নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে ভোগান্তিই ছিল বেশি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৮ | প্রকাশিত : ১০ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৫

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক ঘোষণায় ঠিক এক বছর আগে বাতিল হয়ে গিয়েছিল তখন চালু ৫০০ আর এক হাজার রুপির নোট।

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেয়া সেই ভাষণে মোদি জানিয়েছিলেন যে দুর্নীতি আর কালো টাকার কবল থেকে উদ্ধার পেতে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৮ নভেম্বর মাঝরাত থেকেই চালু ৫০০ এবং হাজার রুপির নোট অবৈধ হয়ে যাবে।

নোট বাতিলের সেই ঘোষণার পরের দিন সকালে গত বছর ৯ নভেম্বর, কলকাতার একটি রেল স্টেশন চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলাম কিছু সাধারণ মানুষের সঙ্গে। সবার গলাতেই সেদিন ছিল উদ্বেগ, যে এবার কি হবে!

কেউ বলেছিলেন আগের দিনই ৫০০ রুপির নোটে মজুরি পেয়েছেন, সেগুলো এক ধাক্কায় বাতিল।

বাজারের এক দোকানি বলেছিলেন আগের দিন তার রোজগার করা ৫০০ রুপির নোটগুলো দিয়ে পরের দিন পাইকারি বাজারে কোনও সবজি কিনতে পারেননি তিনি।

এক বয়স্ক পেনশনভোগী বলেছিলেন, ‘কালো টাকা কি আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে!’

বেশ কয়েকজন আবার বাহবাও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে - ধনীদের কাছে থাকা কালো টাকা উদ্ধারের ওই প্রচেষ্টার জন্য।৯ নভেম্বর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সব ধরনের ব্যাকিং লেনদেন। তারও পরের দিন থেকে একই সঙ্গে শুরু হয়েছিল পুরনো নোট জমা দেয়া, আর অন্য দিকে নতুন নোট জোগাড় করার পালা।

চালু নোটের প্রায় ৮৬ শতাংশই যখন ছিল ওই বাতিল হয়ে যাওয়া নোটগুলি, সেগুলির পরিবর্তন-নোটের যোগান শুধু অপ্রতুল বললেও কম বলা হয় - পরের কয়েক মাস চলেছে দিনরাত নতুন নোট ছাপা আর বিমান বাহিনী দিয়ে সেই নোট দেশের নানা দিকে পৌঁছে দেয়ার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

রিজার্ভ ব্যাংকের দেয়া পরিসংখ্যান দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী প্রসেনজিৎ বসু বলেন, ‘আগের আর্থিক বছরের তুলনায় গতবছর নতুন নোট ছাপাতে আর সেগুলো যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বন্টন করতেই সরকারের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচা হয়েছে।’

‘শুধু তাই নয়, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গিয়ে যে পুরনো নোট জমা দিয়েছেন, তাতে আমানত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তার ফলে রিজার্ভ ব্যাংককে অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হয়েছে।’

‘রিজার্ভ ব্যাংকের তো এই খরচটা হত না যদি নোট বাতিল না হত। কিন্তু এত খরচ করে কালো টাকা উদ্ধারের নাম করে যে আয় করতে পেরেছে, সেটা তার ১০ শতাংশও নয়। তাহলে লাভটা কী হল?’ প্রশ্ন প্রসেনজিৎ বসুর।

বহু মানুষের নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গিয়েছিল সকালে গিয়ে পুরনো নোট ব্যাংকে জমা করে নতুন নোট জোগাড়ের জন্য আবারও লাইনে দাঁড়ানো।

দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হত সেই লাইন - তবুও হয়তো নতুন নোট পেতেন না বহু মানুষ। পরের দিন আবারও অন্য কোনও এটিএম বা ব্যাংকে লাইন দিতে হত।

কলকাতার বেহালা অঞ্চলের বাসিন্দা কল্লোল রায় চৌধুরী সরকারি চাকুরিতে কর্মরত ছিলেন কোচবিহারে।

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে নতুন নোট জোগাড়ের ব্যর্থ চেষ্টার পরে কলকাতা ফিরছিলেন। পথে হুগলীর ব্যান্ডেল স্টেশনের লাগোয়া একটি এটিএমে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যান - আর উঠে দাঁড়াননি।

তার ভাই স্বপন রায় চৌধুরী বলছিলেন, ‘ওই সময়টায় টাকার জন্য ভীষণ চিন্তায় ছিল - কী করে সংসার চালাবে, কী করে ছেলের টিউশন ফি দেবে। বেতন এসে গিয়েছিল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, কিন্তু চেষ্টা করেও তুলতে পারছিল না।’

‘বাড়ি আসছিল ট্রেনে। ব্যান্ডেল স্টেশনের পাশে এটিএমে লাইন ছোট দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল যে টাকা তোলা যাবে ভেবে। সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। অথচ পাশে আরও লোক দাঁড়িয়েছিল, তারা কেউ টাকা তোলার লাইন ছেড়ে এসে ভাইকে একটা ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায়নি।’

কল্লোল রায় চৌধুরী যে সরকারি বিভাগে চাকরি করতেন, সেখানেই তার স্ত্রীকে চাকরি দিয়েছে রাজ্য সরকার।

অনেকেই এখন হিসাব কষছেন যে নরেন্দ্র মোদির ওই হঠাৎ করে ঘোষিত সিদ্ধান্তের ফলে কতটা লাভ-লোকসান হয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি তার ভাষণের শুরুতেই প্রথম যে উদ্দেশ্যটার কথা বলেছিলেন, তা হলো দুর্নীতি বন্ধ আর কালো টাকা উদ্ধার।

অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কতটা উদ্ধার হল কালো টাকা? তার কথায়, ‘কালো টাকার সিংহভাগটাই নগদে রাখা থাকে না। বিদেশি ব্যাংকে অথবা জমি-বাড়ি-গয়নায় বিনিয়োগ করা হয় অধিকাংশ কালো টাকা।’

‘তাই মোট কালো টাকার খুব একটা সামান্য অংশই এভাবে উদ্ধার করা সম্ভব - যদিও আদৌ উদ্ধার করা গিয়ে থাকে সাধারণ মানুষকে এ রকম কষ্টের মধ্যে ফেলেও। কিন্তু বাস্তবতাটা হল বাতিল হয়ে যাওয়া নোটের ৯৯ শতাংশই তো ফেরত এসেছে। তাহলে কালো টাকার সুরাহা হল কোথায়?’ - সরকারের প্রশ্ন।

অধ্যাপক সরকারের একেবারে বিপরীত মত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অম্বুজ মোহান্তির।

তিনি বলেন, ‘শুধু নোট বাতিলকে আলাদা করে দেখলে হবে না। প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করেছেন - জনধন যোজনা, নোট বাতিল, জিএসটি চালু করা, বেনামী সম্পত্তি রোধ আইন। জনধন যোজনায় যে কয়েক লাখ নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, সেখানে নোট বাতিলের পরে প্রচুর টাকা জমা পড়েছে।’

‘নিজের চেনা পরিচিত বা কর্মচারীদের জনধন যোজনা অ্যাকাউন্টে নোট বাতিলের পরে টাকা রেখেছেন অনেকে। ১৮ লাখ এ রকম সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত হয়েছে। আয়কর দপ্তর সবাইকে নোটিশ পাঠাচ্ছে। এর ফলে কালো টাকার হদিসও যেমন পাওয়া গেল, তেমন কালোবাজারির সন্ধানও পাওয়া গেল।’

অধ্যাপক মোহান্তি আরও একটা বিষয়ের উল্লেখ করছিলেন, অর্থনীতিতে নগদের যোগান কমানো হবে, বৃদ্ধি করা হবে ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের মতো প্লাস্টিক মানি, ই-ওয়ালেট প্রভৃতি - সেটাও নোট বাতিলের একটা উদ্দেশ্য ছিল।

পরিসংখ্যান বলছে, নোট বাতিলের ঠিক পরে নগদ অর্থের যোগান কম থাকায় মানুষ কার্ড বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন বাড়িয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এখন তা মোটামুটিভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।

কলকাতার এক ওষুধের দোকান মালিক অশোক সরকার কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেনের বন্দোবস্ত করেছিলেন নোট বাতিলের পরে।

তার কথায়, ‘গত নভেম্বরেই ই-ওয়ালেট আর কার্ড পাঞ্চিং মেশিন লাগিয়েছি। প্রথম কয়েকমাস মানুষের হাতে নগদ ছিল না, তাই প্রতিমাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকার মতো কার্ড পাঞ্চিং হত। কিন্তু এখন তো নগদের যোগান স্বাভাবিক, তাই কার্ডে হাজার দশেক টাকার মতো বিক্রি হয়।’

এ তো গেল যাদের হাতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট বা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের মতো আধুনিক লেনদেনের সুযোগ আছে তাদের কথা।

কিন্তু অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসুর কথায়, সিংহভাগ মানুষ যে দুটি ক্ষেত্রে জড়িত, সেগুলির অবস্থা সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ীই বেশ চিন্তাজনক।

‘নোট বাতিলের পরের ছয় মাসের তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে যে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে গেছে। বিশেষত যে দুটি ক্ষেত্রে সর্বাধিক মানুষ নিযুক্ত, সেই কৃষি আর উৎপাদন ক্ষেত্রদুটিতে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন।’

‘আবার ব্যাংকগুলি শিল্পক্ষেত্রকে যে ঋণ দেয়, সেটার বৃদ্ধির হার নেগেটিভ হয়ে গেছে। এর থেকেই বোঝা যায় নোট বাতিলের কী প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপরে পড়েছে’- বলছিলেন বসু।

শুধু পরিসংখ্যান নয়, কলকাতার কয়েকজন পথচলতি মানুষও বলছিলেন একই কথা।

তবে অধ্যাপক অভিরূপ সরকারের কথায়, নোট বাতিলের ঘোষণাকে শুধুই অর্থনীতির মাপকাঠিতে বিচার করা অনুচিত - কারণ আদতে সেটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত।

‘ওপরে ওপরে একটা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হলেও এটার পেছনে আসলে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। দুর্নীতিবাজ লোকদের ওপরে সাধারণ মানুষের রাগ আছে, বিজেপি সেই রাগটাকেই ব্যবহার করেছে। গরিব মানুষ দেখছে টাকা বাতিল হলে সবথেকে বেশী অসুবিধায় পড়বে বড়লোকেরা।’

‘আমাদের সরকার তার মানে গরিবেরই সঙ্গে আছে - এটাই তারা ভেবে নিয়েছে। এই রাজনৈতিক খেলাটা শর্টরানে অবশ্যই কাজ করেছে – উত্তর প্রদেশের ভোটই তার প্রমাণ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, যখন গরিবের পেটেও টান পড়বে, তারাও কাজ হারাবে, তখন কিন্তু সেই রাজনৈতিক লাভ পাওয়া কঠিন হবে বিজেপির পক্ষে’- বলছিলেন অধ্যাপক সরকার।

আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার যে কমেছে, সেটা স্বীকার করলেন কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত সমর্থক অধ্যাপক অম্বুজ মোহান্তিও।

একই সঙ্গে তার মত, ‘ডিপ্রেশান তো হয়েছে ঠিকই। কিন্তু নোট বাতিলের ঠিক পরের কোয়ার্টারে নয়, এই আর্থিক বছরের প্রথম দুই কোয়ার্টারে ডিপ্রেশান হয়েছে। কিন্তু নোট বাতিলটাই তার একমাত্র কারণ নয়।’

‘আর অন্য দিকে, কোনও কিছুই কি এমনি পাওয়া যায়? এতো বড় একটা কাজ করা হল, আর সব কিছুই একদম ঠিক চলবে সেটা কি আশা করা যায়? এর ফল পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে’- বললেন মোহান্তি।

লাখ লাখ ভারতীয় ইতিমধ্যেই কষ্ট করেছে। হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন নানা ক্ষেত্রে - দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে কখন নতুন নোট পাওয়া যাবে।

অপেক্ষা করছে এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া কল্লোল রায় চৌধুরীর দশ বছর বয়সী পুত্র, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র শুভদীপও।

তার কাকা স্বপন রায় চৌধুরী বলছিলেন, ‘ও এখনও বোঝে না যে ওর বাবা নেই। ভাবে বাইরে চাকরি করে, ফিরবে নিশ্চয়ই। অপেক্ষা করে আছে।’

‘নোট বাতিলের ফলে কার কী উপকার হয়েছে বলতে পারব না, কিন্তু আমার পরিবারটা বিপর্যস্ত হয়ে গেল।’

(ঢাকাটাইমস/১০নভেম্বর/এসআই)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটগ্রহণ শেষ 

ইরানে হামলায় অংশ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র: ব্লিঙ্কেন

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই: ইরানি কর্মকর্তা

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় বিশ্ববাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম

ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়ার প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো

ইরানে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্কবার্তা দিয়েছিলো ইসরায়েল: মার্কিন কর্মকর্তা

পাকিস্তানের জাপানি নাগরিকদের গাড়ি লক্ষ্য করে আত্মঘাতি বোমা হামলা, হতাহত ৫

ইরানে প্রধান বিমানবন্দরে পুনরায় ফ্লাইট চালু

৩টি ইসরায়েলি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান

ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলের

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :