সিটিং সার্ভিস: বাস মালিকদের আপত্তিতে আটকা নীতিমালা

প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১৭

এম গোলাম মোস্তফা, ঢাকাটাইমস

রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস নিয়ে যে নীতিমালা প্রস্তাব করেছে বিআরটিএর কমিটি, তা মানতে রাজি হচ্ছে না পরিবহন মালিক সমিতি। তাদের বাধার কারণে নীতিমালা ঘোষণা ও বাস্তবায়ন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাস মালিকদের কৌশলের কারণে পকেট কাটার সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে আসতে হয়েছে সরকারকে। আর গত মে মাসে এ নিয়ে নৈরাজ্যের পর তিন মাসের মধ্যে নীতিমালা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলা হয়।

সে খসড়া নীতিমালা করেছেও সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ। এতে রাজধানীতে সীমিত আকারে বৈধভাবে সিটিং সার্ভিস চালুর সুপারিশ করা হয়।

নীতিমালার মধ্যে রয়েছে, একটি কোম্পানির সব বাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে না চালিয়ে কিছু বাস সিটিং হিসেবে চালানো; সরকার থেকে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া ঠিক করে দেওয়া, একটি রুটকে কয়েকটি স্ল্যাবে ভাগ করে স্ল্যাবভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ, সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোকে আলাদা রংয়ের করে এসব বাসের জন্য সীমিত সংখ্যক স্টপেজ দাঁড়ানোর সুপারিশ করা হয়। কোন কোম্পানির কতগুলো গাড়ি সিটিং হিসেবে চলাচল করবে, তা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির হাতে দেওয়ার কথা বলা হয় এই নীতিমালায়। আইন অমান্য করলে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করার কথাও বলা আছে আইনে।

পরিবহন মালিকরা এই জরিমানার অংক নিয়েও সংশয়ে আছেন। প্রধানতা এত বিপুল পরিমাণ জরিমানার কথা ভেবেই তারা খসড়ার বিরোধিতা করছেন।

মূলত বাস মালিকদের বিরোধিতার কারণেই এই নীতিমালা চূড়ান্ত করে এখনও ঘোষণা করা যাচ্ছে না। গত ২৫ অক্টোবর সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘোষণা করা হবে সিটিং সার্ভিস নিয়ে নীতিমালা। কিন্তু দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ঘোষণা হয়নি তা।

সিটিং সার্ভিস বলে আলাদা কোনো সার্ভিস নেই আইনে। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কৌশল হিসেবে রাজধানীতে বাস মালিকরা এই সেবা চালু করে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ, তখনও তিনগুণ বা তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করছে।

গত মে মাসে বিআরটিএ এভাবে অবৈধভাবে সিটিং হিসেবে বাস চলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু মালিকরা পাল্টা কৌশল নিয়ে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেয়া, যাত্রীদের ‘শায়েস্তা করতে’ বাসে মাত্রাঅতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, মোড়ে মোড়ে অযথা বিলম্বসহ নানা কৌশল নেয়। আর এক সপ্তাহ এভাবে চলার পর অভিযান বন্ধ করে বিআরটিএ। তখন তিন মাসের মধ্যে নীতিমালা করার ঘোষণা দেয়া হয়।

এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় বিআরটিএর একটি কমিটিকে। তিন মাসে না পারলেও তারা সেই নীতিমালার খসড়া করে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে তা জমা দিয়েছে। আর এই নীতিমালা করতে বাস মালিক সমিতি ছাড়াও যাত্রীদের পক্ষ থেকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে তারা। কিন্তু মালিক সমিতি এটা মানতে না চাওয়ায় এই নীতিমালার বাস্তবায়ন নিয়ে খোদ বিআরটিএতেই সংশয় আছে।

ওই কমিটিতে কাজ করা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, ‘বাস মালিকরা কতটা শক্তিশালী সেটা গত মে মাসে তারা দেখিয়ে দিয়েছেন। রাজধানীতে গণপরিবহন ব্যবস্থায় সরকারি সংস্থার ভূমিকা সীমিত। এই অবস্থায় বাস মালিকরা আইন মানতে চান না। কাজেই এই নীতিমালার কী হবে আর হলেও বাস মালিকরা কতটা মানবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।’

বাস মালিক সমিতির বক্তব্য

বিআরটিএর সিটিং সার্ভিস বিষয়ে নীতিমালা নিয়ে খুশি নয় সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তারা একে ‘ভুলে ভরা খসড়া’ বলছে। কথিত ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করে আইনমন্ত্রীর সাথে বসার কথা বলছেও সংস্থাটি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস নিয়ে যে খসড়াটা আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল সেখানে অনেক ভুলভ্রান্তি ছিল। ওই খসড়ায় অনেক সাংঘর্ষিক বিষয় আছে, সেই বিষয়গুলি ঠিক করে আমরা আইনমন্ত্রীর সাথে বসব।’

তবে বসবেন-এমন প্রশ্নে মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘আইনমন্ত্রী যখন সময় দেবেন তখনই আমরা বসব।’

তবে নীতিমালার কোন বিষয়গুলো নিয়ে আপত্তি, সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘নীতিমালায় অনেক সাংঘর্ষিক বিষয় আছে তা বিআরটিএর ওয়েবসাইটে আছে পড়লেই বুঝতে পারবেন।’

তবে মালিক সমিতির প্রধান আপত্তি যে আইন অমান্যে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান নিয়ে, সেটি সমিতির নেতার কথায় স্পষ্ট। এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘এই পরিমাণ জরিমানা দেয়া কি বাংলাদেশে সম্ভব?’

আপনারা কী চান-এমন প্রশ্নে মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি, ভারত, নেপাল, ভুটানসহ আশেপাশের দেশগুলোর সাথে সামঞ্জ্যস্য রেখে আইন তৈরি করা হোক। এখন যদি কানাডা, আমেরিকার সাথে তুলনা করে আইন করা হয় সেটাতো ঠিক হবে না।...কিন্তু যে আইন সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ না, সাংঘর্ষিক বিষয় নিয়ে যে আইন সেটা তো করা যাবে না। যে জরিমানা আদায়যোগ্য নয়, সেটা তো করা যাবে না।’

জানতে চাইলে যাত্রীদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসলে মালিক সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করতে চায়। কিন্তু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়াই সিটিং সার্ভিসের ভাড়া। আলাদা করে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় না। এ বিষয়টি কিন্তু সাংঘর্ষিক।’

মোজাম্মেল হক জানান, বিআরটিএর খসড়া নীতিমালায় থাকা ছয়টি বিষয়ের পাশাপাশি তারা আরও ১২টি বিষয় যোগ করেছেন। কিন্তু এর কোনোটাই চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না মালিক সমিতির কারণে।

বিষয়টি নিয়ে সিটিং সার্ভিস নীতিমালা প্রণয়ণ কমিটির প্রধান বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কমিটির সুপারিশকৃত খসড়া নীতিমালা বিআরটিএর চেয়ারম্যানের বরাবরে জমা দেয়া হয়েছে। আমাদের কাজ জমা দেয়া, আমরা জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে আর কিছু জানি না।’

বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, ‘সিটিং সার্ভিসের বিষয়ে কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো বাস্তবায়নে আমরা আন্তরিক। আমরা যাত্রী ভোগান্তি কমাতে চাই, এ লক্ষ্যে দ্রুতই সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করে মন্ত্রী এবং সাচিবের কাছে পাঠানো হবে।’

গণপরিবহনের শৃঙ্খলায়ও সুপারিশ

সিটিং সার্ভিসের পাশাপাশি নগর পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতেও ২৬টি সুপারিশ করেছে কমিটি। এগুলোর মধ্যে রুট পুনর্বিন্যাস করে শহরের সব বাসকে নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলাচলের ব্যবস্থা করা এবং রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিং পদ্ধতিতে গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা রয়েছে।

এছাড়া ভাড়া নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি ও একচেটিয়া ব্যবসা ঠেকাতে প্রাইভেট অপারেটরদের অনুকূলে নতুন করে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখে বিআরটিসির মাধ্যমে অধিক সংখ্যক নতুন দ্বিতল বাস চালুর কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আন্তঃজেলা থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা সিটিতে স্থানান্তরের সুপারিশ করা হয়েছে।

বিআরটিসি বাসের লিজ প্রথা বাতিল করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাস সার্ভিস পরিচালনা, আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করে অধিক সংখ্যক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সার্ভিসের প্রবর্তন করারও সুপারিশ করেছে কমিটি।

ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/জিএম/ডব্লিউবি