দ্রুততার নামে ভুল, হঠকারী সাংবাদিকতা কাম্য নয়

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৬ নভেম্বর ২০১৭, ০৯:১৭

বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমের অপেশাদারিত্বের মুখটা আবার নেকাববিহীন হয়ে গেল। বেশ কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ সাংবাদিক, উৎপল দাশের আকস্মিক ফেসবুকীয় ‘খোঁজ পাওয়া’কে ব্রেকিং নিউজ বানিয়ে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন সংবাদপত্র দেশের পুরো সংবাদমাধ্যম জগতকেই যেন জনতার আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাল। বাকিদের পেছনে ফেলে ‘ফার্স্ট’ হওয়ার বাসনা থেকে সৃষ্ট ভুল সাংবাদিকতায় এমন স্পর্শকাতর একটি কাঙ্ক্ষিত সংবাদকে শেষপর্যন্ত গুজবের কলঙ্ক নিয়ে সরে যেতে হল টেলিভিশনের পর্দা কিংবা ওয়েবের জগত থেকে।

তরুণ সাংবাদিক উৎপল দাশের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, প্রায় মাসখানেক হতে চলল। অনুমান বা আন্দাজ করে বা গুজবের উপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে নিউজ করা যাবে না। পারলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করে কোনো সংবাদমাধ্যম যদি পারে, উৎপলের খবর এনে দিক। না পারলে, রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করা ছাড়া কারও কোনো উপায় আছে? নিজেরা চেষ্টা না করে, দুই একজন ‘বড় সাংবাদিকের’ ফেসবুক পোস্টের উপর ভিত্তি করে উৎপল দাশের খবরকে স্ক্রলে দিয়ে চ্যানেলগুলোর লাভ হল কী? তাৎক্ষণিক হয়ত সামান্য টিআরপি বেড়েছিল, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা যে প্রশ্নবিদ্ধ হল দীর্ঘমেয়াদে, সে বিষয়ে কারও মাথাব্যাথা আছে? অবশ্য মাথা থাকলেই না কারও মাথাব্যাথা থাকবে। একটা অনলাইন নিউজপেপার নিউজ করল। এটা দেখে অন্যরা নিউজ করবেন কেন? নিজেদের লোকবল নেই? নিজেরা খবর নিবেন না?

গুজবকে নিউজ আকারে প্রচার করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কয়েকটির সাংবাদিকতা করার আত্মঘাতী প্রয়াসের ঘটনা এই প্রথম নয়। কয়েক বছর আগে, মহাজোট সরকারের মন্ত্রিপরিষদে রদবদল আসছে বলে নিজেদের পর্দা এবং মানুষের মাথা গরম করে ফেলেছিল কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল। এমনকি বঙ্গভবনে কয়টার সময় নতুন মন্ত্রিদের শপথ পড়ানোর খবর দিচ্ছিল সে চ্যানেলগুলো। কিন্তু দুপুর না গড়াতেই নিউজ কিল করতে হয়েছিল তাদের।

খুব সম্প্রতি ভারতের বিতর্কিত সাংবাদিক সুবির ভৌমিক বাংলাদেশের রাষ্ট্র স্বার্থবিরোধী একটি উস্কানিমূলক প্রতিবেদন লিখলে, কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নিজেরা যাচাই-বাছাই না করেই অন্ধের মত সে প্রতিবেদন অনুকরণ করেছিল। ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিবৃতি এসেছিল। আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে কেন্দ্র করে হাস্যকর সাংবাদিকতা করেছিল একটি অনলাইন নিউজপোর্টাল। পরিণামে সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্যতা গণমানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রের পেশাদারদের কাছে সাংবাদিকরা হয়েছিল হাসি ও উপহাসের পাত্র।

সাংবাদিকতা পেশায় যতই বেতন-কাঠামো কিংবা চাকরির নিরাপত্তা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা থাকুক, যতক্ষণ সাংবাদিক হিসেবে আছেন, ততক্ষণ কোনো ধরনের হঠকারিতা করা যাবে না। ইন্টারনেট-পূর্ব পৃথিবীতে তাও শেষপর্যন্ত ছাপাখানায় যাওয়ার আগে রিপোর্ট প্রত্যাহার করা যেত। পাঠকসমাজ পত্রিকা হাতে পেলেও রিপোর্ট বা ছবি প্রত্যাহারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারত না। কিন্তু এখন যুগ বদলে গেছে।

ইন্টারনেট এসে সংবাদপ্রাপ্তি ও প্রচারে যেমন গতি এনেছে, পাশাপাশি পেশাদারিত্বের চ্যালেঞ্জও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ইন্টারনেট তথ্য, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি সংবাদ উপকরণ প্রাপ্তি অকল্পনীয় পর্যায়ের দ্রুত করেছে। বিশেষ করে ফেসবুক ও টুইটারসহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া প্রাথমিক উৎস হিসেবে অসম্ভবকে সম্ভব করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছেলের জন্য পোলাও রান্না করছেন, এমন একটা অতি ব্যক্তিগত ছবি আমরা কেবল ফেসবুকের কল্যাণেই পেতে পারি। বিশেষ করে বাংলাদেশে ফেসবুকের ব্যবহার অনেক বেশি। মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার পাশাপাশি নিউজপ্রাপ্তির অন্যতম বড় প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে ফেসবুক। প্রতিটি প্রিন্ট ভার্সনের পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন পোর্টাল আছে। আর বড়-ছোট মিলিয়ে অনলাইন নিউজপেপার যে কত আছে, সে বোধকরি আমাদের সরকার বাহাদুরও জানেন না। ইন্টারনেট-পূর্ব জমানায়, ডেডলাইন বলতে বোঝাত, সংবাদ প্রতিবেদন জমা দেয়ার শেষ সময়। ইন্টারনেট-নির্ভর পৃথিবীতে ডেডলাইনের সেই সংজ্ঞা আর চলে না। এখন বলতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিবেদন পেশ করা।

যে যত দ্রুত প্রতিবেদন লিখে বা নির্মাণ করে হাউজে জমা দিতে পারবে, সেই ইন্টারনেট যুগের দক্ষ রিপোর্টার। কিন্তু এই দ্রুততার পাশাপাশি আমাদের কোনো ক্রমেই ভুল, অসত্য, গুজব-নির্ভর সাংবাদিকতা করা যাবে না। সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে সংবাদ প্রতিবেদনে ব্যবহৃত তথ্য ও ছবি সঠিক ও সত্য কি, না? যে কোনো বিষয়, বিশেষ করে হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়ে সুনিশ্চিত না হয়ে খবর পেশ করা যাবে না।

বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে অনেক সময় ও শ্রম লাগে। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হতে সময় লাগে না। দ্রুততার নামে, সবাইকে পেছনে ফেলে নিজে ফার্স্ট হওয়ার জন্য, পুরো ক্রেডিট নিজেরা নেয়ার জন্য, অন্যদের বোকা মনে করে, তাড়াহুড়া করে নিউজ করা যাবে না। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই ভুলগুলো তারাই করে বেশি। তাই একটা কথা আমাদের গণমাধ্যম কর্মীদের মগজে গেঁথে নিতে হবে। সেটি হল-সবার আগে নির্ভুল সংবাদ প্রচার। সবার আগে সংবাদ দিতে গিয়ে ভুল করলে হবে না। এক্ষেত্রে নির্ভুলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাই আগে সংবাদ যাচাই, নিশ্চিত হয়ে তারপর প্রচার। একটু দেরি হউক, তাতে দীর্ঘমেয়াদী লাভই হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :