প্রিয় মাশরাফি, তোমাকে ধন্যবাদ-অভিনন্দন

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:৫৭ | প্রকাশিত : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৪

মাশরাফি বিন মুর্তজাকে ধন্যবাদ। দেশের মানুষের জন্য, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সামনেএকের পর এক উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছেন। একজন খেলোয়াড়, একজন তারকা, একজন নেতা, সর্বোপরি একজন বড় মানুষ হিসেবে মহানুভবতার মশাল জ্বেলে চলেছেন। সর্বশেষ তরুণ পেস বোলার শুভাসিসকে যেভাবে ক্ষমা করে দিয়ে উল্টো নিজেও ‘ক্ষমা’ প্রার্থনা করেছেন, তাতে নতুন প্রজন্মের সামনে মাশরাফি আরেকবার অনুকরণীয় আদর্শের উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

বুধবার রাতে রংপুর রাইডার্স ও চট্টগ্রাম ভাইকিংস ম্যাচে একটা ঘটনাকেকেন্দ্র করে এক পর্যায়ে মাশরাফির দিতে তেড়ে যান পেসার শুভাশিস। এ ঘটনায় মূলধারার সব সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হওয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠে। এমনকি শুভাশিসের বিচার দাবি করে ফেসবুকে ইভেন্ট খোলে আন্দোলনের উদ্যোগনেয়া হয়। শেষমেশ, মাশরাফির এক ভিডিও বার্তায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। শুভাশিসও মহা জনরোষের কবল থেকে রক্ষা পান।

ঘটনাটি ঘটে ম্যাচের ১৭তম ওভারে। বল করতে আসেন পেসার শুভাশিস রায়। প্রথমদুই বলে ২ রান আসার পর ওভারের তৃতীয় বলে চার হাঁকান মাশরাফি। মাশরাফির হাতে চার খেয়ে মেজাজ হারান শুভাশিস। তাই চতুর্থ বলটি একটু আগে করার ফেলে মাশরাফি অপ্রস্তুত হয়ে যান। বাধ্য হয়ে রক্ষণাত্মক খেলেন মাশরাফি। এতেও শুভাশিস ক্ষান্ত দেননি। ফিরতি বল ধরে খুব এগ্রেসিভ ভঙ্গিমায় মাশরাফির দিকে বল সজোরে মারতে উদ্যত হওন। এতে মাশরাফিও খানিকটা প্রতিক্রিয়া দেখান। বোলিং মার্কে ফিরে যেতে ইংগিত করেন মাশরাফি। এতে মাশরাফির দিকে আপত্তিকর শব্দ ছুড়ে দিয়ে তেড়ে যান শুভাসিস। তাৎক্ষণিকভাবে অন্য খেলোয়াড়দের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়নি।

মুহূর্তের মাধ্যমে ফেসবুকে ও আড্ডায় মানুষ সমালোচনার ঝড় তোলে। মাশরাফি শুধুমাত্র একজন ক্রিকেটার নন, ক্রমশ দেশের মানুষ তো বটেই, ক্রিকেট খেলিয়ে সব দেশের মানুষের মধ্যেই নিজেকে একজন মহাতারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। মাশরাফি একজন মহাতারকা হওয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা ও সম্মান-শ্রদ্ধার মিশেলে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। ধর্ম-রাজনীতি নির্বিশেষে মাশরাফিকে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে দেশের মানুষ। তাই মাশরাফির সাথে কারো দুর্ব্যবহার দেশের মানুষের সহ্য হওয়ার কথা নয়। মানুষের ভালোবাসা নিশ্চয় মন-মগজ দিয়ে অনুভব ও অনুধাবন করেন মাশরাফি। দেশের মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের লাগাম টেনে না ধরলে শুভাশিসের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা বুঝতে পেরে মাশরাফি মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে দেশবাসীকে শান্ত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।

নিজের ফেসবুক পেইজে একটি ভিডিও বার্তা দিয়ে ‘তুচ্ছ’এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছেনম্যাশ। রাতেই নিজের ফেসবুকে একটি ভিডিওর মাধ্যমে এ আহবান জানান তিনি।

সেখানে মাশরাফি বলেন,‘ আমার কাছে মনে হচ্ছে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।মানুষের কাছ থেকে একটু বেশিই ভালোবাসা পেয়েছি। শুভাশিসও তো জাতীয় দলের হয়েখেলে। ওর তো ভালোবাসা প্রাপ্য। মাঠে যেটা ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত। যেটাম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনেও বলেছি। আমি সিনিয়র। আমার উচিৎ হয়নিওরসঙ্গেএমন প্রতিক্রিয়া দেখানো। শুরুটা আমার কাছ থেকেই হয়েছে। আমি যদি অমনপ্রতিক্রিয়া না দেখাতাম তাহলে হয়তো সে নিজের জায়গায় চলে যেত। আমার জায়গাথেকে আমি দুঃখিত।’

শুভাশিসের প্রতি মমতা দেখিয়ে মাশরাফি আরো বলেন,‘ সে প্রতিশ্রুতিশীলফাস্ট বোলার। অনেক সংগ্রাম করে সে জাতীয় দলে খেলছে। আমিও যেটা করছি। মানুষহিসেবে আমি যতটা সম্মান পাচ্ছি তারও পাওয়া উচিৎ।যেঘটনাঘটেছেএটামাঠেঘটে থাকে। যেটা আমরা সবসময় স্বাভাবিকভাকে নেই। তবে আজ কেন নিতে পারছি না? আমি বুঝতে পারছি না।’

শুভাশিষের কাছে আবারও ক্ষমা চেয়ে মাশরাফি বলেন,‘ আমি ওর কাছে ক্ষমাচাচ্ছি। ও আমার ছোট ভাই। ওকে ওভাবে বলা বা শুরু করা ঠিক হয়নি। তাহলে হয়তোমাথা ঠাণ্ডা থাকতো ওর। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে এখানেই শেষ হোক। সে আমারছোট ভাই, টিমম্যাট। আমরা অবশ্যই এটা ভুলে যাব। আপনারা এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি নাকরলে এখানেই শেষ হয়ে যাবে।’

মাশরাফিকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধরমানুষ বললে ভুল হবে না। দেশের জনপ্রিয় মানুষের তালিকা করলে মাশরাফি উপরের দিকেই থাকবেন। জনপ্রিয়তার চেয়ে বড় ক্ষমতা আর কী হতে পারে? মাশরাফি হাসলে আমরা হাসি, মাশরাফি কাঁদলে আমরা কাঁদি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের আবেগ ধারন করে মাশরাফি মাঠে বল-ব্যাট করেন, দলকে নেতৃত্ব দেন। দেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে মাশরাফিকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন। মাশরাফিও প্রতিটি সুযোগে মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান দেন।

গত বছর একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে, এক ভক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী গলে মাঠে ঢুকে মাশরাফিকে জড়িয়ে ধরতে গেলে, নিরাপত্তা রক্ষীরা সে দর্শককে আটকাতে আসে। মাশরাফি দৌড়ে গিয়ে সে ভক্তকে জড়িয়ে ধরে নিরাপত্তারক্ষীদের হাত থেকে তাকে বাঁচান। পাগল ভক্তকে যেন পুলিশ পরে কষ্ট না দেয়, সেটিও নিশ্চিত করেন মাশরাফি। নিজের ছোট বাচ্চাকে টাইফয়েডে আক্রান্তঅবস্থায় দেশে রেখে দলের সাথে ক্রিকেট খেলতে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন মাশরাফি।

মাশরাফি যখন পায়ের কাপড় মাঝে মাঝে একটু উপরে তোলেন, তখন দেখা যায় কতকিছু লাগিয়ে ক্রিকেট খেলছেন তিনি। দুই হাঁটুতে কমপক্ষে সাতটি অপারেশন হয়েছে মাশরাফির। এরপরেও থেমে যাননি মাশরাফি। বারবারই মাঠে ফিরে বাংলাদেশকে ক্রিকেটে নতুন জীবন দিয়েছেন। শুধু অর্থের জন্য মাশরাফি ক্রিকেট খেলেন না। মাশরাফি জানেন, এই দেশ তাকে চায়, এই জাতি তার উপর নির্ভর করে। মাশরাফি যেন আমাদের সুপারম্যান।

তবু একদিন মাশরাফি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেবেন। ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসাও মাশরাফির বয়স আটকে রাখতে পারবে না। মাশরাফি একদিন বৃদ্ধ হয়ে যাবেন। কিন্তু তার আগে যুবক মাশরাফি এমন কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করে গেলেন, যার মহান বার্তা এদেশের বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতের কোটি কোটি মানুষকে মহানুভব হতে অনুপ্রেরণা দেবে। ক্ষমা করতে পারা মহত্বের লক্ষণ, এমন একটা কথা আমাদের পবিত্র ধর্মেও বলা আছে। মাশরাফির মত আমরাও যদি ক্ষমা করতে শিখতে পারতাম। কী সুন্দর ভাবেই না, মাশরাফি নিজেকে ‘ছোট’ করে ক্ষমা চেয়ে শুভাশিসকে বুকে আগলে নিলেন। আমাদের সমাজে শিক্ষক ছাত্রকে ক্ষমা করতে ভুলে গেছে, মা-বাবাও সন্তানকে ক্ষমা করতে চান না, সন্তানও জন্মদাতা বাবা-মাকে ক্ষমা করতে চায় না। ক্ষমা যেন উঠেই যাচ্ছে সমাজ থেকে। অস্থির সময়ে সবাই সব সম্পর্কে নগদ লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেন। কেউ কাউকে সামান্যতম সময় বা ফুরসাত দিতে চাই না আমরা।

শুভাসিস নিশ্চয় নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। মাশরাফির কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। রাগের মাথায় শুভাশিস ভুল করে ফেলেছেন। আবার বড় ভাই হিসেবে মাশরাফি মাফ করে দিয়েছেন। এমন সুস্থ আচার ব্যবহারই আমরা আশা করি দেশের সমাজ থেকে।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :