শিক্ষামন্ত্রী একা প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পারবেন না

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০১৭, ২১:২৫

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের উপর সাধারণ মানুষের রাগ-ক্ষোভের শেষ নেই। পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত নানা অভিযোগের তীর সর্বদাই শিক্ষামন্ত্রীর দিকে ছুটছে। চলমান জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ কোনো কোনো কেন্দ্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের সন্দেহজনক চলাফেরা,ও কর্মকাণ্ডের ছবি গণমাধ্যমে আসায় নতুন করে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের কথা বলছেন ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।

শিক্ষামন্ত্রীর উপর মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সিলেবাস নিয়ে বিতর্ক, নানা পর্যায়ের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ নানা কারণে মন্ত্রীর উপর ক্ষোভ ঝেড়ে চলেছেন সাধারণ মানুষ। সরকারের বিরোধী পক্ষকে সাপোর্ট করে এমন মানুষ নয়, ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মন্ত্রীর ‘ব্যর্থতায়’ ক্ষুব্ধ হয়ে অফিসিয়ালি-আনঅফিসিয়ালি নানা কথা বলেন। অনেকের বিশ্বাস, মন্ত্রী পদ ছেড়ে দিলেই বুঝি প্রশ্নফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে। আসলে কী তাই?

জেএসসি বা এসএসসি পরীক্ষার মত পাবলিক ইভেন্টের কথায় পরে আসছি। স্কুলের অভ্যন্তরীণ নানা পরীক্ষার প্রশ্ন যে কোনো কোনো শিক্ষক, অভিভাবকদের যোগসাজশে ফাঁস করে দিচ্ছেন, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি? এমনকি ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের খুশি করার জন্য শিক্ষকরা প্রশ্ন এনে দিয়ে দিচ্ছে; এর সুরাহা কী?

চলমান জেএসসি পরীক্ষার কিছু চিত্র ইতোমধ্যেই নাগরিক ও মূলধারার সাংবাদিকতার হাত ধরে জনসম্মুখে এনেছে কোনো কোনো গণমাধ্যম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে কয়েকজন শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে নিয়ে ফাঁস করে দিয়ে দিয়েছেন তার কিছু চিত্র ‘নাগরিক সাংবাদিক’ আনিস জামান পিপুর মোবাইল ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আনিস জামান গত ৯ নভেম্বর স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে বন্ধুদের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যান সকাল ৭ টায়। ঘণ্টা দেড়েক পরে তিনি কী দেখতে পেয়েছেন তা নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’ পেইজে।

সেখানে তিনি ছবিসহ পোস্টে লিখেছেন, “ইন্টার-ডিপার্টমেন্ট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং নিজ ব্যাচের খেলা চলার সুবাদে, দর্শক হিসেবে আজ সকাল ৭ টায় ‘জাহাঙ্গীরনগর স্কুল ও কলেজ মাঠ প্রাঙ্গনে হাজির হই। খেলা ৮:৩০ ঘটিকা নাগাদ গড়াতে না গড়াতেই শুরু হয় বিভিন্ন স্কুল থেকে জে,এস,সি পরীক্ষার্থী বহনকারী বাসের আগমন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, একজন শিক্ষক ৩ জন ছাত্রীকে বাসগুলোর পেছনে নিয়ে যান! সন্দেহ হওয়াতে ছুটে যেয়ে দেখি, তিনি তার এন্ড্রয়েড ফোনটি বের করে, দেখে দেখে বলে দিচ্ছেন একের পর এক অবজেক্টিভ প্রশ্নের উত্তর! এভাবে তিনি একটু পর পর কয়েকজন করে পরীক্ষার্থীদের নিয়ে যেয়ে বলতে থাকেন সবগুলো উত্তর!

তিনি শুধু একাই নন, অন্য বাসগুলো থেকেও কয়েকজন শিক্ষক একই কাজ করতে থাকেন! আমি আরও অবাক হলাম, যখন দেখতে পেলাম, কিছু অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের নিয়ে একইভাবে, ফোন দেখে উত্তর মুখস্ত করাতে থাকেন! হঠাৎ দেখলাম, প্রায় সকল শিক্ষার্থীর হাতে বইয়ের বদলে, এন্ড্রয়েড ফোন! শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নেয়ার বদলে, শিক্ষার্থীরা নকল বা চিটিং করায় ব্যাস্ত ছিল’!

এই যদি হয় দেশের শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার অবস্থা, তাহলে শিক্ষামন্ত্রী একা কী করে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাবেন? দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে সর্বত্র। এক শ্রেণির শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মায়েরা মিলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বনাশা অনিয়মে মেতেছেন। সবাই যে যার জায়গায় সৎ থাকলে, নীতিতে অটল থাকলে প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।

প্রশ্ন ফাঁস করে কারা? এর উত্তর পেতে হলে আগে জানতে হবে প্রশ্ন তৈরি করেন কারা? প্রশ্ন তৈরিতে নিশ্চয় বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান একটা কমিটি করে দেন। সে কমিটিতে শিক্ষক-কর্মকর্তারা থাকেন। খুব গোপন এসব প্রশ্নপত্র কীভাবে একেবারে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে চলে আসে, এটি বের করতে পারলেই তো প্রশ্নফাঁসের রাস্তার খবর পাওয়া যায়। বোর্ডের চেয়ারম্যানদের তত্ত্বাবধানে প্রশ্ন তৈরির পর নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছানো হয়। এসব প্রশ্নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র প্রধান ও তাঁর সহকর্মীদের হাতেই থাকে। কেন্দ্র থেকেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বলে অনেক গণমাধ্যমে খবর এসেছে। কেন্দ্র থেকে একশ্রেণীর শিক্ষকই যে প্রশ্ন ফাঁস করে দিচ্ছেন সেটি বলা বাহুল্য। যেনতেন উপায়ে সন্তানের ‘ভালো’ রেজাল্ট নিশ্চিত করতে গিয়ে অভিভাবকদের একটা অংশ নগদ অর্থ নিয়ে শরণাপন্ন হচ্ছেন সেসব দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষকের। সন্তানের ভালো করতে গিয়ে নিজ সন্তানসহ জাতির সর্বনাশ করছেন এসব অভিভাবক। সন্তানদের পক্ষ থেকেও কোনো বাধা আসতে দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের একটা অংশ সম্মিলিত প্রয়াসে দুর্বৃত্তায়ন ঘটছে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থায়।

এভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের পর্যায়ে দুর্নীতি-অনিয়ম হলে শিক্ষামন্ত্রী একা কী করবেন? একা বললেও শিক্ষামন্ত্রী আসলে তো একা নন। বিশাল মন্ত্রণালয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বহর, প্রশাসনিক ক্ষমতার শক্তি যদি কাজে লাগানো হত তাহলে হয়ত সাধারণ মানুষ শিক্ষামন্ত্রীর উপর তাদের রাগ ও ক্ষোভ কমাতেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিটি কেন্দ্রে মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা করতে পারে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করতে পারে অসাধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য। শিক্ষকদের উপর মনিটরিং বাড়াতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো যেতে পারে কেন্দ্রের চারপাশে।

প্রশ্ন ফাঁস হয়ে নানা ডিজিটাল উপায়ে পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে পরীক্ষার আগে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখছে। শিক্ষার্থীদের এক ঘণ্টা আগে পরীক্ষার হলে পৌঁছানোর নিয়ম করা যায়। হলে কোনো ধরনের মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া যায় না। তদ্রুপ প্রশ্ন-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের যেখানে সেখানে মোবাইল ফোন বহন করার উপর কড়াকড়ি আরোপ করা যায়। যে কোনো উপায়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতেই হবে। না হলে এ জাতি জীবনেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :