কিং খানের বেড়ে ওঠা- ২

দারিদ্র্যে কেটেছে শাহরুখের শৈশব

আমিনুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:৩৭ | প্রকাশিত : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১২

১৯৬৫ সালের ২ নভেম্বর। নিউ দিল্লির তালওয়ার নার্সিং হোমে জন্ম হয় শাহরুখ খানের। শাহরুখ খান তার পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। মীর-ফাতেমা দম্পতির প্রথম সন্তান হচ্ছে একজন মেয়ে। শাহরুখের বড় বোন শাহনাজ লালারুখ শাহরুখ থেকে পাঁচ বছরের বড়।

জন্মের সময় শাহরুখ খানের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটপূর্ণ। বাচ্চা বাঁচবে কি না এই আশঙ্কায় ছিলেন মা ফাতেমা। মঙ্গলবারে জন্ম হয়েছিল বলে-শাহরুখের মা ভাবতেন নিশ্চয়ই এই ছেলে তাঁর জন্য মঙ্গল নিয়ে আসবে।

অর্থনৈতিক ভাবে শাহরুখ খানের পিতা তখন মারাত্মক অভাবের সময় পার করছিলেন। কোনো স্থায়ী আয় রোজগার ছিল না। এক বন্ধুর সাথে পরিবহনের ব্যবসা, ক্যান্টিন চালানো-এসব বিভিন্ন কাজ করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতেন। শাহরুখ খান পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন যে-আইনে ডিগ্রিধারী ও ছয়টি ভাষায় পণ্ডিত হওয়ার পরও আমার পিতা কেন যে সম্পদ অর্জন করতে পারলেন না-তা রহস্যই বটে।

শাহরুখ খানের মা ফাতেমা লতিফ ছিলেন একজন পুরোদস্তুর উর্দুভাষী। পিতা ছিলেন একজন পাঠান। পাঠানদের মাতৃভাষা হচ্ছে প্রধানত পশতু, তবে উর্দুও সমানতালে চলে। তাই বলা যায়- শাহরুখ খানের মাতৃভাষা কিন্তু হিন্দি নয়। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, হিন্দি-উর্দু ভাষার শব্দচয়ন ও ব্যাকরণে ৮৫ ভাগ মিল আছে। একজন উর্দুভাষী হিন্দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

পশ্চিম দিল্লীর রাজিন্দর নগর এলাকায় বাস করত শাহরুখ খানের পরিবার। ছোট্ট দুই কামরার কক্ষ। শাহরুখের জন্মের পর থেকেই তাঁর পিতা চরম অর্থকষ্টে। দারিদ্রের কষাঘাতে নুইয়ে পড়েছেন তিনি। কিন্তু বন্ধু কানহাইয়া লাল ছাড়া অন্য কারও সাথে তিনি তাঁর এই অবস্থার কথা শেয়ার করতেন না। অভিজাত পরিবারের সন্তান ফাতেমা স্বামীর এই অবস্থা সইতে না পেরে বারবার তাগাদা দিতেন-যেহেতু তিনি একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী সেইসূত্রে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে কোনো কিছু করা যায় কি না।

কিন্তু মীর উদাসীন। উর্দু কবিতা আর পান চিবাতে চিবাতেই তাঁর দিন যায়। শাহরুখের মা ফাতেমা লতিফ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। বাচ্চাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও কোরআন পড়ার দিকে তিনি নজর দিয়েছিলেন। মীর এত ধর্মের ধার ধারতেন না। তাঁর মতে সব ধর্মই সমান। এমনকি তাঁদের ঘরে হিন্দু দেবতা জগন্নাথের মূর্তিও ছিল।

প্রতি গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে শাহরুখ তাঁর নানার বাড়ি ব্যাঙ্গালোর যেতেন। চার বৎসর যখন পার হলো, শাহরুখ প্রথমবার টেলিভিশন দেখেন তার নানার বাড়িতেই। সেই বয়সেই শাহরুখের প্রিয় অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠেন বলিউডের লাস্যময়ী নায়িকা মমতাজ।

বলিউডের সাথে প্রথম সংস্পর্শ

স্কুলে থাকাকালীন শাহরুখ প্রায়ই হিন্দি ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টে ফেল করতেন। এরপর ফাতেমা তাঁর পুত্রকে বললেন, ‘বেটা, তুমি যদি হিন্দি ভাষার কোর্সে পাস করতে পার, তাহলে তোমাকে নিয়ে সিনেমা হলে মুভি দেখতে যাব।’ সিনেমা হলে যাওয়ার লোভে শাহরুখ সেবার খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলেন। পরীক্ষার আগের রাত প্রায় সারারাত পড়েছেন। পরীক্ষায় পাস করে ফেললেন। কথামতো ফাতেমা তাকে নিয়ে দিল্লির প্যাটেল নগরের বিবেক সিনেমা হলে যান ‘জোশিলা’ মুভিটি দেখার জন্য।

জোশিলা মুভিটি খুব আহামরি টাইপের ছিলো না। যদিও অভিনেতা ছিলেন দেব আনন্দ। দর্শকদের খুব বেশি আগ্রহ না থাকায় টিকেট সংগ্রহ করতে খুব হুড়োহুড়ি হয়নি। কিন্তু শাহরুখের মনে দাগ কেটে গেলো, সিনেমা হলের সেই উল্লাসমুখর পরিবেশ। সেই সত্তর দশকে শাহরুখের স্বপ্নের নায়ক ছিলো অমিতাভ বচ্চন। আসলে অমিতাভ হিন্দি সিনেমার সংজ্ঞা নতুন করে লিখেছিলেন। রোমান্টিক রাজেশ খান্নার সাম্রাজ্যকে তছনছ করে অ্যাংরি ইয়ংম্যান অমিতাভের উত্থান শুরু ১৯৭৩ সালে জঞ্জির সিনেমার মাধ্যমে।

শাহরুখের মতো অমিতাভের চেহারাও খুব বেশি আকর্ষণীয় ছিলো না। শাহরুখ নিজেও ছিলেন লম্বা, স্বাস্থ্যহীন। তিনি কথাবার্তায়, চালচলনে অমিতাভকে নকল করতেন। আর অন্যকে নকল করার ক্ষেত্রে শাহরুখ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উস্তাদ। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানেও এই জন্যই ডাক পড়তো শাহরুখের। অমিতাভ বচ্চনের প্রায় সবগুলো মুভিই শাহরুখ কিশোর বয়সে দেখেছিলেন সিনেমা হলে। আর এসব মুভি দেখার ব্যাপারে শাহরুখের সঙ্গী ছিলেন অমৃতা সিং।

এই সেই অমৃতা সিং, যিনি পরবর্তীতে বলিউডের নায়িকা হয়ে বেশ কিছু মুভিতে অভিনয় করেন। ক্রিকেট অলরাউন্ডার রবি শাস্ত্রীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক হয় পরবর্তীতে এই অমৃতা সিংয়ের। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর বলিউডের নবাব সাইফ আলী খানের সাথে বিয়ে হয় অমৃতা সিংয়ের। বয়সে অমৃতা সিং সাইফ আলী খান অপেক্ষা ৯ বছরের বড় ছিলেন। সে বিয়েটাও অবশ্য টিকেনি।

যাক সে কথা। অমৃতা সিংয়ের মা রুখসানা সুলতানা ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কংগ্রেসের নেত্রীও ছিলেন তিনি। সত্তর দশকে দিল্লির মুসলমানদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি চালু করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। সেই কাজ করতে গিয়ে শাহরুখের মা ফাতেমা লতিফের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয় রুখসানার। দুইজনেই এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। শাহরুখের মাও ততদিনে সরকারি চাকরি নিয়েছেন। কিশোর আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তিনি। শাহরুখের বড় বোন শাহনাজের সাথে একই স্কুলে পড়তো অমৃতা।

স্কুল ছুটির পর শাহরুখ, শাহনাজ ও অমৃতা তিনজনে মিলে জম্পেশ আড্ডা দিতেন অমৃতা সিংয়ের বাড়িতে। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করতেন কিভাবে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যাবে-এই নিয়ে। শাহরুখ সাজতেন অমিতাভ আর অমিতাভরুপী শাহরুখের সাথে রোমান্স করার অভিনয় করতেন অমৃতা সিং।

আট বৎসর বয়সে শাহরুখ উর্দুতে কবিতা লেখা শুরু করেন। পিতা মীর এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিতেন। প্রখ্যাত উর্দু কবি মীর্জা গালিব, মীর তাকি-এদের কবিতা পড়ে শাহরুখকে শোনাতেন তাঁর বাবা। শাহরুখ পরবর্তী কালে স্বীকারও করেছেন-উর্দু কবিতার ভুবনই তাকে রোমান্টিক হতে সাহায্য করেছে। দিল্লির রামলীলা ময়দানে প্রতিবছর খুব জাঁকজমকের সাথে দশেরা উৎসব পালিত হতো।

রাম-রাবনের কাহিনি নিয়ে তৈরি হতো মঞ্চনাটক প্রতিদিন। রাবনকে পরাজিত করতে রামের দরকার পড়ে বানর সেনার। শাহরুখ সে সময় বানর সেনা সাজতেন। পিতামাতা শাহরুখের এই অভিনয়ের প্রতি টানকে কখনো মন্দ চোখে দেখতেন না। এভাবেই আনন্দঘন পরিবেশে, কিছুটা দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে শাহরুখের কিশোর কাল অতিবাহিত হয়।

(চলবে...)

ঢাকাটাইমস/০৯নভেম্বর/এআই/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :