কাতালোনিয়ার সংকটে স্পেন

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ১১:৫৩ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ১২:০২

মোহাম্মদ জমির

স্পেনের অঙ্গরাজ্য হিসেবে থাকতে নারাজ কাতালোনিয়া। তাই ২৭ অক্টোবর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে তারা। সেদিন কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় যখন কাতালোনিয়ায় প্রত্যক্ষ শাসন জারির কথা বলছিলেন, এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কাতালান পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে রায় দিল। বিবিসির খবরে বলা হয়, কাতালোনিয়া আঞ্চলিক পার্লামেন্টে স্বাধীনতার পক্ষে ৭০ ভোট পড়ে। বিপক্ষে পড়ে ১০ ভোট। পার্লামেন্টের বিরোধী দল এই ভোট বর্জন করে। এর আগে কেন্দ্রের বাধা উপেক্ষা করে ১ অক্টোবর গণভোটের আয়োজন করা হয় কাতালোনিয়ায়। এতে ৯০ শতাংশ ভোটার কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন।

স্পেন সরকার এই গণভোটকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করে এসেছে। স্বাধীনতাকামীদের প্রতিরোধে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার অনেকটাই কঠোর অবস্থানে। প্রথমেই আঞ্চলিক সরকার ভেঙে দিয়ে সেখানে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। কাতালান স্বাধীনতাকামীদের নেতা বরখাস্ত হওয়া আঞ্চলিক প্রেসিডেন্ট কার্লেস পুজদেমন ও তার মন্ত্রীদের বরখাস্ত করা হয়। এরপর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থি এই নেতাদের বিরুদ্ধে স্পেনের আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু তার আগেই চার সহযোগীকে নিয়ে বেলজিয়ামে চলে যান পুজদেমন। এই চারজন হলেন সাবেক সরকারের কৃষিমন্ত্রী মেরিটজেল সেরেট, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এন্টনি কমিন, সংস্কৃতিমন্ত্রী লুইজ পুইজ এবং শিক্ষামন্ত্রী ক্লারা পনসাতি। আদালতের সমনে হাজির না হওয়ায় ৩ নভেম্বর স্পেনের একজন বিচারক ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বেলজিয়ামে আশ্রয় নেওয়া পুজদেমন ও তার সঙ্গী সাবেক চার কাতালান মন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে স্পেনের উচ্চ আদালত ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর ৫ নভেম্বর ব্রাসেলসে বেলজীয় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুজদেমন ও তার চার মন্ত্রীকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয় বেলজিয়ামের এক আদালত।

গত কিছুদিনে স্পেনের এই হচ্ছে মূল খবর। আলোচনার ভেতরে যাওয়ার আগে আমাদের জানতে হবে কাতালানরা কেন স্প্যানিশ পরিচয়ে খুশি নয়? কেন তারা কাতালান জাতি হিসেবে জগতের বুকে বাঁচতে চায়? এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য কাতালোনিয়া সম্পর্কে একটু জেনে নেই।

প্রায় সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যাসমৃদ্ধ স্পেনে সব মিলিয়ে ১৭টি স্বায়ত্তশাসিত আঞ্চলিক পার্লামেন্ট রয়েছে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে কাতালোনিয়ার সঙ্গে স্পেনের বাকি অংশের একটা দ্ব›দ্ব রয়েছে। স্বাধীনতা ঘোষণার আগে স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিত্তশালী একটি স্বায়ত্তশাসিত অঙ্গরাজ্য হিসেবে ছিল কাতালোনিয়া। এর জনসংখ্যা ৭৫ লাখ, রাজধানী বার্সেলোনা। এর আয়তন ৩২ হাজার ১১৪ বর্গ কিলোমিটার। কাতালোনিয়ার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, পার্লামেন্ট, জাতীয় পতাকা ও সংগীত আছে। এমনকি কাতালোনিয়ার নিজস্ব পুলিশ বাহিনী আছে এবং স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবার মতো জন পরিষেবাগুলোও এই অঞ্চল নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। এই অঞ্চলের ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। কাতালোনিয়া চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত। এগুলো হচ্ছে- বার্সেলোনা, গিরোনা, লেইদা এবং তারাগোনা। এর রাজধানী এবং সর্ববৃহৎ শহর বার্সেলোনা, যা মাদ্রিদের পর স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।

অর্থনীতি বলুন, আর সংস্কৃতি বলুন এসব দিক দিয়ে কাতালোনিয়া স্পেনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। এর লিখিত ইতিহাস এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। স্পেনের গৃহযুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের ছিলো বড় রকমের স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের সময় কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসনকে নানাভাবে খর্ব করা হয়। কিন্তু ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সেখানকার জাতীয়তাবাদ আবার শক্তিশালী হতে শুরু করে এবং তীব্র আন্দোলন ও দাবির মুখে ওই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর সেটা করা হয় ১৯৭৮ সালের সংবিধানের আওতায়। স্পেনের সংসদে ২০০৬ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয় যেখানে কাতালোনিয়াকে আরো কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়। কাতালোনিয়াকে উল্লেখ করা হয় একটি ‘জাতি’ হিসেবে। কিন্তু সংবিধানে কাতালোনিয়াকে দেওয়া এরকম অনেক ক্ষমতা পরে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত বাতিল করে দেয় যা কাতালোনিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। স্বায়ত্তশাসন কাটছাঁট করার ফলে ক্ষুব্ধ কাতালানরা, এর সাথে যুক্ত হয় বছরের পর বছর ধরে চলা অর্থনৈতিক মন্দা, সরকারি খরচ কমানো, ২০১৪ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি গণভোটের আয়োজন করে। এভাবেই কাতালোনিয়া পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থায় মোড় নিয়েছে। স্পেনের সংবিধানের ১৫৫ ধারা অমান্য করে ১ অক্টোবর স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ৯০ শতাংশ ভোটের রায় পাওয়ার পর থেকে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ আর কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনায় হাজার হাজার মানুষ পথে নেমে এসেছে এবং স্পেন ও কাতালোনিয়ার রাজনীতিকদের সহিংসতার পথ ছেড়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে বলেছেন। কিন্তু জনগণের সেই অব্যক্ত অনুভ‚তির কথা রাজনীতিকরা আমলে নিতে পারেননি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কাতালান নেতা কার্লোস পুজেমন আর স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর কৌশলের থেকে রাজনৈতিক জেদ ও অভিলাষের বিষয়টিই সামনে চলে এসেছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য বেশি কঠোর অবস্থানে।

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার পরের দিনই মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকার স্পেনের সাংবিধানিক আইন লঙ্ঘন করে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট ও স্বাধীনতা ঘোষণা করার দায়ে কাতালোনিয়ার রাজ্য সরকারকে বাতিল করে আগামী ২১ ডিসেম্বর নতুন করে কাতালোনিয়া রাজ্য পার্লামেন্টের নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। স্পেনের মূলধারার দলগুলোও এই নতুন নির্বাচনের পক্ষে। একটি ভোট জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২১ ডিসেম্বর কাতালোনিয়া রাজ্য পার্লামেন্টে নতুন করে নির্বাচন হলে স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলোর পরাজয় ঘটবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাতালোনিয়া স্বাধীন হলে স্পেনের আদালতের রায় কিংবা স্পেনের সংবিধানের বাধা তারা মানতে বাধ্য নয়। আবার অন্যদিকে কাতালোনিয়ার অধিকাংশ মানুষ যদি স্পেনের সঙ্গে থাকার পক্ষেই দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে পুজেমনের দেশদ্রোহী হিসেবে দীর্ঘ জেলবাসের সাজা হতে পারে। এরপরও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি। আর তিনি আশা করছেন, কাতালানরা তার পক্ষে থাকবেন এবং কাতালোনিয়ার ঘোষিত স্বাধীনতা রক্ষা করবে।

স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে নয়। কিন্তু তারা কঠোর অবস্থান বা কেন্দ্রের আক্রমণাত্মক অবস্থানও দেখতে চায় না। গৃহযুদ্ধ বা সহিংসতার বিরোধী তারা। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে স্পেনের জনগণ চায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। ১৯৩৬ থেকে ১৯৭৫ সাল- এই দীর্ঘ সময় গৃহযুদ্ধের হানাহানি তারা দেখেছে। ১৯৩৬ সালে সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়াই দেশটির দক্ষিণপন্থীরা নির্বাচিত বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে স্বৈরাচার জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর শাসন শুরু হয়। ফ্রাঙ্কো নাৎসি জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির মতো স্বৈরশাসকের সহযোগিতা পেয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করেছিলেন। হিটলার ও মুসোলিনীর বিদায়ের পর ষাটের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রাঙ্কোকে মদদ দেয়। ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসন চলে দীর্ঘ সময় ধরে, ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত। এই স্বৈরশাসকের হাত থেকে স্পেনের জনগণকে রক্ষা করতে সেই সময় সারা বিশ্বের বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পীরা তাদের লেখনী দিয়ে, ছবি এঁকে স্পেনের মুক্তিকামী জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে স্পেনের স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৭৮ সালে স্পেনের গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়।

কাতালোনিয়া পরিস্থিতি নিয়েও পুরো বিশ্বের আগ্রহ আছে। কিন্তু এই সময়ে এসে কাতালান স্বাধীনতাকামীরা অবশ্য আন্তর্জাতিক সমর্থন সেভাবে পাচ্ছে না। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) এর ঘোর বিরোধী বলেই মনে হচ্ছে। এর কারণও আছে। কাতালোনিয়ার গণভোট ও স্বাধীন কাতালোনিয়ার বড় প্রভাব থাকবে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। তাই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে ইউরোপীয় নেতাদের অবস্থানও অনেকটাই পরিষ্কার। কার্লোস পুজেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মধ্যস্থতার আহŸান জানালেও ব্রাসেলস এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কাতালোনিয়ার প্রতিবেশী ফ্রান্স জানিয়েছে, কাতালোনিয়ার একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা তারা স্বীকৃতি দেবে না। ইউরোপীয় নেতাদের আশঙ্কা, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে স্বাধীনতার চেতনাকে উসকে দিতে পারে। জার্মানির বাভারিয়া, ইতালির সার্দিনিয়া, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে পৃথক হওয়ার রাজনীতি জোরদার হতে পারে। ফ্রান্সের নরম্যান্ডি, ব্রিটেনের অর্কনি দ্বীপ, ডেনমার্কের বর্নহম অঞ্চলে অধিকতর ক্ষমতা অর্জনের কর্মসূচি জোরালো হচ্ছে। ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এসব অঞ্চলের পৃথক হওয়া বা অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করছে নিশ্চিত করেই। এই হচ্ছে রাজনৈতিক কারণ।

বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেও কাতালানরা স্বাধীনতার পক্ষে প্রতিবেশী দেশগুলোকে পাশে পাচ্ছে না। ইউরোপে মন্দার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। মন্দার ফলে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি ও ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে ইউরোপের রাজনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশই এখন আর অর্থনীতির বোঝা ভাগাভাগি করতে রাজি হচ্ছে না। শুধু দেশই না, এটি ক্রমে আঞ্চলিক চেতনায় রূপ নিচ্ছে। দেশের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে অনেক অঞ্চলই বরং নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একধরনের অর্থনৈতিকবোধ রাজনৈতিক আকাঙ্খায় তাড়িত করছে। এই জায়গা থেকে স্কটিশরা স্বাধীনতার ভোটে গিয়ে হেরে গেছে। তবে স্পেনের কাতালানরা স্বাধীনতার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। স্কটিশ ও কাতালানরা সফলকাম হোক না হোক, কিন্তু তাদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও স্বাধীনতার চেতনাকে উসকে দিতে পারে।

কাতালানদের স্বাধীনতার ঘোষণার অনেকটা বিরোধিতা করেই ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বলেছেন, কাতালোনিয়ার পার্লামেন্টের স্বাধীনতার ঘোষণায় কোনো কিছু পরিবর্তন হয়নি। ইইউ শুধু মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করবে। ইইউ শুরু থেকেই স্পেনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রেখেছে। কাতালোনিয়া নিয়ে সৃষ্ট সংকটকে স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও জোটটি আখ্যা দিয়েছিল। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রে মাদ্রিদের মিত্ররা মারিয়ানো রাহয়ের পক্ষেই আছেন। টুইটারে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী চার্লেস মিশেল বলেন, সংলাপের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব। টুইটারে পোস্ট করা বিবৃতির মাধ্যমে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মুখপাত্র স্টেফেন সেইবার্ট বলেন, ‘জার্মান সরকার এ ধরনের স্বাধীনতার ঘোষণার স্বীকৃতি দেয় না।’

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের দপ্তর বলেছে, কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক পার্লামেন্টের স্বাধীনতার ঘোষণা ব্রিটেন স্বীকৃতি দিচ্ছে না এবং দেবেও না। কারণ যে গণভোটকে স্পেনের আদালত অবৈধ বলেছেন, তার ভিত্তিতে তা হয়েছে। কিন্তু স্পেনের সমালোচনা করে স্কটিশ সরকার বলেছে, কাতালোনিয়ার আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে মাদ্রিদের সরাসরি শাসন জারি করা কোনো সমাধান হতে পারে না। স্কটিশদের পক্ষে থাকার কারণ হচ্ছে, তাদের সরকারের নেতৃত্বে রয়েছে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি, যেটি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীন হতে প্রচারণা চালিয়েছিল। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘কাতালোনিয়া স্পেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্পেনকে একীভ‚ত ও শক্তিশালী রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে।’

এই অবস্থায় কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার একটি ‘শক্ত’ অবস্থানে গেছে। কাতালোনিয়ার সরকারকে বরখাস্ত করার পর ২৭ অক্টোবর বার্সেলোনায় ঐক্যবদ্ধ স্পেনের পক্ষে বড় ধরনের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা কেউ কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নেতা কার্লেস পুজদেমনের গ্রেপ্তারেরও দাবি জানিয়েছে। পরিস্থিতি সেখানে যে খুব স্বাভাবিক, তা বলা যাবে না। কেননা পুজদেমন বলছেন, তিনি তার সরকারের বরখাস্ত ও কাতালোনিয়ায় কেন্দ্রের শাসনকে স্বীকার করেন না। কাতালোনিয়ার বরখাস্তকৃত সরকারের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট অরিয়ল জুনকুয়েরাজ কাতালোনিয়ার এক গণমাধ্যমে লিখেছেন, ‘কাতালোনিয়া রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্লেস পুজদেমন এখনো বহাল আছেন। আমরা কাতালোনিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, তা মানি না।’ এর অর্থ পরিষ্কার, কাতালোনিয়ায় একদিকে যেমন রয়েছে স্বাধীনতাকামীরা, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরাও।

কাতালোনিয়া সংকট নিয়ে বাংলাদেশ তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। আমাদের সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা মনে করে এই সংকট স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও স্পেনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পরস্পরের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখÐতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে উভয় দেশের সহযোগিতামূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে বলেই মনে করে বাংলাদেশ। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর কোনো ইচ্ছাই বাংলাদেশের নেই। তবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সংবিধানের মূলনীতি অনুযায়ী, ভৌগোলিক অখÐতা রক্ষায় স্পেন সরকারের নেওয়া সব শান্তিপূর্ণ উদ্যোগকেও শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখবে বাংলাদেশ। দেশটি সব নাগরিকের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে বাংলাদেশের তরফে আশা করা হচ্ছে। যেকোনো রাষ্ট্রকে অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ক‚টনৈতিক বিষয়ে বাধা-ধরা একটি রুটিনমাফিক অবস্থান নিতে হয়। কিন্তু সারা বিশ্বের মতো এই দেশের অনেক সাধারণ মানুষও কাতালানদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল। তবে সংকট উত্তরণে শেষ পর্যন্ত অবশ্য স্প্যানিশ ও কাতালানদেরই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এটা হতে পারে শক্তি পরীক্ষা। অথবা সমঝোতা-সংলাপের মাধ্যমে। যাই হোক, পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা বুঝতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। তবে শান্তির পক্ষেই প্রার্থনা করে যেতে হবে আমাদের।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার