‘অসুন্দর’ ঘটনার ‘লজ্জা’য় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
| আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১৪ | প্রকাশিত : ১০ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:০৮

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে এমন সব সংবাদ আসছে যা শিক্ষাবিদ, প্রবীণ শিক্ষক এমনকি শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। পরিস্থিতিকে লজ্জাজনকও বলেছেন কেউ কেউ। শিক্ষকদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলেই এসব ঘটছে বলে মনে করছেন তারা।

গত কয়েক মাস ধরে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা নানা নেতিবাচক ঘটনার সংবাদ আসছে গণমাধ্যমে। সবশেষ শিক্ষক-শিক্ষক মারামারির ঘটনা আলোড়ন ফেলেছে।

এ ছাড়া গবেষণায় চুরি, শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষকের ৫৭ ধারায় মামলা করাসহ গত কয়েক মাসে আরও কয়েকটি ঘটনায় তীব্র সমালোচনা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সাবেক ছাত্ররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলছেন, দেশের প্রধান এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে হচ্ছেটা কী?

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

গত আট বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক হাজার নিয়োগ নিয়ে গণমাধ্যমে নানা প্রতিবেদন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ হয়েছে আদালতে। আদালতের রায়ে নিয়োগ বাতিল হয়েছে-এমন ঘটনাও ঘটেছে।

২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে নয়জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে তিনজনের কোনো স্নাতকোত্তর ডিগ্রিই ছিল না।

এই তিনজন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী আবেদনেরই যোগ্য ছিলেন না।

সাধারণত, শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীর ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে সিজিপিএ ৪ এর মধ্যে ৩.৫০ এবং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫-এর মধ্যে ৪.২৫ থাকতে হবে বলে উল্লেখ থাকে। তবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ৩.৭৫ পাওয়াকেও অনেক সময় মানদণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর কোনো বিভাগে কেউ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকলে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা রেওয়াজ।

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মাস্টার্স শেষ করার পূর্বে কারও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ মাস্টার্স শেষ না হওয়া সত্ত্বেও তিনজনকে শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এই তিনজন হলেন-তানভীর আহমেদ, মো. নূরুস সাকিব ও সজীব বড়ুয়া। এই ঘটনাটি ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নিয়ে প্রতিটি সরকারের আমলেই নানা ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্প্রতি এক সঙ্গে বেশ কিছু সংবাদ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে যা গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

শিক্ষক-শিক্ষকে মারামারি

সর্বশেষ গত ৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের সভায় সহকর্মীদের আঘাতে একজন শিক্ষক আহত হন। এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের দুইপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করে শাস্তির দাবিতে আলাদা মানববন্ধন করেছে।

অভিযোগ পাওয়া যায়, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সমর্থক। নীল দলের একটি সভায় বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে তার উপর হামলা করা হয়। তিনি অভিযোগ করেন, প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী ও তাদের পক্ষের আরও দুই শিক্ষক এই হামলা করেছেন, আঘাতে নাক দিয়ে রক্ত ঝরেছে তার।

এ ঘটনায় প্রক্টর রব্বানীকে পদচ্যুত করার দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নীল দলের আহ্বায়ক আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে নীল দলের একাংশ।

অন্যদিকে প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি যখন বক্তব্য দিচ্ছিলাম তখন জামাল উদ্দিন সামনে বসা চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার বুকে ধাক্কা দেয়। এ সময় তার আক্রমণাত্মক আচরণ দেখে অন্য শিক্ষকরা আমাকে রক্ষা করার জন্য ঘিরে ফেলে। জামাল এ সময় ওই শিক্ষকদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার কাছে আসতে চান। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই। একটু পর জামালকে দেখি এক কোনায় ফ্লোরে বসে আছেন। তখন আমি গিয়ে তাকে উঠিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসাই। এসময় আমি অন্যদের অনুরোধ করি তাকে কিছু না বলার জন্য।

এ ঘটনায় আরেফিন সিদ্দিকের সমর্থন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন বর্তমান উপাচার্য আখতারুজ্জামান সমর্থক শিক্ষকরা।

ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে গা ছাড়া ভাব

অক্টোবরের শেষ দিকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠে। একাধিক গণমাধ্যম পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নের একাংশ পাওয়ার দাবি করে।

কিন্তু শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দুটি তদন্ত কমিটি হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুরুতেই যে ভাষায় অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এই ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। আবার পত্রিকা অফিসে প্রশ্নপত্র পৌঁছে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়কে না জানিয়ে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ নিয়ে উষ্মাও জানিয়েছেন একজন শিক্ষক।

আরও কিছু ঘটনা

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় ‘চৌর্যবৃত্তির’ অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় অভিযোগ তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এনিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি।

গত ১৩ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগের অপর এক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল মনসুর আহম্মদ ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনা নিয়েও বেশ সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে নতুন ভারপ্রাপ্ত ডিন নিয়োগ নিয়েও অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। নতুন ভারপ্রাপ্ত ডিন নিয়োগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থী বলে অভিযোগ করেছেন আগের ডিন অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া।

ঢাবির ১৯৭৩-এর ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চলতি বছরের ২ জুলাই সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় শফিউল আলম ভূঁইয়াকে। সে অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত ডিন হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হবে ৯০ দিন পর অর্থাৎ আগামী ১ অক্টোবর।

শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘নতুন ডিন নিযুক্ত করতে হলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করাটাই আইনসিদ্ধ। কিন্তু তা না করে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক সাদেকা হালিমকে ভারপ্রাপ্ত ডিন নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, ঐতিহ্য ও রেওয়াজ পরিপন্থী।’

ডিন পরিবর্তনের বিষয়ে উপাচার্য আখতারুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনো কারণে ডিনের পদ শূন্য হলে উপাচার্য ৯০ দিন অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে দিয়ে দেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্তের মেয়াদ শেষ হলে সেটা আর উপাচার্য লাগে না, সেটা সিন্ডিকেট দিয়ে দেয়।’

যা বলছেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবার। এই পরিবারে কোনো সমস্যা হলে এর মধ্যেই আলোচনা করে সমাধান করার চেষ্টা করা উচিত।’

এই প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষকদের মধ্যে সমস্যা না হওয়ার কথা। কিন্তু এখন হচ্ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকের উচিত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করা। আর শিক্ষকদের উচিত দায়িত্বশীল আচরণ করা।’

জানতে চাইলে এসব ঘটনাকে ‘অসুন্দর’ বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এ সব ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা লজ্জিত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের ও গবেষণার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নীতি ও নৈতিকতা শেখানোর কথা। সেটাই হওয়া উচিত। তা না করে তারা হানাহানি, মারামারি করছেন। দলীয় রাজনীতি মুখ্য হয়ে উঠছে। এ ঘটনা অশোভন, অসুন্দর।’

এ প্রবীণ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘শিক্ষকরা কোনো দলকে সমর্থন করতে পারেন। তবে সেটি লেখা ও গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরবেন। তাদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা অপ্রত্যাশিত। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকই এটা করেন না। ক্ষমতা পেতে কিছু শিক্ষক এভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, যা আগে ছিল না। শিক্ষকরা হবেন পথপ্রদর্শক।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এসব ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। শিক্ষকদের এমন দলাদলি ও হাতাহাতির ঘটনা উদ্বেগজনক। এমন ঘটনা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক অবক্ষয়ের নজির। ’

এই প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘স্বার্থ-দ্বন্দ্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সমস্যার উৎস মূলে রয়ে গেছে প্রশাসনের অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণ। সরকারি দলের মধ্যেই বিভাজন। এগুলোর সমাধান দরকার। তানাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।’

এসব ঘটনা লজ্জাজনক, মানছেন উপাচার্য আখতারুজ্জামানও। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্ন নানা ঘটনা ঘটছে, এসমস্ত ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে যেন লজ্জাজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

(ঢাকাটাইমস/১০নভেম্বর/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :