সংলাপ নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। কিছু কথা একেবারে অমূলক নয়। চলচ্চিত্রে ফারুকীর একটা আলাদা জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এটা তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তার নির্মাণই ভিন্নতা এনেছে। ‘ডুবে’ও সেই ছোঁয়া আছে। বিশেষ করে মায়ার বাবা সাবেক আর্মি অফিসারের বাতচিতে। মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। জাভেদ হাসানের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। তিনি থানার ওসির সঙ্গে কথা বলছেন। তবে কথোপকথনের ভেতরে বাস্তবতা ছিল না। কারণ তিনি রীতিমতো থানার ওসিকে ধমকাচ্ছিলেন। ওসি সাহেব কোনো তথ্য জানতে চাইছেন। আর মায়ার বাবা কথা বলছেন বাঁকা সুরে। এখানে বাস্তবতা কতটুকু? এভাবে উগ্রতা প্রকাশের মানে কী? তারপরের একটি দৃশ্য। টেবিলে ভদ্রলোক বসে আছেন। তার স্ত্রী প্লেটে ভাত দেয়ার পর তিনি প্লেটটি তুলে পাশে ফেলে দিলেন। বেশ সূক্ষ্ম ছিল দৃশ্যটি। বোঝা যাচ্ছিল, ভদ্রলোক প্লেট ভাঙার পরিকল্পনা নিয়ে টেবিলে বসেছেন। তারপর কাজ সেরে উঠে গেলেন।

দৃশ্যায়ন, চিত্রায়ণ নিয়ে বেশি কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই। এ নিয়ে বোদ্ধারা বলেছেন, বলছেন, বলবেন। আমার বলার বিষয় হলো, ছবির কাহিনি। ‘হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়ে ছবি’—এই প্রচারণা এত বেশি হয়েছে যে, আমার মতো অনেক দর্শক ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। শুরুতেই হোঁচট খেতে হয়েছে ইরফান খানকে দেখে। যিনি চলচ্চিত্র পরিচালক জাভেদ হাসানের ভূমিকায় ছিলেন। একটি প্রতিবেদনে পড়েছিলাম ইরফান খানের প্রস্তুতি নিয়ে। তিনি নাকি এই ছবিতে অভিনয় শুরুর আগে হুমায়ূন আহমেদের কথা বলার ভঙ্গি, চলনবলনের অনেক ভিডিও দেখেছেন। হুমায়ূন কীভাবে কথা বলতেন, কীভাবে রসিকতা করতেন, এসবই নাকি তার দেখা। আসলেই যদি তা-ই হবে তাহলে এর ছাপ তার অভিনয়ে থাকবে না? তিনি তো বাংলায় ঠিকভাবে কথা বলতে পারেন না, তাহলে হুমায়ূন কীভাবে কথা বলে এটা আত্মস্থ করবেন কীভাবে? এখানেও পরিচালক শিল্পের চেয়ে বাজারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে একজন ভিনদেশি শক্তিমান অভিনেতার দুর্বলতা প্রদর্শন ছাড়া কিছুই হয়নি।

ছবির যে বিষয়টি নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, তার পেছনে আছে শাওনের চরিত্রে পার্নো মিত্রের অভিনয়। নাম ছিল নিতু। পার্নো মিত্র কাজ শুরুর আগে বা পরে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছিলেন, ‘ডুব’ সিনেমায় তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করছেন সেই চরিত্রের নাম মেহের আফরোজ শাওন। পরে অবশ্য সেই স্ট্যাটাস তিনি সংশোধন করে নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ছবিতে শাওনকে একেবারে খলচরিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই মন্তব্য হাজারো দর্শকের।

আমার মনে হয়, শাওনকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরার পেছনে বেশ কিছু বিষয় কাজ করেছে। হুমায়ূন আহমেদের জীবনে যখন শাওন এলেন তখন থেকেই একটা বড় সমালোচক গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যায়। সেই গোষ্ঠী এখনো আছে। এদের মধ্যে হুমায়ূনের পাঠকদের একটি অংশ আছে, যারা অকপটে বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদ কাজটি ঠিক করেননি। তিনি এভাবে মেয়ের বান্ধবীর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করে তার ব্যক্তি ইমেজকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই বলে যে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে। তিনি একা হয়ে যাবেন।

আবার অনেকে এটিকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখেছেন। মানুষ কোন বয়সে, কীভাবে প্রেমে পড়বেন তা আগে থেকে বলা কঠিন। তার পছন্দ-অপছন্দের পরিবর্তন কীভাবে হবে তাও হলফ করে বলা যায় না। তাহলে হুমায়ূন আহমেদের অসম প্রেম মহা অন্যায়ের ভেতরে ফেলতে তার ভক্তরা নারাজ। আবার আরেক শ্রেণি আছে যারা প্রিয় হুমায়ূনের অসম প্রেম নিয়ে কথা বলতে বিব্রত ছিলেন। ভালোমন্দ কিছুই বলেননি। কারণ, মানুষটার সৃজনশীলতা একবার যাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে তার সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ কাজ না। এই শ্রেণির মানুষ হুমায়ূনের গুলতেকিন আর শাওন পর্ব নিয়ে মাথা ঘামাননি। এটাকে একান্তই পারিবারিক বিষয় বলে মনে করেছেন। এখনো করছেন। তিনি লেখক বলে কি তার ব্যক্তিজীবন থাকতে নেই? তার পারিবারিক জীবনের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কথা বলার অধিকার তার পাঠকেরা সংরক্ষণ করে? যদি ধরেও নিই যে হুমায়ূনের পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা বলার অধিকার আমাদের আছে, তাহলে তা কতটুকু? আপনি আপনার ভালো লাগা, মন্দ লাগার জায়গা থেকে মন্তব্য করতে পারেন, তাই বলে তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনকে বাণিজ্যে ব্যবহার করতে পারেন না। অথচ ফারুকীর মতো একজন সচেতন নির্মাতা এই কাজটি করেছেন। শুধু করেননি ভালোভাবেই করেছেন।

ফারুকী হয়তো চেয়েছিলেন পুরো সিনেমায় শাওনকে নেতিবাচক চরিত্রে উপস্থাপন করে একটি বড় শ্রেণির দর্শকের বাহবা পেতে। তিনি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে এবং মারা যাওয়ার পর তৈরি হওয়া সংকটগুলো তুলে ধরেছেন একতরফাভাবে। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা যতটুকু জেনেছি, টেলিভিশনে যতটুকু দেখিছি তার পুরো মন্দ লাগার বিষয়গুলো ডুবে তুলে আনা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পাঁচ বছরের বেশি সময় পর শাওনকে এক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে জনতার আদালতে। প্রশ্ন, এটা কি খুবই জরুরি ছিল?

পারিবারিক সংকট নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে একজন ভালোবাসার মানুষের প্রতি কতটা সুবিচার করলেন নির্মাতা? নিতুর চরিত্রের এত নেতিবাচক দিক থাকার পরও কোন যুক্তিতে নির্মাতা জাভেদ হাসান তার প্রেমে পড়ল? বলবেন, প্রণয় কি আর যুক্তিতে হয়! মেনে নিলাম হয় না। কিন্তু এটা কার ক্ষেত্রে? জাভেদ হাসানের মতো একজন প্রতিষ্ঠিত চিত্রপরিচালক এত বড় ভুল জীবনে করেছেন? তার বয়সটা কি রঙিন চশমা পরা বয়স ছিল? নিতুর মধ্যে অবশ্যই ভালো লাগার মতো কিছু ছিল বলেই তিনি মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়েছিলেন। এভাবে একতরফা একটি চরিত্রকে নেতিবাচক উপস্থাপনায় পরিচালক কী প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট।

নির্মাণে ‘ডুব’ পরিচালক কতটা সফল সেই তর্ক-বিতর্কে আর যাচ্ছি না। তবে এ কথা বলা যায়, তিনি পরিকল্পনামতে সফলভাবেই হুমায়ূন আহমেদের বাণিজ্যিক ব্যবহার করেছেন। এই দৃষ্টিতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বাহ্বা পেতেই পারেন। আপনি কী বলেন?

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :