সাহসী দার্শনিকের জন্য অবশেষে পুলিশ

আলম রায়হান
| আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০৪ | প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৮

বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা সাহসী হন; এ সাহসে অনেক ঝুঁকিও থাকে। আর ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কোন কথা বললে এ ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। এমনকি সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে- প্রচলিত এ ধারনার বিপরীত কথা বলায় প্রাণনাশের উদাহরণ আছে; সক্রেটিসকে হেমলক পানে আত্মহননে বাধ্য হবার বিষয়টি বহুল প্রচারিত ঘটনা। প্রায় একই ধরনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য উদঘাটনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বরিশালের এক অজপাড়া গায়ে জম্ম নেয়া দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। তাকে সবচেয়ে বেশি সাহসী দার্শনিক বললে অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। কারণ, তিনি যেসব প্রশ্ন তুলেছেন তা প্রায় সবই ছিলো প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস এবং আচার-অনাচারের বিপরীতে।

আশার কথা হচ্ছে, এরপরও তাকে কেউ হত্যা করেনি। এজন্য আইনি হয়রানির শিকার হতে হলেও তাকে এলাকা বা দেশ ছাড়তে হয়নি। তিনি প্রমাণ করেছেন, দার্শনিকদের কেবল জ্ঞান পিপাসু হলে হয় না, পাশাপাশি বিরাজমান বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখতে হয়। এদিকে তাঁর গ্রামের সাধারণ মানুষও শ্রদ্ধার পাত্র গভীর বিশ্লেষণে।

দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই। জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাস নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমণ্ডলে আবদ্ধ হলে চলে না। সীমাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।” জ্ঞান আহরণের পাশাপাশি আরজ আলী মাতুব্বর বিশেষভাবে ভেবেছেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুর্ভোগ এবং সে সম্পর্কে মানুষের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও সমাজে অধিপতিদের চিন্তা নিয়ে। সাধারণ-অসাধারণ সকলেই দুর্ভোগ আর অপমানকে যুক্তিযুক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। ধরেই নেয়া হয়, এসব কিছুই কপালের লিখন; খণ্ডানোর উপায় নেই!

কিন্তু বদ্ধমূল এ ধারনার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন আরজ আলী মাতুব্বর। এ বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়েই তিনি ক্রমশঃ অধিকতর দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন।

উল্লেখ্য, দরিদ্র-অনাহার-অসুস্থতা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্গতি-ধর্মান্ধতা ইত্যাদি আরজ আলী মাতুব্বরকে বাইর থেকে দেখতে হয়নি। তিনি এর মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন, বসবাস করেছেন। এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে করতে তিনি প্রচলিত বিশ্বাস থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন। এই আরজ আলী মাতুব্বরের ভক্ত ছিলাম কিশোর বয়স থেকে। কিন্তু বাড়ির পাশে আরশি নগরের মতো তার পূণ্যভূমি দেখার সুযোগ হয়নি যথাসময়ে। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে মক্কার লোক হজ না পাবার প্রবচনের সাথে মেলানো যায়। ঘটনাচক্রে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেলাম গত অক্টোবর মাসে।

কথিত সংখ্যালঘুদের সামনে রেখে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন মোকাবিলা এবং বাবার অসুস্থতার কারণে গত কয়েক মাস ধরে আমাকে ঘনঘন বরিশাল যেতে হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় গত অক্টোবর মাসে বরিশাল ছিলাম। এ সময় ১৬ অক্টোবর বিকালে বরিশাল মহানগরীর পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়িতে যান একটি টিম নিয়ে। এ টিমে অন্যদের সঙ্গে ডিবিসি’র বরিশাল জেলা প্রতিনিধি অপূর্ব অপু ও আমিও ছিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা আমরা ছিলাম অমর এই দার্শনিকের পূণ্যভূমিতে। এ সময় তিনিটি বিষয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। এক. দার্শনিকের প্রতি এলাকাবাসীর প্রগার শ্রদ্ধা। দুই. ক্ষণজম্মা দার্শনিকের প্রতি একজন পুলিশ কর্মকর্তার পরম মমতা। এবং তিন. একটি রিপোর্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে একজন জেলা প্রতিনিধির একাগ্রতা ও অক্লান্ত পরিশ্রম।

বরিশাল মহানগরীর পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিনের লক্ষ্য হচ্ছে, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের ধ্বংসপ্রায় ঘরটি সংস্কার করে যতটা সম্ভব আগের রূপ দেয়া। যাতে অমর এ দার্শনিকের স্মৃতি ধরে রাখা সহজ হয়। এ জন্য সহযোগিতা করতে আগ্রহী মানুষ পাবার পর তিনি দার্শনিকের বাড়িতে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন গবেষক ও আর্কিটেক। কিন্তু বিষয়টি তিনি প্রচারণার ছকে ফেলেননি। অথচ যা ছিলো একজন পুলিশ কমিশনারের জন্য খুবই সহজ কাজ। তবে তিনি যে কাজটি হাতে নিয়ে সফল হতে চলেছেন তা মোটেই সহজ ছিলো না। বিষয়টি ফেসবুকে তার পোস্ট থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়।

১৭ আক্টোবর তিনি পোস্ট দিয়েছেন, “দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর এর কথা সম্ভবত আমরা সবাই কম বেশি জানি। বরিশাল জেলার সদর উপজেলার লামচরি গ্রামে তার স্মৃতিময় বসত ঘরটি ভেঙে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন থেকেই ভাবছিলাম এটি কিভাবে সংস্কার করা যায়। অনেকের সাথেই কথা বললাম। বিশেষ সুবিধা হচ্ছিল না। অবশেষে সহযোগিতা করতে আগ্রহী মানুষ পাওয়া গেল। আজ সরেজমিন পরিদর্শন শেষে চূড়ান্ত হলো পরিকল্পনা। অচিরেই কাজ শুরু হচ্ছে। আশা করছি, বিস্মৃতিতে হারাবেন না এদেশের মুক্ত চিন্তর অগ্রদূত, স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুববর।’

পুলিশ কমিশনার এস এম রুহুল আমিন যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা আরো অনেক আগে অনেকেরই নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু উচিত কাজটি হয়নি এতো দিন। শেষতক পুলিশ কমিশনারের উদ্যোগ দার্শনিকের স্মৃতিজড়িত ঘরটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসবে; এটি কম আশার কথা নয়। হয়তো এ উদ্যোগের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হবেন আরো অনেকে; অথবা কেউ কেউ। এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও উদ্যোগ প্রত্যাশা করলে সেটি খুব বেশি করা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, আরজ আলী মাতুব্বর এক ক্ষণজম্মা দার্শনিক এবং আমাদের মাটিতে জম্ম নিয়ে আমাদের ধন্য করেছেন।

আরজ আলী মাতুব্বর কেবল দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন জনসম্পৃক্ত মানুষও। গ্রামীণ জগতে মানুষের প্রয়োজনে এবং দৈনন্দিন কাজ ও সমস্যা সমাধানের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। এ সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর জীবন ও জীবিকা। তিনি আমিনের কাজ করতেন। গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য তিনি স্বল্প খরচের চুলাও তৈরি করেছিলেন। আমিন হিসেবে আরজ আলী খুবই নিখুঁত ছিলেন। শুধুমাত্র তাঁর জন্য বহু মানুষের জীবন বেচেছে। বহু সংঘাত আর খুনোখুনির হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে মানুষ। কাজের দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণে শুধু নিজ গ্রাম নয়, আশপাশের একটি বড় অঞ্চলজুড়ে তাঁর একটি গণভিত্তি তৈরি হয়েছিলো। এ জনম্পৃক্ততার কারণে অনেক প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রথা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনে তাঁকে শক্তি যুগিয়েছে। নাস্তিক বলে কেউ কেউ কোণঠাসা করার চেষ্টা করলেও তাঁকে খুব একটা ঘায়েল করা যায়নি। এমনকি আশপাশের পীর, ধর্মীয় নেতারাও তাঁর বিরুদ্ধে কখনও ফতোয়া জারি করেননি।

দার্শনিক আরজ আলী যেকোন বিষয় নিয়ে সবার সঙ্গেই আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি উন্মুক্ত ছিলেন, যুক্তি দিয়ে তাঁর প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিলে তিনি তা গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হতেন না। এ কারণেই তিনি জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী হননি, তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন না। যদিও “স্থানীয় বিশেষ সমাজে” তিনি দীর্ঘদিন “অবহেলিত ও তিরস্কৃত” হয়েছেন। কিন্তু তিনি আক্রান্ত হননি জনসম্পৃক্ততার কারণে।

জ্ঞানচর্চার জন্য জ্ঞান আহরণ জরুরি বিষয়- এ বোধ ছিলো আরজ আলী মাতুব্বরের খুবই টনটনে। যে কারণে তিনি প্রচুর পড়তেন। এ ক্ষেত্রেও প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা ছিলো। নিজের নামে পাননি বলে অন্যের নামে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়েছেন। বই পড়া নিয়ে নিজে তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এক পর্যায়ে তিনি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ওয়ারিশদের বুঝিয়ে দিয়ে কাজ করেছেন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি নিজেই বলেছেন, “দিনমজুরি করেছি মাঠে মাঠে আমিনগিরি রূপে।...টাকা আমার নেই। আর জীবিকা নির্বাহের জন্য আমার টাকার প্রয়োজনও নেই।” নির্মাণের খরচ কমানোর জন্য লাইব্রেরি নির্মাণে শারীরিক অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। তার উচ্চারণ, “বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই। জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়; তা হচ্ছে লাইব্রেরি।”

লাইব্রেরি নির্মাণ করতে গিয়ে তিনি বহু মানুষের কাছে হাত পেতেছেন, সহযোগিতা চেয়েছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলো না। যেমন সুখকর নয় তার ধ্বংস প্রায় ঘর পুননির্মাণের পুলিশ কর্মকর্তা এস এম রুহুল আমিনের উদ্যোগের অভিজ্ঞতা। লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দার্শনিক আরজ আলী তাদের কাছ থেকে বেশি সহায়তা পেয়েছেন যাদের সঙ্গতি ছিলো কম। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে স্থানীয় বিত্তবানদের আমি সহানুভূতি পাইনি। তবে মজুরদের সাহায্য পেয়েছি প্রচুর।....তারা তাদের মজুরির অর্ধেক নিয়ে আমার লাইব্রেরির নির্মাণ কাজ সমাধা করেছেন। কাজেই এ গ্রামের মজুরদের কাছে আমি ঋণী, হুজুরদের কাছে নয়।”

এ লাইব্রেরি যাতে তার মৃত্যুর পরও টিকে থাকে সেজন্য তার পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন। লিখিতভাবে তহবিল, লাইব্রেরি ও যাবতীয় অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা জানিয়ে গেছেন। গ্রন্থের প্রতি আরজ আলীর ছিলো অপ্রতিরোধ্য আগ্রহ। ডিগ্রি লাভে তার কোন আগ্রহই ছিল না। কারণ মক্তবের পর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এদেশের অধিকাংশ মানুষের মতোই, তাঁরও প্রবেশাধিকার কার্যত ছিল না।

ছোটবেলা থেকেই কাজ করেই তাঁর বই সংগ্রহ এবং পড়া। ডিগ্রি লাভের জন্য অবশ্য বই খুব বেশি দরকারও হয় না, চারপাশে দেখি, অনেক সময় ডিগ্রি-পিপাসু ব্যক্তিদের বই-এর প্রতি, বিদ্যাচর্চার প্রতি এক সীমাহীন বিকর্ষণ তৈরি হতে পারে। মানুষের মনের মধ্যে ছোট-বড় ডিগ্রির অল্পশিক্ষা-কুশিক্ষা এমনই জমাট বেঁধে বসে যে সব কৌতূহল, জগত-মানুষ-সমাজ সম্পর্কে সব প্রশ্ন বিলুপ্ত হতে পারে। এর বিপরীত অবস্থানে ছিলেন দার্শনিক আরজ আলী।

আরজ আলী মাতুব্বরের গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। পরে এক মক্তব হয়। সেখানে তিনি কিছুদিন পড়েছেন। কিন্তু বই খাতা কেনার পয়সা ছিলো না। ভাঙাচোরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে গেলেও পয়সা লাগে, পরিবারের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন হতো সে সময়ও। যা ছিল না বলে ‘মেধাবি ছাত্র’ বলে পরিচিত হবার কোন সুযোগ তিনি পাননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগের বাইরে থেকেই তাঁর বিদ্যাচর্চা করতে হয়েছিল। সেজন্য তাঁর শৈশবের সবচাইতে আনন্দদায়ক ও রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল এক জ্ঞাতিচাচার কাছ থেকে দু’আনা দামের একখানা আদর্শলিপি বই পাওয়া। নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলছেন, “সেদিন আমি যে কতটুকু আনন্দ লাভ করেছিলাম, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না। সেদিনটি ছিলো আমার জীবনের সর্বপ্রথম বই হাতে ছোঁয়ার দিন। তাই আনন্দ-স্ফূর্তিতে আমার মনটা যেনো ফেটে যাচ্ছিলো। আমি বইখানা হাতে নিয়ে নৃত্য করতে করতে গিয়েছিলাম প্রতিবেশীর বাড়িতে সহপাঠীদের বইখানা দেখাতে। ...সারাক্ষণ পড়তাম ও সাথে সাথে রাখতাম।...কিন্তু আমার সে সাধের সম্পত্তিটুকু রক্ষা করতে বিষাদ দেখা দিলো বর্ষাকালে।...চালে বৃষ্টির পানি মানায় না। ...অল্প বৃষ্টির সময় যেখানে রাখতাম, বৃষ্টি বেশি হলে সেখান থেকে সরাতে হতো, অত্যধিক বৃষ্টি হলে কোথাও স্থান পেতাম না, তখন উপুড় হয়ে বইখানা রাখতাম বুকের নীচে।”

আমাদের সমাজের অসংখ্য মানুষের এ ধরনের অভিজ্ঞতা অভিন্ন হলেও এই লড়াইয়ে টিকে থাকার এবং ফলাফলের অভিজ্ঞতায় আরজ আলী মাতুব্বর ইউনিক। কঠিন জীবন সংগ্রাম এবং অভাব অনটন তাঁর পুস্তক প্রীতি আর কৌতূহল শেষ করতে পারেনি। আদর্শলিপি পাবার সাত বছরের মাথায় অনটনের মধ্যেও তিনি ‘পুঁথি-পুস্তক’ সংগ্রহ শুরু করেন। ১৮ বছরে তিনি বই সংগ্রহ করেছিলেন ৯০০টি। কিন্তু বই রাখার আলমারি ছিল না, কেনার সাধ্যও ছিল না তার। সেজন্যই এক ঘূর্ণিঝড়ে দুর্বল ঘরের সঙ্গে বইগুলোও উড়ে যায়। উন্মাদের মতো চেষ্টা করেছিলেন বহু বছরে বহু কষ্টের সংগ্রহ পুনরুদ্ধারের। কিন্তু লাভ হয়নি। তিনি লিখেছেন, “পরের দিন পথে-প্রান্তরে পেয়েছিলাম দু’চারখানা ছেঁড়া পাতা। মাতৃশোকে আমি কাঁদিনি, কিন্তু বইগুলোর দুঃখে সেদিন আমার যে কান্নার বান ডেকেছিলো, তা আমি রোধ করতে পারিনি।”

ধর্ম নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বরের ভাবনা ও গবেষণা, সর্বোপরি প্রশ্ন উত্থাপন কোন পরিকল্পিত বিষয় ছিলো না। ভেতরকার মেধা এবং নিজের জীবনে নানান আঘাত তাকে এ পথে নিয়ে যায়। তাকে নানান প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়; এ সব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেছেন তিনি আমৃত্যু। তবে তাঁর আলোচনা, প্রশ্ন, দার্শনিক বিশ্লেষণ কেবল ধর্ম গ্রন্থ নিয়ে ছিলো না। তবে এ ব্যাপারে তার বিশেষ মনোযোগ ছিলো। ধর্মগ্রন্থ বা ধর্ম মানুষের মধ্যে কীভাবে উপস্থিত তাকে নিয়েই আরজ আলী মাতুব্বর বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। যিনি সবকিছুর মধ্যে মানুষের শৃঙ্খলা উপলব্ধি করেছিলেন এবং তার থেকে বের হবার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলেন তিনি আমাদের মাটির দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর।

কেবল জীবদ্দশায় নয়, মৃত্যুর পরও যাতে মানুষের কাজে লাগে সে ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। মৃতদেহ দান করেছেন বরিশাল মেডিকেল কলেজে, চক্ষু দিয়েছেন চক্ষুব্যাংকে। পূজনীয় গুরু, তোমার চরণে আমার সালাম।

আলম বায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :